চরাচর-নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস by তামান্না ইসলাম অলি

আজ ২৪ আগস্ট। কেউ কেউ হয়তো ভুলে গেছি ১৯৯৫ সালের এই দিনটির কথা। ভুলে গেছি দিনাজপুরের ইয়াসমিনের কথা। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই পুলিশরা ধর্ষণ করেছিল ইয়াসমিনকে। শুধু ধর্ষণই নয়, হত্যা করেছিল তাকে।


আর তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের সব শ্রেণীর মানুষ বিক্ষোভ মিছিল বের করেছিল। পুলিশ গুলি চালিয়েছিল সেই মিছিলের ওপর। ঝরে গিয়েছিল আরো সাতটি তাজা প্রাণ। আর কোনো ইয়াসমিন যেন নির্যাতনের শিকার না হয়, সে জন্য প্রতিবছর এই দিনটি স্মরণ করা হয়। পালন করা হয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে।
ইয়াসমিনের বয়স ছিল ১৪ বছর। বাড়ি দিনাজপুরের রামনগরে। বাবা ছিল না সংসারে। অভাবের কারণে তাকে কাজ করতে হতো ঢাকায় ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে। কিন্তু মাকে ছেড়ে থাকতে তার ভালো লাগত না। বাড়ি যেতে চাইলে গৃহকর্তা জানায়, পূজায় ছুটি দেবে। কিন্তু ইয়াসমিনের মন কিছুতেই মানে না। তাই একদিন বাসার বাচ্চা ছেলেটাকে স্কুলে দিয়ে কাউকে কিছু না বলে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। সেই দিনটি ছিল ১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট। দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওগামী নৈশ কোচে উঠে পড়ে সে। বাসটি দিনাজপুর শহরে যায় না বলে তাকে দশমাইল এলাকায় নামতে হয়। সেখান থেকে আরেকটি গাড়িতে উঠতে হবে। দশমাইলে যখন নামে, তখন রাত সাড়ে ৩টা। চারদিকে অন্ধকার। যাত্রাপথের সংযোগ এলাকা বলে এখানকার কিছু দোকান সারা রাত খোলা থাকে। গাড়ির সুপারভাইজার একজন চা দোকানদারকে অনুরোধ করে ইয়াসমিনকে দিনাজপুরের কোনো বাসে তুলে দেওয়ার জন্য। ইয়াসমিনের সঙ্গে আরেক যাত্রী জয়ন্তও নামেন। তাঁর বাড়িও দিনাজপুরে। তিনি ইয়াসমিনকে পেঁৗছে দিতে চান। কিন্তু জয়ন্তর সঙ্গে যেতে দিতে কেউ ভরসা পায় না। কিছুক্ষণ পর সেখানে একটি পুলিশ টহল ভ্যান এসে থামে। পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করে বিব্রত করে। একপর্যায়ে তারাই পেঁৗছে দেবে বলে জানায়। ধমকে পুলিশ সদস্যরা তাকে জোর করে ভ্যানে ওঠায়। তারা দশমাইলের আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে নিয়ে যায়। সেখানে একের পর এক ধর্ষণ করে। পরে হত্যা করে গোবিন্দপুর ব্র্যাক অফিসের সামনে ফেলে দিয়ে যায়। ভোরে সবাই ইয়াসমিনকে মৃত অবস্থায় পায়। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের মানুষ। আদালতে মামলা হয়। তিনটি আদালতে ১২৩ কার্যদিবসে বিচার শেষ হয়। রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ রায় ঘোষণা করেন ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট। রায়ে পুলিশের এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার ও চালক অমৃতলাল বর্মণকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
ইয়াসমিনের মৃত্যু হয়েছে আজ ১৭ বছর। এর মধ্যে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রতিটি ঘটনাই যেন আগেরটির ধারাবাহিকতা। কারণ আর কিছু নয়, দোষীদের ছাড়া পেয়ে যাওয়া; যদিও সাধারণ মানুষ সোচ্চার। ইয়াসমিনের মতো ঘটনা যেন আর না ঘটে সে জন্য তার মৃত্যুদিনটিকে তারা পালন করছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। তার পরও নির্মূল হচ্ছে না নারী নির্যাতন। ইয়াসমিনের পেছনে মৃত্যুর লাইনে নাম লিখিয়েছে তানিয়া, সীমা চৌধুরী ও সিমিরা।
তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.