ওষুধ কম্পানিগুলো যেভাবে মানুষকে প্রতারিত করে by ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে একদিকে মানবসভ্যতা যেমন উপকৃত হয়েছে, এক শ্রেণীর অসাধু ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে মানবসভ্যতা বিপথগামী ও ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে সমভাবে। রোগের সঙ্গে ওষুধের সম্পর্ক নিবিড়। রোগাক্রান্ত হলে মানুষকে ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। সে ওষুধ হতে হবে গুণগতমানসম্পন্ন ও কার্যকর।
ওষুধ যদি বাস্তবিকভাবে ওষুধ না হয়, হয় যদি ওষুধ নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ, তবে ব্যবসা হয়তো ঠিকই হবে; কিন্তু রোগী কোনোভাবেই উপকৃত হবে না; বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে নতুবা মৃত্যুবরণ করবে। বিশ্বব্যাপী ঠিক এ ধরনের বহু ঘটনাই প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। প্রিয় পাঠক, আসুন ব্যাপারটি নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।
অসুস্থ হলে আমরা চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে যাই। চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখে দেন এবং আমরা সে মোতাবেক যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য ওষুধ গ্রহণ করি। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ গ্রহণ বর্তমান বিশ্বে এক বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যত লোক মারা গিয়েছিল, প্রতিবছর এফডিএ (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কর্তৃক অনুমোদিত ওষুধ গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রে তার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ লোক মৃত্যুবরণ করে। তার কারণ হলো- চিকিৎসক কর্তৃক প্রেসক্রিপশনে ওষুধ নির্বাচনে বিজ্ঞান মূল ভূমিকা পালন করে না, এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে ওষুধ কম্পানিগুলোর অমানবিক প্রতারণা। এ ধরনের প্রতারণার উৎস বহুবিধ। চিকিৎসাশাস্ত্রে ঘোস্ট রাইটিং (Ghost Writing) নামে দুটো শব্দ প্রচলিত আছে। ঘোস্ট রাইটিংয়ের আভিধানিক অর্থ হলো ভুতুড়ে লেখক। বিজ্ঞানের ভাষায় কোনো ব্যক্তির লেখা তার মনিব স্বনামে চালিয়ে দিলে তাকে ঘোস্ট রাইটিং বলা হয়। সাধারণত চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন ওষুধ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানার জন্য মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন পণ্ডিত দ্বারা নিরীক্ষিত মেডিক্যাল জার্নালের ওপর নির্ভর করে থাকেন। এসব জার্নালের মধ্যে ল্যানসেট, ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল, জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন হলো বিশ্বনন্দিত। বিশ্বের মানুষ অবশ্যই প্রত্যাশা করে- এসব জার্নালে ওষুধ সম্পর্কে প্রকাশিত সব তথ্য হবে প্রকৃতভাবে তথ্যভিত্তিক ও বিজ্ঞান সমর্থিত। দুর্ভাগ্যক্রমে এ ধারণা সর্বাঙ্গীণ সত্য নয়। ঘোস্ট রাইটিংয়ের কারণে উপরিউলি্লখিত বিশ্বনন্দিত জার্নালগুলোকেও আজকাল আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। গবেষণাধর্মী ওষুধ কম্পানিগুলো নামিদামি পিএইচডি ডিগ্রিধারী পণ্ডিতদের তাঁদের উৎপাদিত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়া বা নিষ্ক্রিয়তা গোপন করে শুধু গুণাবলি ও প্রবল কার্যকারিতা তুলে ধরে ওপরে বর্ণিত জার্নালগুলোতে প্রদানের জন্য নিবন্ধ তৈরির উদ্দেশ্যে ভাড়া করে। নিবন্ধ প্রস্তুত হয়ে গেলে ওষুধ কম্পানিগুলো চিকিৎসকদের নিয়োগ দেয় এসব নিবন্ধ তাদের নামে জার্নালে ছাপানোর জন্য। এসব নিবন্ধ বা রিপোর্ট অবশেষে নামিদামি জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়। এতে মান-সম্মান বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি এসব লেখক অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। প্রতি রিপোর্টের জন্য কোনো কোনো রাইটার কম করে হলেও ২০ হাজার ডলার উপার্জন করেন। চিকিৎসকরা মান-সম্মান ও অর্থের ভাগিদার হলেও ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। তারা আসল ওষুধের নামে পায় নকল বা ভুয়া ওষুধ। বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতনামা মেডিক্যাল জার্নাল 'দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন'-এর কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে তাদের জার্নালে প্রকাশিত ৫০ শতাংশ গবেষণা প্রবন্ধ বা রিপোর্ট ভুতুড়ে লেখক কর্তৃক লিখিত। ব্রিটিশ জার্নাল অব মেডিসিনের সম্পাদক স্বীকার করেছেন যে ঘোস্ট রাইটিং তাঁদের জার্নাল প্রকাশনার জন্য এক মারাত্মক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরা ওষুধ কম্পানি দ্বারা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছি। এসব গবেষণা প্রবন্ধে চিকিৎসকদের নাম থাকে। আমরা ধরে নিই, তাঁরা ওষুধ সম্পর্কে সুপণ্ডিত। দ্বিতীয়ত, প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা থাকে না। ওষুধ বা ওষুধসংক্রান্ত তথ্যাবলি সম্পর্কে আমরা পণ্ডিতও নই। তাই এগুলো আমাদের ছাপাতে হয়। দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনসের সহযোগী সম্পাদক বলেন, এসব লেখক যেসব প্রবন্ধ পাঠান, তা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানবিবর্জিত। এসব কারণে সাধারণ চিকিৎসকরা ভ্রান্ত হন এবং বিপদে পড়েন। তাঁরা বুঝতে পারেন না, জার্নালের কোন প্রবন্ধ আসল এবং বিশ্বাসযোগ্য আর কোনটি ভুয়া। আর এতে তাঁদের প্রকৃত ওষুধ নির্বাচনে ধোঁকায় পড়তে হয়। ওষুধ কম্পানিগুলোর এ ধরনের প্রতারণার কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করতে পারে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের ওপর থেকেও মানুষের আস্থা চলে যায়। মানুষ ঠকানোর আরেক মারণাস্ত্র হলো- চেকবুক সায়েন্স (Checkbook Science).
ড. ডায়না সুকারম্যানের সংজ্ঞামতে, চেকবুক সায়েন্স হলো এক ধরনের গবেষণা, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি ও মানুষের কল্যাণের জন্য করা হয় না। এসব গবেষণার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো লোক ঠকানো এবং ওষুধ ব্যবসার সম্প্রসারণ। এ ন্যক্কারজনক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় ও নামিদামি প্রতিষ্ঠানের মৌলিক গবেষণাকে কলুষিত করছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানকে পদদলিত করছে আর মানুষের দেহ-মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
ওষুধ কম্পানিগুলো চেকবুক সায়েন্স ব্যবহারের মাধ্যমে ওষুধের ওপর তাদের নিজস্ব গবেষণা চালিয়ে যায়। এসব গবেষণায় শামিল হয় নামিদামি পেশাজীবী পণ্ডিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের নিজস্ব গবেষণার সামগ্রিক বিন্যাস বা পরিকল্পনা ইচ্ছামাফিক সাজানো, গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা ও বিশদকরণ এবং ওষুধের খারাপ দিকগুলো ধামাচাপা দিয়ে শুধু কার্যকারিতা ও গুণাবলি তুলে ধরার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়।
মেডিক্যাল ঘোস্ট রাইটিংয়ের মতো চেকবুক সায়েন্সও ধারণাতীতভাবে সাধারণ ঘটনা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতি তিনজনের একজন পেশাজীবী অধ্যাপক ওষুধ কম্পানিগুলোর অবৈধ এবং অনৈতিক এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। লস এঞ্জেলেস টাইমসের মতে, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা ওষুধ কম্পানি থেকে টাকার চেক বা কম্পানি শেয়ার গ্রহণ করে থাকেন। দুই দশক ধরে এ ধরনের অপকর্ম চলে আসছে। মজার ব্যাপার হলো, প্রেসক্রিপশন ড্রাগের ক্ষেত্রেই এসব প্রতারণা বা জালিয়াতি বেশি চলে। এতে ওষুধ কম্পানিগুলোর সুবিধা। কারণ, প্রেসক্রিপশন ড্রাগ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা সম্ভব নয়। তাই রোগীদের এসব ওষুধ কেনা ছাড়া বিকল্প কোনো সুযোগ থাকে না। আপনি যদি ঘোস্ট রাইটিং বা মেডিক্যাল চেকবুক সায়েন্স বুঝে উঠতে পারেন, তাহলে পরিষ্কার হয়ে যাবে, চিকিৎসকরা কেন ওষুধের এত পূজা করেন বা ওষুধের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত। তাঁরা বিশেষ বিশেষ ওষুধের ভালো দিকগুলো খুব ভালোভাবেই দেখেন, খারাপ দিকগুলো দেখেন না। আমরা হয়তো জানি না, যুদ্ধের চেয়েও আধুনিক ওষুধ অনেক বেশি মরণঘাতী। কিন্তু এই মরণঘাতী বিপদের আশঙ্কাকে টাকা ও কলম দিয়ে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া আজকাল আর আদৌ খুব শক্ত বা জটিল ব্যাপার নয়।
প্রেসক্রিপশন ড্রাগ প্রতারণার দায়ভার কখনোই ওষুধ কম্পানিগুলোকে বহন করতে হয় না। তারা ও তাদের অপকর্ম পর্দার অন্তরালেই থেকে যায়। ভুগতে হয় অসহায় নিরীহ সাধারণ মানুষকে। ওষুধ কম্পানির প্রতারণার দায়ে তাদের অসুখ ভালো হয় না, রোগ বেড়েই চলে। একসময় হয়তো তাদের জীবনও দিতে হয়। অসুখ ভালো না হওয়া বা মৃত্যুর জন্য ওষুধকে আমরা খুব কমই দায়ী করি। যদিও সে মৃত্যু ওষুধের কারণেই হয়ে থাকে। আমরা এ ধরনের মৃত্যুর জন্য অন্য সব কিছুর মধ্যে বয়সকে দায়ী করি, রোগের জটিলতা সামনে টেনে আনি বা চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসা বা অজ্ঞতাকেই দায়ী করি। মূল কারণটা পর্দার অন্তরালেই থেকে যায়। ভুতুড়ে লেখকদের ভুতুড়ে ওষুধের নজির চিকিৎসাশাস্ত্রে বিরল নয়। এসব ভুতুড়ে ওষুধের কারণে বিশ্বব্যাপী যুগ যুগ ধরে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অসহায়ভাবে জীবন দিতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। ইতিমধ্যে চেকবুক সায়েন্সের শিকার হয়েছে রফেকঙ্বি, থ্যালিডোমাইড, রসিগি্লটাজোন জাতীয় আরো অসংখ্য ওষুধ। আর এসব ওষুধ মানবসভ্যতার জন্য ডেকে এনেছে মারাত্মক বিপর্যয়, কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ জীবন। ঘোস্ট রাইটিং বা চেকবুক সায়েন্স রাতারাতি হয়তো তিরোহিত হয়ে যাবে না। ভুতুড়ে ওষুধের কারণে ক্ষতি বা মৃত্যুঝুঁকিও কোনো দিন কমবে না। এসব প্রতারণার কারণে হয়তো মানবসভ্যতাকে ভবিষ্যতে আরো চরম মূল্য দিতে হবে। কিন্তু এত ক্ষতি, বিপর্যয় বা মৃত্যুর পরও ওষুধ কম্পানিগুলোর বোধোদয় হবে- এমনটা আশা করা যায় না। কারণ, তারা ব্যবসায়ী। এবং ব্যবসায় মূল্যবোধ, অপরাধবোধ, নৈতিকতাবোধ সব সময় কাজ করে না।

লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাবি এবং প্রোভিসি, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.