বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের সাফল্য by সুজা উদ্দিন

নিয়ম ও মান অভিমান ভেঙ্গে পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারকে এক নৌকায় সওয়ার করানো কঠিন কাজই বলতে হবে। সেটিই এবার করেছিলেন দাবা ফেডারেশনের নতুন কমিটি। এতে সমালোচনাও অবশ্য কম হয়নি। গ্র্যান্ডমাস্টাররাও অকৃজ্ঞ নন। সেটিই বুঝিয়ে দিয়েছেন তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এক্সপ্রো সেন্টারে অনুষ্ঠিত ৪০তম বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে নিজেদের


সেরা সাফল্য দিয়ে। বাংলাদেশ দাবা দলের এ পর্যন্ত এটাই সেরা সাফল্য। বিশ্বে ৩৩তম এবং এশিয়ার মধ্যে সপ্তম, প্রস্তুতিহীন প্রাপ্তিটা কম নয়। সেইসঙ্গে মেয়েরা এনেছেন অভাবনীয় ফল ৫২ তম। বিদেশী কোচের অধীনে প্রস্তুতি নিয়ে অংশ নিলে হয়ত আরও ভাল ফল আসতে পারত। সামান্য কিছু ভুল ও তীব্র লড়াই করে প্রতিটি রাউন্ডের শেষের দিকে হেরে গিয়েছেন দাবাড়ুরা। তবে অনুপ্রাণিত পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার পরের বার নরওয়ে অলিম্পিয়াডে, সেরা দশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। চেষ্টায় যে অনেক কিছুই সম্ভব বাংলাদেশের এ ফলেই তা প্রমাণ করে।
বিচ্ছিন্নভাবে অংশ নিলেও আগে কখনও একসঙ্গে কোন টুর্নামেন্টে অংশ নেননি দেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার। এবার তা সাধন হওয়ায় তাদের প্রতি দেশের মানুষের প্রত্যাশাও একটু বেশি তৈরি হয়েছিল। দেশের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিয়াজ-জিয়ারা দেশ ছাড়ার আগে সেরা ত্রিশে থাকার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন। তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন দেশসেরা দাবাড়ুরা। ১৫৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৩তম হয়েছে, এটাই বা কম কিসে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অবস্থান সপ্তম। ওপেন বিভাগে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতকে পেছনে ফেলেছে। ভারতের অবস্থান ৩৫তম। দাবা অলিম্পিয়াডের ইতিহাসে এটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্থান। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ পুরুষ দল ২০০২ সালের দাবা অলিম্পিয়াডে ৩৪তম স্থান পেয়েছিল। দুই বছর আগে রাশিয়ায় অবস্থান ছিল ৭৩তম। এবার আসরের একাদশ বা শেষ রাউন্ডে পুরুষ বিভাগে বাংলাদেশ দল ২.৫-১.৫ পয়েন্টে বসনিয়া ও হারজেগোবিনাকে পরাজিত করে এ অবস্থান নিশ্চিত করে। পুরুষ দল ১৪ ম্যাচ পয়েন্ট এবং ২৬ গেম পয়েন্ট অর্জন করেন। অপরদিকে বাংলাদেশ মহিলা দল শেষ রাউন্ডে ২-২ পয়েন্টে তুর্কমিনিস্তানের সঙ্গে ড্র করেছে। মহিলা দল ১২ ম্যাচ পয়েন্ট এবং ২৪.৫ গেম পয়েন্ট অর্জন করেছে। মহিলা দল ১২৫টি দেশের মধ্যে ৫২তম স্থান পেয়েছে। ওপেন বিভাগে ১৯ পয়েন্ট করে নিয়ে আর্মেনিয়া চ্যাম্পিয়ন ও রাশিয়া রানার্স-আপ এবং ইউক্রেন ১৮ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হয়েছে। অপরদিকে মহিলা বিভাগে ১৯ পয়েন্ট করে নিয়ে রাশিয়া চ্যাম্পিয়ন, চীন রানার্স-আপ এবং ১৮ পয়েন্ট নিয়ে ইউক্রেন তৃতীয় হয়। বাংলাদেশের পুরুষ দলে ছিলেন পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব। মেয়েদের বিভাগে অংশ নেন আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদ, মহিলা ফিদে মাস্টার জাকিয়া সুলতানা, শামীমা শারমিন শিরিন, নাজরানা খান ইভা, মাহমুদা চৌধুরী মলি। শামীমা আক্তার লিজার পরীক্ষার কারণে তার পরিবর্তে শেষ সময়ে এসে সুযোগ পান জাকিয়া সুলতানা। লিজা দলে থাকলে মেয়েদের ফল হয়ত আরো ভাল হতো।
ওপেন বিভাগে জিয়া ও রাজীব একটু ভাল খেললে অবস্থান আরো সামনের দিকে আসত বাংলাদেশের। জিয়া ৯ খেলায় অংশ নিয়ে চারটিতে জয়, সমান খেলায় হার ও একটিতে ড্র করেছে। রাজীবের চার জয় ও ৩টি করে ড্র ও হার। সে হিসেবে ভাল করেছেন রিফাত বিন সাত্তার ও আবদুল্লাহ আল রাকিব। রিফাত ৬টিতে অংশ নিয়ে ৫টিতেই জয় পেয়েছে, একটিতে ড্র করেছেন। রাকিবের ১০ খেলায় ৭টিতেই জয়। একটিতে ড্র ও হার দুইটিতে। দেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ চারটিতে জয় পেয়েছেন ও চারটিতে ড্র করেছেন, হেরেছেন একটিতে। কোচ না থাকা ও অনুশীলন না করে অনিয়মিত অংশগ্রহণের ফল বাংলাদেশ ভোগ করেছে হাড়ে হাড়ে। জয় দিয়ে শুরু করলেও ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি। পাপুয়া নিউগিনিকে ৪-০তে হারিয়ে টুর্নামেন্টে যাত্রা শুরু করে পুরুষ দল। কিন্তু ১১ রাউন্ডের মধ্যে মোজাম্বিক (৪-০), ইরাক (৩ ১/২- ১/২), জাম্বিয়া (৩-১), থাইল্যান্ড (৩ ১/২- ১/২) এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে (২ ১/২-১ ১/২) হারাতে সমর্থ হয়। ড্র করেছে পেরু (২-২) ও ডোমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গে। হেরেছে চ্যাম্পিয়ন আর্মেনিয়া (০-৪), বেলারুশ (১-৩) ও তুর্কেমেনিস্তানের (১/২-৩ ১/২) কাছে। তারপরও এ অর্জনকে সম্মানজনকই ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের এ সাফল্যে দেশের মানুষের সাথে দাবাড়ু ও কর্মকর্তারাও খুশি দেশের সম্মান বয়ে আনার জন্য। দলের নৈপুণ্যে দারুণ সন্তুষ্ট গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। ইস্তাম্বুল থেকে এক সাক্ষাতকারে এ কৃতী দাবাড়ু অনেকটা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জানান, ‘আমরা আগেই বলেছিলাম, এবার ত্রিশের ঘরে থাকার চেষ্টা করব। সেই চেষ্টাটাই সফল হয়েছে। কাছাকাছি থাকতে পেরেছি। টুর্নামেন্টের প্রথম দিকে কেন যেন ভয় লাগছিল। এ কারণে ভাল করতে পারছিলাম না। তবে শেষ দিকে এসে উন্নতি করেছি।’ এক্ষেত্রে ফেডারেশনের নতুন কর্মকর্তারাও তাদেরকে উৎসাহিত করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি

No comments

Powered by Blogger.