মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-ঝাড়ুয়ারবিল বধ্যভূমি আজহারের গণহত্যার নীরব সাক্ষী by ছাইদুল হক সাথী

রংপুরের বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝাড়ুয়ারবিল বধ্যভূমি; যেখানে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তৎকালীন ছাত্রসংঘের নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় গণহত্যা চালান। প্রায় ১২০০ নারী-পুরুষকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।


এ ছাড়া তাঁর নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা রংপুর নগরের দমদমা এলাকায় ঘাঘট নদীর তীরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে কারমাইকেল কলেজের ছয় শিক্ষক ও এক শিক্ষকপত্নীকে। শহীদ শিক্ষকরা হলেন রসায়ন
বিভাগের প্রভাষক কালাচাঁদ রায় ও আব্দুর রহমান, গণিতের প্রভাষক চিত্তরঞ্জন রায়, দর্শনের প্রভাষক সুনীল বরন চক্রবর্তী, বাংলার প্রভাষক রামকৃষ্ণ অধিকারী, উর্দু বিভাগের শাহ সোলায়মান আলী ও কালাচাঁদ রায়ের স্ত্রী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত প্রতিবেদনে এ টি এম আজহারুল ইসলামের সেই নির্মম নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুুটপাটসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা বেরিয়ে আসে। এর পরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে ঢাকায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজহারুল ইসলামকে গত বুধবার মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর বদরগঞ্জে ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। গতকাল বৃহস্পতিবারও তাঁরা বিক্ষোভ মিছিলের চেষ্টা চালান।
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আজহারের বাড়ি বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়া ইউনিয়নের বাতাসন গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নাজির হোসেন। বদরগঞ্জে জামায়াতের একটি কার্যালয় থাকলেও গোপনে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় পৌর শহরের বালুয়াভাটা এলাকায় আজহারের বাড়ি থেকে। ওই বাড়িতে ছাত্রশিবিরের একটি গ্রুপ সব সময় অবস্থান করে। আজহার ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল পৌর শহরে তাঁর বাসভবন-সংলগ্ন একটি ইসলামী কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কর্মিসভা করেন।
জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশে ফিরে আসেন এ টি এম আজহারুল ইসলাম। ১৯৭৭ সালে সক্রিয় হন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৯৬ সাল থেকে এযাবৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে প্রার্থী হয়ে তিনি জামানত হারিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধা প্রমথ সূত্রধর জানান, এ টি এম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী বদরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা চালায়। এ সময় হানাদাররা ওই ইউনিয়নের ঝাড়ুয়ারবিল ও পদ্মপুকুরে একই সঙ্গে প্রায় ১২০০ মানুষ হত্যা করে। সন্তানহারা শত শত মায়ের দীর্ঘশ্বাস কালের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকলেও দেশের মানুষ আজও জানতে পারেনি ওই গণহত্যার কাহিনী। অথচ সেই ঝাড়ুয়ারবিল বধ্যভূমি এখন নিশ্চিহ্নপ্রায়। কয়েক বছর ধরে সেখানকার মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইটখোলায়।
একাত্তরে নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যাপক মেছের উদ্দিন জানান, রংপুর আলবদর বাহিনীর কমান্ডার এ টি এম আজহারের নেতৃত্বে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বাচ্চু খাঁ ও কামরুজ্জামানের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাড়ুয়ারবিল ও পদ্মপুকুরে গণহত্যা চালায়। তারা রামনাথপুর ইউনিয়নের কিসমত ঘাটাবিলের কোনাপাড়া, মণ্ডলপাড়া, গয়দাপাড়া, কুটিরপাড়া, খিয়ারপাড়া, খলিশা হাজীপুরের পাইকারপাড়া, তেলীপাড়া, বাজারপাড়া, বানিয়াপাড়া ও কামারপাড়ায় গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ ছাড়া রাজাকার, আলবদর বাহিনী রামকৃষ্ণপুরের মাষাণডোবা, সরকারপাড়া, খিজিরেরপাড়া, মধ্যপাড়া, বালাপাড়া, বিত্তিপাড়া, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বুজরুক বাগবাড়, মণ্ডলপাড়া, দোয়ানী হাজীপুর, সর্দারপাড়াসহ অনেক বসতিতে গণহত্যা চালায়।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক অধ্যাপক মো. আফজাল হোসেন প্রামাণিক জানান, ঘটনার দিন পথেঘাটে যেখানে সেখানে মানুষের লাশ পড়ে ছিল। চাপ চাপ রক্তের ওপর উবু হয়ে পড়ে ছিল অনেকেই। ঘরবাড়িগুলোতে জ্বলছিল আগুন। দু-চারজন বৃদ্ধ মানুষ ছাড়া এলাকায় কাউকে দেখা যায়নি। বানিয়াপাড়ার মেনহাজুল বিএসসি, হিন্দুপাড়ার প্রাণকৃষ্ণ স্যারকে হত্যা করা হয়েছে। বাচ্চু খাঁ, কামরুজ্জামান ও আজহারের তাণ্ডবলীলায় লাল হয়েছিল ঝাড়ুয়ারবিল ও পদ্মপুকুরের পানি।
এদিকে এ টি এম আজহারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করায় বদরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আনন্দ মিছিল করেছেন। বদরগঞ্জ থানার ওসি পৃথ্বীশ কুমার সরকার বলেন, বদরগঞ্জ জামায়াতের মিছিলসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.