হীরণের একাত্তর by মাশ্হুদা মাধবী

শীতের শেষে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ানো আদ্যিকালের বয়সী আমগাছটা প্রতিবারের মতোই ভরে গিয়েছিল অজস্র সোনালি মুকুলে। বারান্দাজুড়ে শীতের রোদ্দুর আলো ছড়ালে খদ্দরের আলোয়ানে মোড়ানো হীরণ বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গুটিসুটি মেরে বসলে তার একাকী সময় ঠিকই বয়ে যায় তরতর।


আরও আগে ভোরসকালে মা হাসপাতালে ডিউটিতে যাওয়ার আগে নিয়মমতোই ডেকেছেন—ওঠ বাবা, এই রইল নাশতা। খেয়ে পড়তে বস। হীরণের মনে তখন প্রশ্নের আনাগোনা—আচ্ছা, হীরা-চুনি তো নিয়মিত পড়তে বসে, তবে আমি কেন এমন হয়ে গেলাম? বিষণ্ন হীরণ খোলা জানালার ওপারে পড়ে থাকা মাঠের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মেঠোপথে হাঁটতে থাকা সাদা শাড়ি মোড়ানো মায়ের শীর্ণ অবয়ব আর মলিন মুখ দেখত একমনে।
মন খারাপ হলেও কিছু পরে মাকে আর দেখাই যেত না। এভাবে প্রতিদিন মায়ের কাজে যাওয়া ভালো লাগত না হীরণের। আগে এমনটি ছিল না। মা সারা দিন বাড়িতেই থাকতেন তাঁর প্রিয় সংসার আগলে। কিন্তু এখন বাবাহীন এ সংসারে কত কিছুই তো বদলে গেছে।
হাসি-খুশি প্রাণবন্ত সংসার অন্তঃপ্রাণ বাবা হঠাৎ হারিয়ে গেলেন ঊনসত্তরে। গণ-অভ্যুত্থানের অথই জোয়ারে যখন চারদিক থইথই, তখন আচমকা বুকের বাঁ পাশে তীব্র ব্যথায় মুহূর্তে ঢলে পড়েন তিনি। হাসপাতালে নেওয়ারও সময় দেননি।
আর তখন থেকেই হীরণের বদলে যাওয়া। বিষণ্ন হীরণের স্মৃতি-উপচানো কত ছবি। বাবার হাত ধরে পদ্মাপাড়ে সূর্যাস্ত দেখার দিনগুলো শেষ হলেও সেসব স্মৃতি অশেষ।
এখনো কত স্মৃতির আনাগোনা। কখনো গভীর রাতে কোনো খোলা প্রান্তরের বাতাস চুপি চুপি গায়ে মেখে বা অচিন ধানখেতের গন্ধ নাকে নিতে নিতে হীরণ ভাবে কত কিছু। এখন তার হাতে অস্ত্র। আর বুকপকেটে মাকে লেখা চিঠি...মা, অনেক দুঃখ তোমার। তোমাকে না জানিয়ে চুপটি করে চলে এসেছি যে! এই তো দেশ স্বাধীন করেই ফিরে যাব আবার। ঠিকঠাক লেখাপড়া করব, ভেবো না মা। ইতি—তোমার হীরণ (দূরগাঁয়ে কৃষকের কুঁড়েঘর থেকে)।
তখন মা কাজে বেরোনোর আগেই তো হীরা-চুনি স্কুলে চলে গিয়েছে প্রতিদিনের মতো। আর তখনো বিছানায় আধো ঘুমে হীরণের কানে আসে—জাগ এখন বাবা। হীরণ, আজ কিন্তু তুমি স্কুলে যাবা। তোমাদের বাবা নেই। তুমি লেখাপড়া শিখে বড় চাকরি পেলে তো আমাদের কষ্ট ফুরাবে। তাই না?
মা বোঝেন না, এখন স্কুলে যেতে তার আগের মতো ভালো লাগে না। বরং তাকে অবিরাম হাতছানি দেয় পদ্মাপাড়, লাল গির্জার সামনের খোলা মাঠ, পদ্মার চরের সবুজ ছোট ছোট ঝাউগাছ, চৈত্রদিনের বা ফাল্গুনের পলাশ, শিমুল বা মান্দার। সবকিছু বাবার হাত ধরে দেখার বা ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলোর স্মৃতিই তার ভালো লাগে।
সব প্রিয় কিছুই এখন হীরণের অন্তহীন স্মৃতি। আর স্মৃতিতেই চলে আসে একাত্তর। রক্তভেজা আর ঝরাপাতার উল্লাস চৈত্রদিনের বেলা। তখন তাদের শহর থেকে কতজন চলেছে মুক্তিযুদ্ধে! নানা বয়সের মানুষ সীমান্ত পার হয়ে যাচ্ছে। হীরণের কি বসে থাকা মানায়? মাঝ এপ্রিলের নিশুতি এক রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে, তখন বাড়ি ছাড়ল সে। রেখে গেল চিঠি—মা, বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তোমার অনেক দুঃখ আর কষ্টের বোঝা। তা হয়তো আমি আরও বাড়িয়ে দিলাম। আবার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসবে তোমার হীরণ। লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী। ১২ এপ্রিল, ১৯৭১।
তারপর তো হীরণের যুদ্ধ শেখার আর যুদ্ধ করার দিন। তবু কখনো আনমনা হয় স্মৃতিকাতর কিশোর। যেন সেই আগের দিনে তারা। বাবা বেঁচে—তাদের আগের সেই ভাড়াবাড়ির বিশাল বাগানে কত ফুল...। আনন্দে ভাসা দিনরাত্রি। তারপর এখনকার ছোট্ট দুই রুমের বাড়ি। শেওলাপড়া কুয়োতলার শীতল অন্ধকার—মায়ের ছোট চাকরি জুটিয়ে নেওয়া—নইলে সংসার চলবে কী করে! হীরা-চুনি আর হীরণকে বড় করতে হবে তো!
আর এখন শেষ অগ্রহায়ণের কুয়াশামাখা শিশিরভেজা মাঝরাত্রির হলুদ সরষেখেতের মাঝে মুক্তিপাগল কিশোর যোদ্ধা হীরণ। নির্ভীক যোদ্ধার হাতে তাক করা অস্ত্র আর বুকপকেটে মাকে লেখা চিঠি। শত্রুদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ—দ্রিম, দ্রিম..., ঠা, ঠা..., দ্রুম, দ্রুম...
আনমনা হয় হীরণ। এবারও কি মুকুলে ভরে গেছে ছোট আমগাছটি? মায়ের সাদা শাড়ি... সরু পায়ে চলা পথ...হীরা-চুনি...বাবা...পদ্মাপাড়...রক্তপলাশ...লাল মান্দার...আর কিছু ভাবা হয় না তার। বুকপকেটের চিঠি ভিজিয়ে তখন ঝরছে হীরণের তামা রক্ত...।

No comments

Powered by Blogger.