স্মরণ- ভৈরবের আইভি রহমান by সুমন মোল্লা

আইভি রহমান কারও কাছে অকুতোভয় নারীনেত্রী, কারও কাছে প্রগতিশীল রাজনীতিক হিসেবে অধিক পরিচিত। কারও কারও কাছে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু এসব পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর জন্মস্থান ভৈরবে তিনি ছিলেন সবার প্রিয় আইভি আপা।


আইভি রহমান আজ আর আমাদের মাঝে নেই। আট বছর আগে, এই দিনে ঘাতকের গ্রেনেডে গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নির্মমতার শিকার তিনি। দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিবাদী চক্র। ঘটনাস্থলেই অনেকে নিহত হয়। অনেকে গুরুতর আহত হয়। আহত হন সেই সমাবেশের সামনের সারিতে থাকা আইভি রহমানও।
ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৪ আগস্ট পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর এক মাস ১৭ দিন। সেদিনের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছিল সারা দেশের মানুষ। উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল সারা বিশ্ব। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানের এভাবে চলা যাওয়া মেনে নিতে পারেনি দেশের মানুষ।
এখনো অশ্রু-পুষ্পে স্মরণ করে ভৈরববাসী তাদের প্রিয় নেত্রী আইভি রহমানকে। ২০০৪ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভৈরবে বন্যা হয়েছিল। নিজ এলাকার দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসছিলেন তিনি। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে জলাবদ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
বেগম আইভি রহমানের পুরো নাম জেবুন্নাহার আইভি। ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের চণ্ডীবেরে কামাল সরকারের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ। মা হাসিনা বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী। আট বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আইভি ছিলেন পঞ্চম।
১৯৫৮ সালের ২৭ জুন নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে আওয়ামী লীগের নেতা মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, বর্তমানে যিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। এর আগে মো. জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। নিজের ও স্বামীর বাড়ি ভৈরবে হওয়ায় আইভি রহমানের কাছে এলাকাবাসীর প্রত্যাশা ছিল বেশি।
রাজনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও আইভি রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর বড় বোন শামসুন্নাহার সিদ্দিক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার শাশুড়ি। এক ছেলে নাজমুল হাসান পাপন, দুই মেয়ে তানিয়া ও ময়না এবং স্বামী জিল্লুর রহমানকে নিয়ে তাঁর ছিল গোছানো জীবন।
স্বাধীনতার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আইভির অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য জীবনের যাত্রা শুরু হয়। ছাত্রজীবনে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির অধিকার আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭১ সালে আইভি রহমান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ভারতে গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে জাতীয় মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী হন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের মহিলাবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আইভি রহমান বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ও জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মহিলা সংস্থা ও জাতীয় মহিলা সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন। নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এবং সমাজের অবহেলিত শিশু, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
আইভি রহমানকে হারানোর শোক আজও ভুলতে পারেনি ভৈরববাসী। মৃত্যুর আট বছর পার হয়ে গেছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। জজ মিয়া গল্প সাজানো হয়েছিল।
দেরিতে হলেও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার শুরু হওয়ায় সারা দেশের মানুষের সঙ্গে ভৈরববাসী স্বস্তিবোধ করছে। তাদের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকারীদের বিচার হোক। তাদের আরও দাবি, আইভি রহমানের স্মৃতি ধরে রাখতে ভৈরবে বড় কিছু করা হোক। ভৈরবে জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজের নির্মাণাধীন একটি ছাত্রীনিবাসের নাম আর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে তোরণ ও নামফলক উদ্বোধনের মধ্যেই তাঁর স্মৃতির স্মারক সীমিত হয়ে পড়েছে।
রাজপথের এই আজীবন সংগ্রামী মানুষটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষের হূদয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সুমন মোল্লা
নিজস্ব প্রতিবেদক, ভৈরব।
sumon.mollah@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.