ইনিয়েস্তার বাজিমাত by ফারজানা আক্তার সাথী

কি জাতীয় দল, কি ক্লাব সব জায়গাতেই তাঁর গুরুত্ব সমান। দুর্দান্ত মিডফিল্ডার, ডি বক্সের বাইরে বল নিয়ে কারিকুরি, নিখুঁত ক্রস, কখনও প্লে মেকিংয়ের দায়িত্ব, আবার মাঝে মধ্যে হুট করে স্ট্রাইকার হিসাবে আবির্ভূত হওয়া। ফলে ঠিক বোঝা মুশকিল কোন্ জায়গাটা আসলে তাঁর জন্য বরাদ্দ। মিডফিল্ডার হিসাবে তাঁর পরিচিতি।


তবে আসল পরিচয় এ্যাটাকিং মিডফিল্ডারই। বল নিয়ে ছান্দসিক ছুটে চলা, ডিফেন্ডারদের চোখ বিভ্রমে ঢেকে দেয়া, আর কৌশলী ঢঙ্গে বল নিয়ে বাঁক খাওয়ানোতে ওস্তাদ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বার্সিলোনার অন্যতম এক তারকা ফুটবলার। তার চেয়েও বড় পরিচয়টা হয়ত জাতীয় দল স্পেনের হয়ে। কারণ বার্সিলোনার মতো স্পেনের হয়েও তাঁর কৃতিত্ব অনেক বেশি। স্পেনকে জিতিয়েছেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ, যেখানে ফাইনাল ম্যাচে তিনিই ছিলেন জয়ের নায়ক। দুই বছর পর ইউরোতেও তাই। শিরোপা জিতিয়েছেন দলকে, হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়; পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন গোল্ডেন বল। তবে সম্প্রতি একটি পুরস্কার বেশি আলোকিত করেছে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে। যেখানে মেসি-রোনাল্ডোর মতো ফুটবলারকে পেছনে ফেলে তিনি জিতেছেন ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব। বাজিমাত করেছেন সবাইকে অবাক করে দিয়ে। বিষয়টি সবার চোখে বিস্ময় এঁকে দিয়েছে। সবার মতো বিস্মিত খোদ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাও। তালিকায় ছিলেন লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো তারকা ফুটবলাররা। তাঁদের পেছনে ফেলে ইউরোপ সেরার পুরস্কার জেতা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে বাস্তবে সেই কাজটিই করেছেন স্পেনের তারকা মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। গত মৌসুমে তালিকায় যেখানে ছিলেন চতুর্থ, এবার মেসি-রোনাল্ডোকে পেছনে ফেলে ইউরোপের বর্ষসেরা ফুটবলার তিনিই। অনন্য এ অর্জনে রীতিমতো বিস্মিত বার্সার তারকা এই ফুটবলার। বলেছেন, আমি ভাবতেও পারিনি এমনটিই হবে। তবে এই আনন্দ ছুঁয়ে গেছে সতীর্থ লিওনেল মেসির মনও। পুরস্কার হাতে পাবার পর তিনি ইনিয়েস্তাকে জড়িয়ে ধরে অভিবাদন জানিয়েছেন পরম উষ্ণতায়। ৩৫ জনের তালিকা থেকে শর্ট লিস্টে উঠে আসা ইনিয়েস্তা ধরে রেখেছিলেন পুরস্কার যাবে মেসি কিংবা রোনাল্ডোর ঘরে। কারণ গেল মৌসুমে ক্লাব পর্যায়ে তাঁদের তুখোড় নৈপুণ্য ছিল দেখার মতো। তবে ৫৩ সাংবাদিকের তাৎক্ষণিক ভোট পাল্টে দেয় সবকিছু। গেল ইউরোতে স্পেন দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য শ্রেষ্ঠত্বের তকমা গায়ে লাগে ইনিয়েস্তারই। সাংবাদিকদের প্রদত্ত ভোটে ইনিয়েস্তার ভোটসংখ্যা যেখানে ছিল সর্বোচ্চ ১৯টি, সেখানে মেসি-রোনাল্ডোর প্রাপ্ত ভোট ছিল ১৭টি। গতবার এ পুরস্কার জিতেছিলেন লিওনেল মেসি। আগে এ পুরস্কারের নাম ছিল ব্যালন ডিঅর। গতবার থেকে ফিফার সঙ্গে ব্যালন ডিঅর এক হয়ে যাওয়ায় নতুন করে ইউরোপ সেরার পুরস্কার প্রচলন করে উয়েফা। পুরস্কার হাতে পাবার পর ইনিয়েস্তার অভিব্যক্তি ছিল আবেগমথিত। বিস্মিত কণ্ঠে বলেন, ‘এটা কি আমারই? আমি কি এটা রাখতে পারি। আমি সত্যি এটাকে যত্ন করে রাখব। আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কেউ যদি কোন কথা না বলে, তাহলে এটি আমি নিজের করেই নেব। এটার জন্য আমি ঝামেলায় পড়তে চাই না, আমি কি পারি? এই পুরস্কার আমি চ্যারিটি কিংবা কোথাও দান করে দেয়া উচিত। সেটা নিজের ভালর জন্যই।’ আরও মজা করে ২৮ বছর বয়সী ইনিয়েস্তা বলেন, ‘আমি যে ট্রফিটা পেলাম তার হাত বা মাথা কিছুই নেই। এটা কি আমিই ভেঙ্গে ফেলেছি নাকি উয়েফাই দেয়নি। আশা করি উয়েফা ট্রফিটা ঠিকঠাক করে দেবে। আমি এখন বাড়ি যেতে চাই। কেউ আমার পরিবারকে বলুক আমি যেতে চাই নিজ ঘরে।’ বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ইনিয়েস্তা বলেন, ‘এই পুরস্কার পেয়ে আমি খুবই খুশি। বার্সিলোনা ও স্প্যানিশ জাতীয় দলের সতীর্থদের উদ্দেশে পুরস্কারটি উৎসর্গ করছি।’ মেসি-রোনাল্ডোর মতো গোল বেশি হযতো পান না ইনিয়েস্তা, তবে মিডফিল্ডার হিসাবে দুর্দান্ত গোল তৈরির কারিগর তিনি। আর মাঝে মধ্যে করে থাকেন নজর কাড়া কিছু গোল। গত মৌসুমে বার্সার হয়ে ৪৭ ম্যাচে ৮ গোল করেছিলেন তিনি। সেখানে মেসির গোলসংখ্যা ছিল সব মিলিয়ে ৭৩, যা বিশ্ব রেকর্ড। আর রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর গোল ছিল ৬০টি। তবে শুধু গোল নয়, ক্লাব ও জাতীয় দলের পারফরমেন্স মিলিয়েই আসল বাজিমাতটা করেন ইনিয়েস্তাই। পুরস্কারের ক্ষেত্রে ইনিয়েস্তার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি এটাই। এর আগে অবশ্য ফিফা ব্যালন ডিঅরের চূড়ান্ত তালিকায় পুরস্কারের খুব কাছাকাছি গিয়েও হতাশ হতে হয়েছিল তাঁকে মেসির কারণে। বিশ্বকাপ জয়ের বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তিনি। সবাইকে টপকে এ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন মেসি। আর তৃতীয় স্থানে ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের পর্তুগিজ উইঙ্গার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভালই করেছিলেন। ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে ছিলেন চতুর্থ স্থানে। এবারও পুরস্কার জেতেন মেসি। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন রোনাল্ডো। আর তৃতীয় স্থানে ছিলেন ইনিয়েস্তার ক্লাব সতীর্থ জাভি হার্নান্দেজ। তবে অবশেষে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতে পেরেছেন ইনিয়েস্তা। ফিফার বর্ষসেরা না হলেও ইউরোপ সেরার তকমাটা লেগেছে তাঁর গায়ে। এছাড়া ক্লাবপর্যায়ে অনেক পুরস্কারই পেয়েছেন ইনিয়েস্তা। লা লীগায় সেরা স্প্যানিশ খেলোয়াড়ের পুরস্কার তিনি জিতেছিলেন ২০০৯ সালে। সেরা এ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের খেতাব পেয়েছিলেন ২০০৯ ও ২০১১ সালে। বছরের সেরা গোলের পুসকাস এ্যাওয়ার্ডে দ্বিতীয় হয়েছিলেন ২০০৯ সালে। গেল ইউরোতে তাঁর সফলতা বেশি। সর্বোচ্চ চারটি ম্যাচে ম্যাচ সেরার পুরস্কার বগলদাবা করেছেন ২৮ বছর বয়সী এই ফুটবলার। আর তাই নিজে না পেলেও ক্লাব সতীর্থের কাছে উয়েফা বর্ষসেরা এ্যাওয়ার্ড যাওয়াতে বেশ খুশি লিওনেল মেসি। নিজে না পেলেও আফসোস নেই আর্জেন্টাইন এই তারকা ফুটবলারের। ইনিয়েস্তার প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, ‘বড় মাপের ফুটবলার ইনিয়েস্তা। ওর মাঠে উপস্থিতি মানেই সতীর্থদের জন্য বাড়তি আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা। ডি বক্সের কাছাকাছি খুবই বিপজ্জনক ও। ভাল লেগেছে পুরস্কারটি ওই পেয়েছে। নিজে পাইনি, ন্যূনতম আফসোস নেই।’ মাঠের বাইরের প্রসঙ্গ টেনে মেসি বলেছেন, ‘মানুষ হিসাবেও চমৎকার ইনিয়েস্তা। সতীর্থদের প্রতি খুবই আন্তরিক সে। অমায়িক মনের মানুষ সে।’

No comments

Powered by Blogger.