বহে কাল নিরবধি-শেষাঙ্কের দিকে অগ্রসরমাণ সিরীয় নাটক by এম আবদুল হাফিজ

প্রতিটি বিপ্লবেই একটি সময় উপনীত হয়, যখন তার তরঙ্গাঘাত ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ আঘাত হানে। মিসরে গত বছরের ২৮ জানুয়ারিতে তা ঘটেছিল, যখন বিক্ষোভকারীরা কায়রোর তাহরীর স্কয়ার দখলে নেয় এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে।
লিবিয়ায় সেটা ঘটেছিল কয়েক মাস পর ২০ আগস্টে, যখন রাজধানী ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। সিরিয়ায় এমনটা ঘটে থাকতে পারে গত ১৮ জুলাইয়ে, যখন সিরিয়ার সামরিক কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। যদি এই বোমা হামলা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার ভারসাম্যকে পাল্টে দিতে পারে, তা অভিপ্রেত বিধায় অভ্যর্থিতই হবে। কিন্তু লক্ষণীয় যে বিপ্লবের এক বছর বা এরও অধিক সময় পরও মিসর ও লিবিয়া এখনো অস্থিতিশীল।
সিরিয়ার ক্ষেত্রে এমন অস্থিতিশীলতা বিদ্রোহীদের জয় সত্ত্বেও আরো জটিল হতে পারে দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। সিরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে এক প্রচণ্ডভাবে বৈরী ইসরায়েলসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক, লেবানন এবং অনারব প্রতিবেশী তুরস্কের, যা তাকে পরিণত করেছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল এবং ভরকেন্দ্রিক অংশে। তাই সিরিয়ার শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুধু আসাদের পতন নিয়ে ভাবলেই হবে না, দৃষ্টিপাত করতে হবে আসাদ-পরবর্তী সিরিয়াকে একটি বিস্ফোরণোন্মুখ অঞ্চলে বিপ্লবোত্তর দেশটিকে নৈরাজ্য, সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতা থেকে অব্যাহতি দিতে কৌশল নির্ধারণের ওপর।
দামাস্কাসে সদ্য সংঘটিত বোমা হামলা_তাও আবার নিরাপত্তা সদর দপ্তরে, একাধিকভাবে আসাদ সরকারকে দুর্বল করে থাকবে। কেননা এই হামলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আহত হওয়া ছাড়াও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং একজন সাবেক সেনাপ্রধান নিহত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের জন্য আরো মর্মান্তিক হয়েছে, তাঁর ভগ্নিপতি এবং সরকারের একটি স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত আসেফ শওকাতের মৃত্যু। যদিও প্রেসিডেন্ট অতি দ্রুতই অন্যদের তাঁদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন; কিন্তু তাতে বোমা হামলায় যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা পূরণ প্রায় অসম্ভব। যে দেশটি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দ্বারা নিছক ব্যক্তিগত সখ্য ও আনুগত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, সেখানে হামলায় নিহতদের শূন্যস্থান পূরণ করা যাবে না।
এ ছাড়া যেহেতু এই হামলাকে অন্দরমহলেরই ষড়যন্ত্রের অংশ ভাবা হচ্ছে, নতুন করে স্থলাভিষিক্তরাও একই রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারেন। বোমা হামলার তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণে বোঝা যায়, এই হামলার জন্য যে গোয়েন্দা তথ্যের প্রয়োজন এবং অন্দরমহলে হামলাকারীদের যে অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকার থাকার কথা, সেটা কোনো বহিরাগত হামলাকারীর পক্ষে অর্জন করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং এ কথা পরিষ্কার, ঘটনাটি ছিল আন্তগোষ্ঠী বিভেদে কোনো একটি গোষ্ঠীরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তবে যেভাবে যার দ্বারাই হামলা সংঘটিত হয়ে থাকুক না কেন, এতে করে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা নিরাপত্তাব্যবস্থার কমান্ড কাঠামো ও সংশোধনের অতীব এক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার পুনঃপ্রতিস্থাপন দুরূহ ও কষ্টসাধ্য।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সিরিয়ায় বরাবরই ছিল প্রেসিডেন্টের নিজস্ব ধর্মীয় গোষ্ঠী আলাউইট সম্প্রদায়ের লোক, তবে সাধারণ সৈনিকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল সুন্নি সম্প্রদায়ের। শুরু থেকেই সিরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় এটি একটি দুর্বল স্থান হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এখন রাজধানীর একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং নিষিদ্ধ স্থানে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বোমার প্রবেশ ও প্রতিস্থাপন যে নতুন করে সব পর্যায়েই অবিশ্বাস ও সংশয়ের উৎপত্তি ঘটাবে, তা বলাই বাহুল্য। গোয়েন্দা মহলে এ নিয়ে হয়তো বিতর্ক দীর্ঘায়িতই হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাকে ঘিরে রহস্যও ঘনীভূত হবে।
তবে বাশারের ভাগ্যবিপর্যয়ের নিঃসন্দেহে এই হামলা ছিল সর্বশেষ মারাত্মক অভিঘাত। এবং এটাই ছিল বাশারের জন্য সর্বশেষ বিপৎসংকেত। পর্যবেক্ষকদের অনুমানে সিরিয়ায় এখন সরকার বনাম বিদ্রোহী সংঘর্ষে মৃত্যুর সংখ্যা আফগানিস্তানের চেয়ে আনুমানিক দশ গুণ বেশি। দেশের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, যেখানে নাকি সরকারি বাহিনীর তৎপরতাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানেও মৃত্যুর হার ক্রমবর্ধর্মান। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সামরিক বাহিনীতে 'ডিফেকশন'। ইতিমধ্যে কয়েকজন জেনারেল স্বপক্ষ ত্যাগ করে পালিয়েছেন।
বিশেষ করে দেশের সীমান্ত এলাকায় বিভেদ এবং অসন্তুষ্টি আরো স্পষ্ট। সিরিয়ার তৃতীয় এবং চতুর্থ বৃহত্তম নগরী হোমস এবং হামা এখন প্রকাশ্যেই বাশারবিরোধী। তবে দেশের দুই প্রধান নগরী দামেস্ক এবং আলেপ্পো কিঞ্চিৎ কম উত্তপ্ত। কেননা সেখানকার অধিবাসীদের ধারণায় স্থিতিশীলতা সংরক্ষণে বাশারের যোগ্যতা কোনো বিকল্প নেতৃত্বে নেই। এখনকার বহুল আলোচিত বোমা হামলার বিচার-বিশ্লেষণ এবং হিসাব-নিকাশ বিদেশে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের রাজধানীগুলোতে এখন তুঙ্গে।
গত কয়েক মাস জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের কূটনীতি দেন-দরবারেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তাঁর কূটনীতি তাৎক্ষণিকভাবে একটি যুদ্ধবিরতি বা বাশারের অবর্তমানে একটি সর্বসম্মতিভিত্তিক ঐকমত্যের সরকার গঠনেও ব্যর্থ হয়। ফলে গত কয়েক সপ্তাহে শুধু হাজার হাজার সিরীয় নাগরিকেরই মৃত্যু হয়নি, মৃত্যু হয়েছে আনান প্ল্যানেরও। বিদ্রোহীরা যারা এখন বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছে, এখন তো আর কোনো শর্তেই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে না। প্রেসিডেন্ট বাশারও বেপরোয়া হয়ে আরো চরম পন্থা অবলম্বন করবেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আত্মরক্ষার স্বার্থে তিনি গোটা দামেস্ককে ভারী কামানের গোলায় দ্বিধাহীনচিত্তে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন।
ফলে একটি পরিপ্রেক্ষিত রচনা হতে চলেছে, যেখানে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাত অসম্ভব নয়। একটি মারাত্মক দমননীতিতে অটল বাশার তাঁর বিদ্রোহী জনগণকে শাস্তি দিতে তাদের রাসায়নিক অস্ত্রেরও লক্ষ্যবস্তু করতে পারেন। এই নাজুক সময়ে একমাত্র রুশদেরই তাঁর ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ আছে। রাশিয়ার বাশারের জন্য দুর্বলতার নেপথ্যে আছে (ক) একজন পুরনো মিত্রকে সুরক্ষা প্রদান, (খ) তার নিজস্ব অস্থির মুসলিম জনগণের জন্য বিবেচনা এবং (গ) পশ্চিমাদের সরকার উৎখাত নীতিতে রুশ অসম্মতি। এসব কারণেই এত দিন ধরে রাশিয়া বাশার সরকারকে পাশ্চাত্যের অব্যাহত কূটনৈতিক চাপ ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের বিরোধিতা করে এসেছে।
এ পর্যায়ে যেমনটি মনে হচ্ছে, বাশারকে সম্ভবত শেষ পর্যন্ত যেতেই হবে। রাশিয়া তখন কী করবে? অনেকেই মনে করছেন যে বাশার-পরবর্তী সিরিয়ায় একটি রুশ ভূমিকার নিশ্চয়তা পেলেই রাশিয়া তার পুরনো মিত্রকে পরিহার করতে প্রস্তুত থাকবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আবেগের যে খুব একটা মূল্য নেই, তা রুশরাও বোঝে।
চূড়ান্ত একটি কূটনৈতিক ধাক্কার অভাবে বাশারের সরকার উৎখাতে পাশ্চাত্যের সরকারগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে চলমান বাশারবিরোধীদের অভিযানকে চাঙ্গা করতে এবং কূটনৈতিকভাবে সম্ভব না হলেও সামরিক শেষ ধাক্কাটি দিয়ে বাশার সরকারকে উৎখাতের পর্বটি সাঙ্গ করতে। দ্রুত এই কাজটি সমাধা করতে বাশারবিরোধী এমনকি আরব মহলেও প্রধান শক্তিকে আর্থিক ও সরঞ্জাম সাহায্যদানের কথাও ভাবছে। অবশ্য ইতিমধ্যেই বিদ্রোহীরা তা পেয়ে আসছে কাতার, সৌদি আরব ও তুরস্কের বদান্যতায়।
পর্যবেক্ষকদের মতে, বিদ্রোহীদের ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (ঋঝঅ) কোনো ফেরেশতাদের সংগঠন নয়। তাদের সাহায্য হিসেবে দেওয়া অনেক অস্ত্র-সরঞ্জাম বিপথগামীদের হাতেও পড়বে। এমনকি এগুলোর কিছু অংশ 'জিহাদি'রাও হস্তগত করবে। এভাবে সিরিয়া যে অবৈধ অস্ত্রের আগারে পরিণত হতে যাচ্ছে_বাশার-পরবর্তী সময়েও তেমন দেশকে শাসন এখনকার চেয়েও কঠিন হয়ে পড়বে। এখনো চাইলে মাসের পর মাস বাশার ক্ষমতায় ঝুলে থাকতে পারেন অথবা পাশ্চাত্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা ত্বরান্বিতও হতে পারে। বিষয়টিকে যেভাবেই দেখা হোক বা তা বাস্তবে পরিণত হোক_আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাশারবিহীন সিরিয়ার সঙ্গেই সমীকরণ গড়তে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইএসএস

No comments

Powered by Blogger.