নিলাম কেন্দ্র নিয়ে জটিলতার সুরাহা হয়নি- চা শিল্পে সঙ্কট ৩ by রহিম শেখ

চা শ্রমিকদের আয় বাড়বে চায়ের উৎপাদন বাড়লে এমন বক্তব্য চা বাগান মালিকদের। চায়ের উৎপাদন বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু চায়ের নিলাম কেন্দ্র নিয়ে যে জটিলতা রয়েছে তার কোন সুরাহা এখনও হয়নি।


যদিও চায়ের নিলাম কেন্দ্র স্থাপনে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, অকশনার, বাগান মালিক, উৎপাদক মহল থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করেছেন। তারপরও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে লাভ-ক্ষতির হিসাব নিয়ে। সিলেটবাসীর প্রাণের দাবি শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের। আর চট্টগ্রামবাসী বলছে, ৬০ বছরের এই নিলাম কেন্দ্র স্থানান্তর হলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। এ মুহূর্তে সরকারের উচ্চমহল বিষয়টি নিয়ে অনেকদূর এগিয়েছে। তারা বলছে, শেষপর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম কেন্দ্র স্থাপন হবে। তবে এটি হবে দেশের দ্বিতীয় চায়ের নিলাম কেন্দ্র।
জানা যায়, চা উৎপাদনে একসময় শীর্ষস্থানে থাকা বাংলাদেশে চায়ের নিলাম অনুষ্ঠান হচ্ছে ব্রিটিশ আমল থেকে। দেশের ১৬৪টি চা বাগানে উৎপাদিত প্রায় ৬০ মিলিয়ন চা পাতা চট্টগ্রামের টি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের মাধ্যমে নিলাম হয়। নিলাম অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই চা পাতা বিক্রি করেন চা বাগানের মালিকরা। ছয়টি ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে এই চা নিলাম সম্পন্ন হয়ে থাকে। এখান থেকে চা পাতা কেনার পরই তা দেশে বাজারজাত এবং বিদেশে রফতানি করা হয়। চট্টগ্রামে চা পাতার নিলাম অনুষ্ঠান শুরু হয় বিগত প্রায় ৬০ বছর পূর্বে। এখানে অকশন হাউসের পাশাপাশি টেস্টিং সেন্টার, গোডাউন, গুদাম মিলে নানা ধরনের অবকাঠামো গড়ে ওঠে।
অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত চায়ের ৯৫ শতাংশই সিলেটে হলেও এর আগে এ অঞ্চলে চায়ের নিলাম বাজার স্থাপনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। দেশের ১৬৫টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৩টি সিলেট বিভাগে অবস্থিত। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে ৯১টি চা বাগান। চায়ের সর্বাধিক উৎপাদন সিলেট অঞ্চলে হলেও কোন নিলাম বাজার না থাকায় বাগান মালিকরা উৎপাদিত চা বিক্রির জন্য পাঠান চট্টগ্রাম অকশন হাউসে। এতে একদিকে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়, অন্যদিকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে চায়ের গুণগত মানও নষ্ট হয়ে যায়। সিলেটের চা বাগান মালিকরা এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রায় ৪০ বছর ধরে শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম বাজার স্থাপনের দাবি জানান।
জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫২ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন হয় সিলেট বিভাগে। বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় বিদেশে চা রফতানি অনেকাংশে কমে গেছে। তাছাড়া সিলেট বিভাগের উৎপাদিত চা চট্টগ্রামে নিলাম কেন্দ্রে নিয়ে যেতে প্রতিবছর সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজারের বেশি ট্রাক ভাড়া করতে হয়। পরিবহন, জনবল ও আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় হয় প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে চা বাগান মালিকপক্ষ শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম বাজার স্থাপনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন।
টি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মোঃ ইউসুফ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামে চায়ের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। চা নিলাম এবং বিদেশী ক্রেতাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে চট্টগ্রামে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, নৌপথের অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। চা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, ট্রেডিং সেন্টার, গুদামসহ অন্য লজিস্টিক স্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামে। আকস্মিকভাবে চায়ের নিলাম কেন্দ্র চট্টগ্রাম থেকে শ্রীমঙ্গলে স্থানান্তর করলে চা ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে আসবে। এতে করে চায়ের রফতানি কমে যাবে বলে তিনি দাবি করেন।
তবে চা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিলাম বাজার স্থাপনে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয় এর প্রত্যেকটিই শ্রীমঙ্গলে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের চেয়ে অধিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে শ্রীমঙ্গলে। চায়ের সর্বাধিক উৎপাদন এ এলাকায়। ব্রিটিশ আমলে সমুদ্রপথে রফতানির সুবিধার্থে চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হয় নিলাম বাজার। অভ্যন্তরীণ চাহিদা থেকে যাওয়ায় এখন চা রফতানি ৫ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় চায়ের নিলাম বাজার শ্রীমঙ্গলে হওয়াই যুক্তিযুক্ত। এদিকে চা বাগান মালিকরা জানিয়েছেন, শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম বাজার হলে দেশে চায়ের দাম অনেকটা কমানো সম্ভব হবে। একই বক্তব্য মৌলভীবাজার চেম্বার অফ কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমানে দেশে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফলে বাংলাদেশের চা এখন আর দেশের বাইরে তেমন একটা রফতানি হয় না। বিদেশী ক্রেতারা আসেন না নিলাম বাজারে। এ অবস্থায় চা বাগানগুলোর উৎপাদিত পণ্য নিলামের জন্য চট্টগ্রাম পাঠানোর যৌক্তিকতা নেই। একস্থানে উৎপাদন, অন্যস্থানে নিলাম বাজার রাখার ফলে উৎপাদক মহল দীর্ঘদিন ধরে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক সময় এ অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগান থেকে চট্টগ্রাম পাঠানোর সময় চায়ের পুরো চালান গায়েব হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দীর্ঘদিন থেকে সিলেট অঞ্চলের ব্যবসায়ী, বাগান মালিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সিলেটে নিলাম বাজার স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। স্থানান্তরের যৌক্তিকতা নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণও করা হয়েছে। একদিকে যেমন চায়ের গবেষণা কেন্দ্রসহ দেশের বেশিসংখ্যক চা বাগান সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারে, তেমনি দেশের সিংহভাগ চায়ের উৎপাদনস্থল শ্রীমঙ্গলে চা বোর্ডের সদর দফতর, চায়ের নিলাম বাজার স্থানান্তর করা হলে চা শিল্পের অর্থনৈতিক উন্নতি বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত। এতে লাভবান হবে বাগান মালিকসহ উৎপাদক মহল। যাতায়াতের সহজ ব্যবস্থার ফলে অনেকাংশে খরচও কমে যাবে। এতে ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন।
বাংলাদেশী চা সংসদের চেয়ারম্যান মোঃ সাফওয়ান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, চা সংসদের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিলাম বাজার নিয়ে কথা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, শ্রীমঙ্গলে নিলাম কেন্দ্র হওয়া উচিত। শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম কেন্দ্র হলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষই লাভবান হবেন। পরিবহন খরচ বাঁচবে। তিনি বলেন, এখন সব চা চট্টগ্রামে পাঠাতে হয়। রাজশাহী বা রংপুরের একজন ক্রেতার জন্য চট্টগ্রামের চেয়ে শ্রীমঙ্গলে আসা খুবই সহজ। জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একাধিক চা নিলাম কেন্দ্র রয়েছে। এ বিষয়ে চা বোর্ড তাদের মতামত দিয়েছে। দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রামের পাশাপাশি মৌলভীবাজারেও চা নিলাম কেন্দ্র করা যায়।
এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের ১১ আগস্ট চা বোর্ডের উপ-পরিচালক যুগ্ম সচিব মোঃ আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম বাজার স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই, অকশনের পরিবেশ ও স্থান নির্বাচন, চায়ের গুদামজাতের জন্য বন্ডেড হাউস স্থাপনের সুবিধাসহ নিলামে আসা ক্রেতাদের শ্রীমঙ্গলে অবস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয়টিও বিবেচনায় রেখে পরিদর্শন করে। ওই কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শ্রীমঙ্গলে চায়ের নিলাম কেন্দ্র স্থাপন হবে। তবে এটি হতে পারে দেশের দ্বিতীয় চায়ের নিলাম কেন্দ্র। এদিকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এ উপ-কমিটি করা হয়। দুই মাস পর কমিটির প্রতিবেদন দেয়ার কথা ছিল। কমিটির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে শ্রীমঙ্গলে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ছিল। কিন্তু দুই মাস পার হলেও কমিটি তাদের রিপোর্ট দেয়নি।

No comments

Powered by Blogger.