সংস্কারের সুপারিশ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কমিটি গঠন-নিয়ম মানে না প্রশাসন by আশরাফুল হক রাজীব

নিয়মকানুন-বিধিবিধান মানা হচ্ছে না জনপ্রশাসনে। পদ না থাকার পরও পদোন্নতি হচ্ছে। একদল টাইমস্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পাচ্ছে, তো বেশির ভাগই বঞ্চিত হচ্ছে। দ্রুত স্থায়ী করতে না পারায় অ্যাডহক নিয়োগের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হচ্ছে। সব ক্যাডারে সচিব পদমর্যাদার সর্বোচ্চ এ গ্রেডের একজন কর্মকর্তা থাকার নির্দেশনা জারির ২৭ বছরেও তা কার্যকর হয়নি। এসব সমস্যা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জনপ্রশাসন।
এ কারণে দফায় দফায় নির্দেশনা দিয়েও গতিশীল করা যাচ্ছে না প্রশাসনকে।
প্রধানমন্ত্রীর সামনে এসব সমস্যা তুলে ধরার পর তিনি নিয়ম মেনে প্রশাসন চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে সংস্কারের বিষয়ে সুপারিশ দিতে বলেছেন। এরপর গত ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টাকে প্রধান করে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে প্রশাসন চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। জনপ্রশাসনে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার করতে সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য কমিটি করেছেন। এখন পর্যন্ত কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি, তবে শিগগিরই হবে বলে আশা করছি।'
জানা গেছে, গত জুলাই মাসে বিসিএস সমন্বয় কমিটি ও প্রকৃচি (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জনপ্রশাসনের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। একই ধরনের সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ১৯৯৬-০১ সরকারের মেয়াদে শামসুল হক কমিশন গঠন করেছিলেন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শামসুল হক কমিশনের প্রতিবেদন ধামাচাপা পড়ে। বর্তমান সরকারের প্রথম তিন বছরেও এ কমিশনের প্রতিবেদনের কথা কারো মনে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শামসুল হক কমিশনের প্রতিবেদন চেয়েছেন। একই সঙ্গে জনপ্রশাসনের সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন করে কমিটি গঠন করেছেন। কমিটি সিলেকশন গ্রেড, প্রশাসন ক্যাডারের মতো সুপারনিউমারি (অতিরিক্ত) পদ সৃষ্টি করে ইনসিটিউ পদোন্নতি, অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ ও সরকারি কর্মচারী আইন নিয়ে সুপারিশ দেবে।
জানা গেছে, জনপ্রশাসনে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পদ না থাকার পরও আগের পদে বসে পদোন্নতির সুবিধা পাচ্ছেন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের প্রায় পাঁচ হাজার কর্মকর্তা। কোনো ক্ষেত্রে পদোন্নতি না পেলে সেখানে পাচ্ছেন টাইমস্কেলের সুবিধা। অথচ সমান যোগ্যতা থাকার পরও এ সুযোগ পাচ্ছেন না অন্য ২৭টি ক্যাডারের প্রায় ৬০ হাজার কর্মকর্তা। একই বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে চাকরিতে ঢুকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা যখন গ্রেড-১-এ সচিব, তখন অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা গ্রেড-৫-এ উপসচিবের সমমর্যাদার পদে পড়ে রয়েছেন। পদ না থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে ইনসিটিউ পদোন্নতি পাচ্ছেন, তাও আবার লাইন পদের বাইরে। অন্যদিকে অন্য ক্যাডারের বেলায় লাইন পদে পদোন্নতি দেওয়ার সময়ও পদ নেই বলে বছরের পর বছর একই পদে ফেলে রাখা হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন শাখার জারি করা অফিস আদেশ অনুযায়ী সব ক্যাডারে কমপক্ষে একটি পদ গ্রেড-১ রাখার কথা বলা হলেও তা দীর্ঘ ২৭ বছরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। জনপ্রশাসনে এ ধরনের একচোখা ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সিলেকশন গ্রেড : সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকলেও অনেক সময় তা দেওয়া হয় না। তখন সরকার অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য সিলেকশন গ্রেড বা টাইমস্কেল দিয়ে থাকে। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেডে চাকরির আট বছর পূর্ণ হলে টাইমস্কেল পাচ্ছেন। সরকারি বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমমর্যাদার সব কর্মকর্তার জন্য একই সুবিধা দেওয়ার সাধারণ নিয়ম থাকলেও এ ক্ষেত্রে এ আর্থিক সুবিধা শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পাচ্ছেন। সম্প্রতি কৃষি, কর, ইকোনমিক ক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারের এই একচোখা নীতির বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেন। আদালত আবেদনকারীদের সিলেকশন গ্রেড বা টাইমস্কেল দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় উপযুক্ত সবার জন্য টাইমস্কেল ঘোষণা করেনি। যাঁরা আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন, কেবল তাঁদেরই সিলেকশন গ্রেড বা টাইমস্কেল দিয়েছে।
ইনসিটিউ : জানা গেছে, প্রশাসনে পদ না থাকার পরও পদোন্নতি দেওয়া হয় সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টি করে ইনসিটিউর মাধ্যমে। এ সুবিধা শুধু প্রশাসন ক্যাডারই পেয়ে থাকে। চিকিৎসক, কৃষিবিজ্ঞানীসহ ২৬টি ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তাকেই ইনসিটিউ সুবিধা দেওয়া হয় না। কমিটিকে প্রশাসন ক্যাডারের মতো সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টি করে দ্রুত ইনসিটিউ পদোন্নতির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। প্রশাসনের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে- পদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়া। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পদের চেয়ে অতিরিক্ত পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে, যা আইনের চোখে অপরাধ। কিন্তু সরকার-সমর্থক কর্মকর্তারা সরকারকে বাধ্য করেন তাঁদের পদোন্নতি দিতে। জনপ্রশাসনে উপসচিব পদ রয়েছে ৯৩০টি, অথচ বর্তমানে প্রশাসনে কর্মরত উপসচিবের সংখ্যা এক হাজার ৫২৭। একইভাবে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদেও পদের চেয়ে অতিরিক্ত লোককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনে তিন স্তরে সহস্রাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তিন স্তরের কোনো স্তরেই শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রশাসনে দুটি বড় ব্যাচ কাছাকাছি সময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ ব্যাচ জনপ্রশাসনে সবচেয়ে বড় ব্যাচ। এসব ব্যাচ যখন পদোন্নতির যোগ্য হয়, তখন সবাই তার দাবিদার হয়। আসলে নিয়োগের সময়েই ভুল করা হয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া ঠিক হয়নি। যাই হোক, এসব বড় ব্যাচ সামাল দিতে গিয়ে পদ কম থাকার পরও হয়তো পদোন্নতি দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা হবে না। কারণ এখন যেসব কর্মকর্তা নিয়োগ পাচ্ছেন, তাঁদের ব্যাচের আকার ছোট।
অ্যাডহক নিয়োগ : সরকারি চাকরিতে নিয়োগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিয়োগ দিতে কয়েক বছর লেগে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের অভাবে সরকার যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে না। আবার অল্প সময়ের নোটিশে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে না। তাই বিভিন্ন প্রকল্প, এমনকি রাজস্ব খাতেও অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে এসব জনবল চাকরিতে স্থায়ী করা হয়। এ স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়।
অ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেক সময় বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হয়। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকার কয়েক হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে অ্যাডহক ভিত্তিতে। কিন্তু এর আগের মেয়াদে (১৯৯৬-০১) আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তরা এখনো স্থায়ী হতে পারেননি। অনেক চিকিৎসক চাকরির মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসেও তাঁদের সার্ভিসবুক থেকে অ্যাডহক লেখাটি মুছতে পারেন না। এ অবস্থায় অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের কিভাবে দ্রুত স্থায়ী করা যায়, তার সুপারিশ করতে বলা হয়েছে কমিটিকে।
জনপ্রশাসনে অ্যাডহক সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিএস সমন্বয় কমিটির প্রচার সম্পাদক স ম গোলাম কিবরিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার জরুরি প্রয়োজনে অ্যাডহক নিয়োগ দিচ্ছে। তবে স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় স্বাভাবিক নিয়মে নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠতার সমস্যা সৃষ্টি করছে। ফলে পরবর্তী পদোন্নতির ক্ষেত্রে অ্যাডহক নিয়োগ পাওয়া এবং সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অ্যাডহক নিয়োগের নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
সরকারি কর্মচারী আইন : একটি নির্দিষ্ট আইনের আওতায় সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে সংবিধানে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও সেই আইন প্রণীত হয়নি। আইনের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন বিধি দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয়। ইউএনডিপির সহায়তায় একটি খসড়া আইন চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য তাঁর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তাবিত আইনটিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ অজুহাতে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন থেকে সরে আসে সরকার। সব শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীর জন্য নতুন করে আইনের খসড়া প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুশাসনবিষয়ক ইউনিট। আইনটিতে কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকায় তা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সরকার ইচ্ছা করলে যে কাউকে সচিবসহ যেকোনো পদে নিয়োগ দিতে পারবে। খসড়া আইনের এ ধারা নিয়ে আপত্তি তোলেন জনপ্রশাসনে কর্মরত সব ক্যাডার। একপর্যায়ে ঘোষণা দেওয়া হয় সব ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের। এ টাস্কফোর্স আইনের বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে। গত জুন মাসে এ ঘোষণা দেওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো টাস্কফোর্স গঠন করতে পারেনি। কিন্তু টাস্কফোর্স গঠন না করে সরকার এইচ টি ইমামের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইনের বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা করে সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে।
সরকারি কর্মচারী আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এ আইনে যেভাবে জনবল আউটসোর্সিংয়ের কথা বলা হয়েছে, তাতে সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলে কিছু থাকবে না। এতে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি বাড়বে, দক্ষতা ও মেধার মূল্যায়ন হবে না। অথচ বর্তমান প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে মেধা ও দক্ষতাকে মূল্যায়ন করে জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রেসিডেন্ট, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব। বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভাপতি, মহাসচিবসহ পাঁচজনকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। এ ছাড়া বিসিএস ইকোনমিকের মহাসচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.