দার্শনিক ও কৌশলগত পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম আযম- যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ সুলতানা কামালের জবানবন্দী

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল জবানবন্দীতে বলেছেন, আল বদর, আল শামস ও রাজাকার বাহিনী


পাকিস্তানী সেনাদের বিভিন্ন কৌশলে সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছে। আর এই সমর্থন ও সহযোগিতার অপরাধের ‘মাস্টার মাইন্ড’ ছিলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতা গোলাম আযম। পাকিস্তান হানাদার বািহনীর পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার কৌশল এবং সেই কৌশলকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা যারা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগিদার। এ ছাড়া এ সমস্ত বাহিনীর দার্শনিক ও কৌশলগত পরিকল্পনার নেতৃত্ব¡ও দিয়েছিলেন গোলাম আযম। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দীতে এ কথা বলেছেন। জবানবন্দী শেষে তাঁকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী।
প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল (৬৩) মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনে জবানবন্দী শেষ করেছেন। মামলায় তিনি সাক্ষী হিসেবে সোমবার তাঁর জবানবন্দী পেশ শুরু করেন। মঙ্গলবার তাঁর জবানবন্দী শেষ হয়। এর পরপরই আসামি পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তাঁকে জেরা শুরু করেন। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম আজ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। আজ আবার সুলতানা কামালকে জেরা করবে আসামি পক্ষের আইনজীবী। প্রসিকিউশন পক্ষে চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্যান্য প্রসিকিউটর উপস্থিত ছিলেন।
দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দীতে মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, রাজাকার, শান্তি কমিটি, আল বদর ও আল শামসের মতো বাহিনীর দার্শনিক ও কৌশলগত পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন গোলাম আলম। ৭১ সালের ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে তা দেখে নাৎসী আমলের অনেক হত্যাকা- লজ্জিত হয়। শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানদেরই একই উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে তা নয়, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রত্যেকটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানদের চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের ওপর হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটকে পৃথিবীর অন্যতম একটি নিকৃষ্টতম গণহত্যা উল্লেখ করে বলেন, একটি গণতন্ত্রকামী জণগোষ্ঠীর ওপর যারা মূলত নিরস্ত্র ছিল তাদের ওপর সশস্ত্র হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা, ইকবাল হল পুড়িয়ে দেয়া, রোকেয়া হল ও জগন্নাথ হলের ছাত্র হত্যা, কালী মন্দির আক্রমণ ও শাখারী বাজার রায়ের বাজার, হাটখোলাসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় কারফিউ দিয়ে অগ্নিসংযোগ করা এবং রাজারবাগে পুলিশ ও পিলখানায় রাইফেলস্-এর সদস্যদের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করেন।
এ সময় তিনি বরিশালের একটি হত্যাকা-ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘একটি বাজারে সমবেত জনগোষ্ঠীর ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ যখন দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিতে যায় তখন লঞ্চ থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের বিপরীত দিক থেকে গুলি করেছে। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এ ধরনের ঘটনা দেশের সর্বত্রই ঘটেছিল। এটি ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষার কৌশল। এই কৌশলকে বাস্তবায়ন করতে যারা সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগীদার। এই সমর্থন ও সহযোগিতার মাস্টার মাইন্ড ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এবং শান্তি কমিটিরও অন্যতম শীর্ষ নেতা গোলাম আযম।
তৃতীয় সাক্ষী জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালের ২৩ আগস্ট এবং ৩১ আগস্ট গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর ও হায়দ্রাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এসব কর্মকা-কে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছেন। একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়, তখন সেখানে জামায়াতে ইসলামীর দু’জন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য করে গোলাম আযম বলেছিলেন, ঠিক যে লক্ষ্যে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে ঠিক একই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের মন্ত্রিসভার সদস্য করা হয়েছে।
সুলতানা কামাল বলেন, শান্তি কমিটির সদস্যরা কখনও কখনও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র অভিযানে অংশগ্রহণ করত। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল সেটা সকলেরই জানা। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর যখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, মুক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি দম্ভভরে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তির ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট।
সুলতানা কামাল আরও বলেন , একাত্তরের অনেক পরিবারের কেউ না কেউ নিহত হয়েছেন। কোন কোন পরিবারের একধিক সদস্য নিহত হয়েছেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের হারিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিল তাদের হারিয়েছি। এক একটি পরিবারের তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিহত হওয়ায় ঐসব পরিবার দুরবস্থায় পতিত হয়েছে। নারীর অবস্থা ততোধিক বিপন্ন। কারণ তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে লক্ষণীয় যে একজন গণহত্যাকারী কতখানি বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন হলে তাদের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাত পান ও বৈঠক করেন। তাদের অনেককেই স্থানীয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছিল। এরা মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন এবং তাদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা দেখার জন্য বিশেষ করে এই সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়েছিল। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে একজন বিদেশী ডাক্তার ছিলেন। যার নাম ডা. ডেভিস। এ ছাড়াও দেশীয় নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তাররাও ছিল। সর্বক্ষণিকভাবে আমার মা সুফিয়া কামাল, রাজনীতিবিদ বদরুন্নেসা আহমেদ, সমাজসেবী সায়রা আহমেদ, মালেকা খান, আফিফা হক প্রমুখ এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
তিনি বলেন, ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত ছিল। পুনর্বাসন কেন্দ্রে যেসব যুদ্ধ শিশু ছিল তাদের মায়েদের একটা সুযোগ দেয়া হয়েছিল, তারা রাজি থাকলে ওই শিশুদের দত্তক দেয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ থাকার কারণে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মানবাধিকার, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবতার মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
সেই অবস্থান থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে এই প্রত্যাশা রাখি যে, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত নীতিগতভাবে সমর্থন দিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে এই গণহত্যাকে সমর্থন জাগিয়েছে এবং মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানী ঘটিয়েছে, সাড়ে ৭ কোটি জণগণের কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারা ব্যতিত অন্য মানুষের মধ্যে ১ কোটি লোককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে, দেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল তাদের অনবরত ভীতিকর অবস্থায় নিজের বাড়ি, ঘর, গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করতে বাধ্য করেছে, ২ লাখ নারীকে ধর্ষণের শিকার করেছে, আরও লাখ লাখ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছে এবং এই যুদ্ধের কারণে কোটি কোটি পরিবারকে বিপর্যস্ত করেছে। বিচারের মাধ্যমে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পাবে এটাই আমি প্রত্যাশা করি।
তিনি আরও বলেন, একাত্তরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে মা সুফিয়া কামাল অন্যান্য সহকর্মীকে নিয়ে নারীদের পুনবার্সনের জন্য নানাধরনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ব্র্যাক নামে পরিচিত যে বেসরকারী সংস্থাটি আছে তার প্রথম চেয়ারপার্সন হয়েছিলেন আমার মা। ব্র্যাক ও নারী পুনবার্সন প্রতিষ্ঠা কেন্দ্র করে এ সব সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তাঁর সহকর্মীদের নতুন স্বাধীন দেশের পুনর্গঠনে যুদ্ধবিদ্ধস্ত মানুষের জন্য আত্মনিয়োগ করেন।
আমরা সেই কাজে যুক্ত হয়ে যাই। সেই কারণে নারী পুনবার্সনের কাজেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। একই সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এই ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। এরই ধারাবাহিকতায় মানবাধিকার কাজের সঙ্গে যুক্ত হই। এবং আইন অধ্যয়নের কাজ শুরু করি। যা শেষ হয় ৭৮ সালে। আমি একটি বিশেষ দায়িত্বের কারণে ১৯ অত্যাচারিত নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। যারা সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছিল। তাদের অনেককেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসররা তাদের কাছে হস্তান্তরিত করেছে।
জবানবন্দী শেষে সাক্ষী আসামির কাঠগড়ায় গোলাম আযমকে শনাক্ত করেন। এরপর তাঁকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরায় আইনজীবীর প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী সুলতানা কামাল বলেন, রাজাকার বাহিনী গঠনের তারিখ বলতে পারব না তবে মে মাসের দিকে প্রথম খুলনায় ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গঠন হয়। ১৯৭১ সালে আপনাদের বাড়িতে কোন রাজাকার, আল বদর, শান্তি কমিটির কোন সদস্য গিয়েছিল বা কোন আক্রমণ করেছিল কিনা আইনজীবীর প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী বলেন, কেউ আসেনি তবে যুদ্ধের শেষের দিকে আমাদের বাড়িতে হামলা করার একটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে জেনেছি। জেরার অংশ বিশেষ নিম্নে দেয়া হলো।
প্রশ্ন : আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী প্রদান করেছেন, তার নাম বলতে পারবেন।
উত্তর : মনোয়ারা বেগম।
প্রশ্ন : তরিখটি মনে আছে।
উত্তর : বেশ কয়েকবার গেছেন। শেষ করেছি ২০১২ সালের জুলাই মাসের ১১ তারিখে। পরে সাক্ষী বলেন, ২০১১ সালে।
প্রশ্ন : কয়দিন জবানবন্দী দিয়েছিলেন।
উত্তর : নির্দিষ্টভাবে মনে নেই। তবে একাধিকবার জবানবন্দী দেবার জন্য বসেছিলেন।
প্রশ্ন : আপনার বাসায় না অফিসে জবানবন্দী দিয়েছিলেন।
উত্তর : অফিসে।
প্রশ্ন : আপনি নিজে কয়বার তদন্ত সংস্থার অফিসে গিয়েছিলেন।
উত্তর : মনে করতে পারি না যে, কখনও তদন্ত সংস্থার অফিসে গিয়েছি।
প্রশ্ন : রাজাকার অর্ডিন্যান্স আপনি তদন্ত সংস্থা অফিসে গিয়ে জমা দিয়েছিলেন।
উত্তর : যখন তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশন এই ট্রাইব্যুনাল অফিসে ছিল তখন ট্রাইব্যুনালে এসে তদন্ত সংস্থার কাছে রাজাকার অর্ডিন্যান্স জমা দিয়েছিলাম।
প্রশ্ন : তারিখ কবে মনে আছে।
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : সাল।
উত্তর : সম্ভবত ২০১০ সালে।
প্রশ্ন : তদন্ত সংস্থায় বর্তমান অফিসটি কবে স্থানান্তর হয়েছে।
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনি এই মামলার নালিশকারী ব্যক্তি নন।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তদন্ত সংস্থার ক্রমিক নং ৫, ১-৮-২০১০-এর নালিশকারী কে।
উত্তর : তা আমি জানি না।
প্রশ্ন : গোলাম আযম একজন পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন, ডকে একজন ব্যক্তিই আছে।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : রাজাকার বাহিনীর গঠনের তারিখ বলতে পারেন।
উত্তর : সঠিক ভাবে বলতে পারি না। একাত্তর সালের মে মাসের খুলনায় মাওলানা ইউসুফ গঠন করেছিলেন।
প্রশ্ন : আপনার বাসায় তখন পত্রিকা থাকত।
উত্তর : পূর্বদেশ, আজাদ পত্রিকা, ডেইলি পিপলস, ডেইলি মর্নিং নিউজ আসত।
প্রশ্ন : দৈনিক পূর্বদেশে পড়েছিলেন খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন হয়েছিল।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : এই পত্রিকাটি আপনার সংরক্ষণে আছে।
উত্তর : সংরক্ষণে নেই। তদন্ত সংস্থাকেও জমা দেই নি।
প্রশ্ন : যে খবরটি পড়েছিলেন সেখানে ইউসুফ সাহেবের নাম আছে।
উত্তর : নাম ছিল।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ৭৫-৮০ সাল পর্যন্ত কোন পত্রিকায় দেখেছেন কি।
উত্তর : এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কারণ আমি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। খুব সম্ভবত পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়ও এটা প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : সময়টা বলতে পারেন।
উত্তর : ৮০ দশকে।
প্রশ্ন : ঐ সময়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক শাহরিয়ার কবির।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : মোস্তাফি শফি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। শাহরিয়ার কবিরের আহ্বায়কের আগে।
উত্তর : মোস্তাফি শফি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে ছিলেন।
প্রশ্ন : রাজাকার বাহিনী আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে ২ আগস্ট গেজেড বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কার্যকর শুরু করে কিনা।
উত্তর : গেজেড সম্পর্কে অবগত আছি। সেটা আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন : পরবর্তীকালে পাকিস্তান সামরিক সরকারের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধীনস্থ করা হয়।
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : রাজাকার বাহিনী সরকার প্রতিষ্ঠিত একটি ডিরেকটর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এর প্রধান ছিলেন একজন ডিরেক্টর।
উত্তর : হতো।
প্রশ্ন : রাজাকারের প্রথমে ডিরেক্টর ছিলেন পুলিশের ডিআইজি আব্দুর রহিম।
উত্তর : আমি জানি না।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আব্দুর রহিম নামে একজন সচিব ছিলেন।
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : রাজাকারদের স্থানীয় ভাবে এসডিও নিয়োগ দিত।
উত্তর : একটি গেজেটের মাধ্যমে যখন কোন সংগঠন কাজ করে তখন সরকার এর নির্দেশ মেনে চলতে হয়।
প্রশ্ন : রাজাকার বাহিনীতে ট্রেনিং দিতেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ।
উত্তর : যেহেতু তাদের কমান্ডিং দায়িত্ব সরকারের ওপর হন্তান্তর হয়।
প্রশ্ন : সরকার বিধিবদ্ধ বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পূর্বে ২ আগস্ট রাজাকার বাহিনীর কাছে অস্ত্র ছিল না।
উত্তর : তবে এই ধরনের বাহিনী যখন কাজ করে তখন তাদের অস্ত্র থাকা অপরিহার্য্য ছিল না। কারণ তারা বিভিন্নভাবে যেমন তথ্য সরবরাহ করা, বাড়ি চিনিয়ে দেয়া, হুমকি দেয়া, হয়রানি করা এ সবের জন্য অস্ত্রের প্রয়োজন হয় না।
প্রশ্ন : আপনি যে এলাকায় জুন মাস পর্যন্ত ছিলেন সেটা কোন থানার অধীনে।
উত্তর : ঐ সময় ধানম-ি এলাকাতেই থাকতাম।
প্রশ্ন : ঐ সময় ধানম-ি কোন থানা ছিল না।
উত্তর : লালবাগ থানার অধীনে ছিল।
প্রশ্ন : দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে ফিরে ঢাকা জেলা আনসার প্রধান কে ছিলেন ।
উত্তর : সে খবর নেইনি।
প্রশ্ন : আপনাদের বাড়িতে কোন দিন রাজাকার আর্মি এসেছিল।
উত্তর : আসেনি। একদম যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমার মায়ের ওপর হামলার পরিকল্পনা হয় এ তথ্য পাওয়া গিয়েছিল বলে শুনেছি।
প্রশ্ন : আপনার মা দুটি ডায়েরি রাখতেন।
উত্তর : দুটি ডায়েরি রাখতেন। একটি দৈনন্দিন। অন্যটি কবিতার।
প্রশ্ন : দৈনন্দিন ডায়েরিটি পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : একাত্তরের যে ডায়েরিতে আল বদর হত্যার পরিকল্পনা করতে চেয়েছিল তা নেই।
উত্তর : শেষের দিকে সাক্ষাতকারে এসেছে।
প্রশ্ন : হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ আছে।
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : তিনি জীবনীতে ষড়যন্ত্রকারীদের নাম উল্লেখ করেছেন।
উত্তর : ষড়যন্ত্রকারী আল বদরদের নাম জানার সুযোগ ছিল না। উনি আমাদেরও বলেননি।
প্রশ্ন : ধানম-িতে ১৬ জুন পর্যন্ত ছিলেন। ঐ এলাকায় কোন আল বদরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
উত্তর : ঢাকায় থাকা অবস্থায় কোন আল বদর বা রাজাকারদের সঙ্গে দেখা হয় নি। কারণ তারা গোপনে থাকত। কারও কাছেই নিজেদের নাম প্রকাশ করেনি। যাদের হত্যা করেছে তাদের কাছেও কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে এসেছে।
প্রশ্ন : সর্ব প্রথম কোন আল বদর বাহিনীর নাম শুনলেন।
উত্তর : আমি সর্ব প্রথম আল বদরের নাম মতিউর রহমান নিজামীকে দেখেছি। বছর বলতে পারব না। তবে ৮০ দশকের প্রথম দিকে দেখেছি।
প্রশ্ন : যখন নিজামীর নাম শুনলেন, উনার তখন আর কোন পরিচয় ছিল।
উত্তর : জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন।
প্রশ্ন : কোন পদে ছিলেন।
উত্তর : কোন পদে ছিলেন মনে নেই। তবে শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নিজামী পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন কিনা।
উত্তর : সমস্ত কর্মকা-ের প্রধান নেতা হিসেবে মাস্টার মাইন্ড গোলাম আযমের নাম এসেছে। অন্যদের নামও এসেছে। তাদের জীবনী পাঠ করা হয়নি। নিজামী আমার কাছে পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন না।
প্রশ্ন : আপনি ছাত্র রাজনীতি করতেন।
উত্তর : সরাসরি ছাত্র রাজনীতি করিনি।
প্রশ্ন : ৬ দফা এবং ১১ দফার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
উত্তর : জি। মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করেছি।
প্রশ্ন : ১১ দফা আন্দোলনের উদ্যোক্তা কে ছিল।
উত্তর : একটি বড় রাজনৈতিক দলের জোটের মাধ্যমে এসেছে। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দল ছিল।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে ধর্মভিক্তিক দলসমূহ পাকিস্তানের অখ-তার পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন ছিল।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীও ছিল।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন খাজা খয়ের উদ্দিন।
উত্তর : জি।
প্রশ্ন : শান্তি কমিটি কি পদ্ধতিতে কার্যপরিচালনা করত। এমন ধারণা আছে।
উত্তর : তারা বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানের অখ-তার পক্ষে কাজ করেছিল। ধর্মকে রাষ্ট্রের ওপর স্থান দিয়েছিল। এবং পাকিস্তানের অখ-তার স্বার্থে তারা ধর্মকে ব্যবহার করে দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থন করেছে এবং মনে করত যে প্রকৃত মুসলমানরাই হলো পাকিস্তানের অধিবাসী। এটাও প্রচার করেছে, ভাল মুসলমান মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করতে পারে না। এটা প্রচার করেছিল। শান্তি কমিটি যে যোগ দিয়েছে, মনস্তাত্ত্বিক ভাবে চাপ দিয়ে তাদের মতে পাকিস্তানের অখ-তাকে রক্ষা করতে সেটার পক্ষে নিয়ে আসত।
এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আরও দু’জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দী পেশ করেছেন। তাঁরা হলেন বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম (এসপি মাহবুব)। ১ মে সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। পরে ৫ জুন তাঁর বিরুদ্ধে (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের কাজ শুরু করে ট্রাইব্যুনাল-১।
১ জুন পাঁচ ধরনের ঘটনায় ৬২টি অভিযোগের মধ্যে মোট ৬১টি ঘটনার ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করা হয় জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। তার আগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯১ পৃষ্ঠার অভিযোগ উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন পক্ষ। ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার পর গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় ট্রাইব্যুনাল। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.