সংলাপ নিয়ে তৎপরতা-সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি কাম্য নয়

সংসদ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে জনমনে উদ্বেগ ততই বাড়ছে। ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, এই উদ্বেগের কারণও অনেকটা তেমনি। ২০০৬ সালে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক সংঘাত কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতে পারে। লগি-বৈঠা, লাঠি-বাঁশের সংঘর্ষের রাজনীতির পরিণতি কী হতে পারে, তাও আমরা দেখেছি।


আলাপ-আলোচনা, সংলাপ-সমঝোতা আমাদের রাজনীতি থেকে একরকম নির্বাসিত। আর তার জায়গা দখল করে নিয়েছে 'দেখে নেওয়া'র রাজনীতি। গণতান্ত্রিক রাজনীতি কেবল মুখের কথায় আটকে আছে। তার জায়গায় চলছে পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, আঘাত-প্রত্যাঘাত ও চূড়ান্ত রকমের অসহনশীলতা। এ অবস্থায় শুধু যে বাংলাদেশের মানুষই উদ্বিগ্ন তা নয়, বাংলাদেশের উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে। অতীতের মতো আবারও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমনি একটি উন্মাতাল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের অনমনীয় অবস্থান- আমাদের আবারও একটি অশান্ত পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে না হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। অথচ তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এটা অনস্বীকার্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তাদের অবস্থানে অনেকটাই অনড়। মাঝেমধ্যে নির্দলীয় সরকারের কথা বললেও তার রূপরেখা কী হবে- সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মতবিরোধ ও মতপার্থক্য থাকবেই। অনেক মতের প্রতিফলনই হচ্ছে গণতন্ত্র। আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, বহু মতের নূ্যনতম ঐক্যের ভিত্তিতে দেশের জন্য কল্যাণকর মতটিকে বেছে নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অসহনশীলতার কোনো স্থান গণতন্ত্রে নেই। কিন্তু বাস্তবে আমাদের রাজনীতিতে সেই গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার অভাবটাই বড় বেশি প্রকট। 'কেউ কারো ছায়া মাড়াবেন না' ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেবল একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে যাচ্ছেন। সংলাপ-সমঝোতার পথে বিরোধ নিরসনের আন্তরিক ইচ্ছা কারো ভেতরেই লক্ষ করা যায় না। প্রধান সমস্যাটা এখানেই। আর এ কারণেই বারবার আমাদের রাজনীতি সংঘাতমুখর হয়ে ওঠে। আমাদের সচেতন নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে, নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে প্রধান দুটি দলকে আলোচনার টেবিলে বসানোর জন্য। এবং সংলাপের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় আসার জন্য। কিন্তু তাদের সেসব উদ্যোগে এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি সূচিত হয়নি। একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকরাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিংবা রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের সরব উপস্থিতি সেই দেশের জন্যই সম্মানজনক নয়। কিন্তু আমরাই তো সে পরিস্থিতি তৈরি করে দিচ্ছি। এ দেশে অনেক দেশেরই শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। সেই সঙ্গে সেসব দেশের নাগরিকদের স্বার্থ জড়িত। কাজেই দেশের রাজনৈতিক জটিলতা নিরসনে তাঁরা উদ্যোগী হতেই পারেন।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণচিন্তা থেকেই তা করেন। তাঁরা জানেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি দেশকে উন্নয়ন এবং দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানকে কতটা পশ্চাতে ঠেলে দেয়। কাজেই তাঁরা গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখতে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ উন্নয়নে সচেষ্ট হবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা আশাবাদী, জটিলতা নিরসনের উদ্যোগগুলো কোনো না কোনোভাবে ফলপ্রসূ হবেই এবং সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আমরা রক্ষা পাব।

No comments

Powered by Blogger.