বইপত্র- সূর্য সেন, প্রীতিলতা ও চৌষট্টিজন তরুণ-তরুণী by তানভীর মোকাম্মেল

ডু অ্যান্ড ডাই, দ্য চিটাগং আপরাইজিং ১৯৩০-১৯৩৪ \ সম্পাদনা: মানিনী চ্যাটার্জি \ প্রকাশক: পিকাডর ইন্ডিয়া \
প্রকাশকাল: মার্চ ২০১০ ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার ও ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক ব্যতিক্রমী সাহসী ঘটনা। যে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, কর্মদক্ষতা ও অসীম সাহস বাঙালি তরুণ-তরুণীরা এই অভিযানে দেখিয়েছিলেন, তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।


ব্যাপকভাবে পুলিশ রেকর্ড ও সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে এবং সাবেক বিপ্লবীদের বিশদ সাক্ষাৎকার নিয়ে গবেষিকা মানিনী চ্যাটার্জি চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ওপর চমৎকার একটা বই লিখেছেন, যে বইয়ে সেই ঘটনা ও স্বাধীনতাবিপ্লবীদের এক প্রাঞ্জল ও অন্তরঙ্গ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। সুখপাঠ্য এই বইয়ের নাম ডু অ্যান্ড ডাই: দ্য চিটাগং আপরাইজিং ১৯৩০-১৯৩৪। প্রায় সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার বইটি প্রথম প্রকাশ করে পেঙ্গুইন এবং পরে পিকাডর প্রকাশনী।
লেখিকা বিশদে বর্ণনা করেন ১৮ এপ্রিলের সেই বিশেষ রাতের কথা, যখন সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সশস্ত্র আক্রমণ করে দখল করে নেন চট্টগ্রামের পুলিশ লাইন ও ব্রিটিশ অক্সিলারি ফোর্সের অস্ত্রাগার। এক নাটকীয় রুদ্ধশ্বাসে পর পর বর্ণিত হয় ঘটনাপ্রবাহ—জালালাবাদের যুদ্ধ, ধলঘাটের সংঘর্ষ, পাহাড়তলীতে আক্রমণ। ফুটে ওঠে অসামান্য কিছু চরিত্র—দুঃসাহসী দুই বন্ধু ও সহযোদ্ধা অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ, প্রাণোচ্ছল কল্পনা দত্ত, কিছুটা বিষণ্ন মানসিকতার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং ইস্পাতকঠিন এক সংগঠক মাস্টারদা সূর্য সেন। বইটির বিশেষ গুণ, এই সব চরিত্রই, এমনকি তাঁদের প্রতিপক্ষ ইংরেজ অফিসার ও বাঙালি গোয়েন্দারাও, তাঁদের সব মানবিক গুণ ও দুর্বলতাসহই হয়ে ওঠে সজীব ও প্রাণবন্ত।
সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন ও লোকনাথ বল—চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগ্রামের এসব বিপ্লবীর জীবনের আদর্শ ছিলেন আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামী ভ্যালেরা ও আইরিশ বিপ্লবীরা। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির মতোই তাঁরা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’। অল্প কয়েকজন মাত্র আইরিশ বিপ্লবী যোদ্ধা সামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে ১৯১৬ সালের এপ্রিলে ডাবলিনের জেনারেল পোস্ট অফিস যেভাবে দখল করেছিলেন, যা ইতিহাসে ‘ইস্টার রাইজিং’ নামে খ্যাত, ঠিক সেই আদলেই চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তাঁদের বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেছিলেন। টেনিসনের কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন এসব তরুণ বিপ্লবী। এবং টেনিসনের ‘ইউলিসিস’ কবিতার ‘টু স্ট্রাইভ, টু সিক, টু ফাইন্ড, নট টু ইল্ড’-এর হার-না-মানা এক দৃঢ়তা নিয়ে অর্জুনের-পাখির-চোখে-তাকিয়ে-থাকার মতোই লক্ষ্যবস্তুতে অবিচল থেকে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন সুদক্ষ ও আত্মত্যাগী এক বিপ্লবী বাহিনী।
লক্ষ করবেন, বইটির নাম ডু অর ডাই নয়, ডু অ্যান্ড ডাই। কাজটি করো এবং মৃত্যুবরণ করো। কী সেই কাজ? কাজটা হচ্ছে ব্রিটিশরাজকে বুঝিয়ে দাও যে বাঙালি বা ভারতবাসী কোনো ভীতু মেষশাবক জাতি নয়। ওই যে মেকলে ও অন্যান্য যেসব ইংরেজ বাঙালিদের সম্পর্কে তুচ্ছার্থে বলতেন যে বাঙালিরা ভীরু, হীন, তোষামুদে ও নির্বীর্য এক জাতি; সূর্য সেন ও তাঁর সঙ্গীদের সাহস ও বীর্যের প্রকাশ সেই সব ইংরেজের মুখে ছিল এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত বিশেষ। মাত্র ৬৪ জন বাঙালি তরুণ-তরুণী যা করলেন, ইংরেজ অফিসাররা কোনো দিন তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তাঁরা ব্রিটিশ পুলিশ লাইন দখল করলেন, অস্ত্রাগার আক্রমণ ও দখল করলেন এবং ব্রিটিশ বাহিনীকে সামরিকভাবে পরাজিত ও পালাতে বাধ্য করলেন। আর যেটায় তাঁরা সবচেয়ে বেশি বড় সফল হলেন, তা হচ্ছে তাঁরা ব্রিটিশ সিংহের মনে এক গভীর ভয় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হলেন। ইংরেজরা যে কতটা ভয় পেয়েছিল, তা বোঝা যায় যখন দেখি বিপ্লবীদের প্রথম আক্রমণের ধাক্কাতেই চট্টগ্রামের ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উইলকিনসন সাহেব চট্টগ্রাম শহর ছেড়েই ভয়ে পালিয়ে বন্দরের এক জাহাজে আশ্রয় নিতে ছুটলেন!
ভারতবর্ষের এক সুদূর প্রান্তে হলেও চট্টগ্রাম কখনো চেতনায় প্রান্তিক ছিল না। যেকোনো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ও অগ্রসর চেতনায় সাগর-মেখলার চট্টগ্রাম সব সময়ই ছিল এগিয়ে। চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের আড়ালে সূর্য সেনরা তাঁদের গোপন প্রস্তুতির কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ব্রিটিশ পুলিশ ও গোয়েন্দাদের এক্কেবারে নাকের ডগায়! বিপ্লবীদের এসব সাহসী ও দক্ষ কাজের এক বিশদ ও চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন লেখিকা। তবে শুধু মানুষ নয়, চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের পাহাড়, জঙ্গল, নদী—সবকিছুই যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে মানিনী চ্যাটার্জির সজীব বর্ণনায়। এমনকি, যে বেবি অস্টিন গাড়িটি অনন্ত সিংহ চালাতেন, সেটাও যেন আমাদের মনশ্চক্ষে জীবন্ত হয়ে ওঠে!
চট্টগ্রামের বিপ্লব-প্রচেষ্টার কয়েকটা বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত, সেই সময়কার অনেক হিন্দু জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী দলগুলো যেরকমটি মুসলমান সম্প্রদায়কে অবিশ্বাস ও দূরে ঠেলে রাখত, চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সেটা করেননি। সূর্য সেন ও তাঁর সহকর্মীরা চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলমান সম্প্রদায়কে আস্থায় এনেছিলেন। বিপ্লবীদের অন্যতম নেতা গণেশ ঘোষ জানাচ্ছেন যে মুসলমান গ্রামবাসীর সহানুভূতি ও সাহায্য ছাড়া মাস্টারদা ও তাঁর সঙ্গীদের পক্ষে চট্টগ্রামের সীমিত অঞ্চলে টিকে থাকা কখনোই সম্ভব হতো না। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি ছিল, নারীদেরও সশস্ত্র সংগ্রামে শামিল করা, যা এর আগে পুরুষকেন্দ্রিক অন্যান্য বিপ্লবী গ্রুপের ক্ষেত্রে আমরা তেমন দেখি না।
নারী হয়েও আমাদের সমাজের আরোপিত লক্ষণরেখা অতিক্রম করে একজন কল্পনা দত্ত, একজন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সশস্ত্র সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণের কাজটা যে কত বড় এক সাহসের ঘটনা, আজ তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। পড়াশোনায় অসম্ভব মেধাবী প্রীতিলতা ছিলেন দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। শান্ত স্বভাবের প্রীতিলতা নিজের মধ্যে আত্মমগ্ন থাকতেন। ওদিকে রায়বাহাদুরের নাতনি সচ্ছল পরিবারের কল্পনা দত্ত ছিলেন উচ্ছল প্রাণবন্ত এক তরুণী, যিনি গল্প করতে ও গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের দুই তরুণী একত্র হলেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করতে। প্রীতিলতা ও কল্পনা তাঁদের আন্তরিকতা, সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অনেক পুরুষের চেয়েও বেশি দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে তো প্রীতিলতাই ছিলেন দলনেত্রী, যাঁর অধীনে ছেলেরা ওই অপারেশনে অংশ নেন। প্রীতিলতার বুকে একটা গুলি লেগেছিল বটে, কিন্তু ওঁর মৃত্যু ঘটেছিল পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে। আহত অবস্থায় ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে আত্মহত্যাকেই বেছে নিয়েছিলেন বাংলার এই সাহসী তরুণী।
চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল চারটি। টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ, ভলান্টিয়ার ব্যারাক বা সামরিক অস্ত্রাগার দখল, পুলিশ ব্যারাক ও পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ। এই চারটি লক্ষ্যেই বিপ্লবীরা সফল হয়েছিলেন। অস্ত্রাগারে তাঁরা অনেক অস্ত্রই পেলেন—রাইফেল, রিভলবার, লুইস মেশিনগান। কিন্তু দুঃখজনক যে এসব অস্ত্রের কোনো কার্তুজ ছিল না। কার্তুজের বাক্স আছে, কিন্তু সব খালি! এসব অস্ত্রের কার্তুজ পেলে বিপ্লবীরা কেবল কয়েক দিন নয়, কয়েক সপ্তাহ চট্টগ্রাম অঞ্চল মুক্ত রাখতে পারতেন বলে ব্রিটিশ অফিসাররাই স্বীকার করেছেন।
এটা মনে রাখতে হবে, চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবীরা যোদ্ধা ছিলেন, সন্ত্রাসবাদী নন। সূর্য সেন ও তাঁর সাথিরা নিজেদের ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র ‘চট্টগ্রাম শাখা’ বলতে পছন্দ করতেন। সন্ত্রাসকে তাঁরা পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিলেও সন্ত্রাসই তাঁদের লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল ‘জাতীয় সরকার’ গঠন। ১৮ এপ্রিলের সেই রাতে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখলে এনে ‘অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার’-এর নামে তাঁরা আকাশে তিনটি গোলা ছুড়লেন এবং বন্দে মাতরম স্লোগান দিলেন। ভারতের সূদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনে এমনটি আর কখনোই হয়নি। উপনিবেশ ভারতের মাটিতে একটা জাতীয় সরকার গঠিত হলো। যদিও তার আয়ু ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।
এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হতে বাধ্য ছিল। কিন্তু কেবল সফল হওয়াই সাফল্যের একমাত্র মানদণ্ড নয়। বিপ্লবীরা ভালোই জানতেন যে একপর্যায়ে গিয়ে তাঁরা পরাভূত হবেন। তবু মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাঁরা কাজগুলো করেছেন বাংলা তথা ভারতবাসীর মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে যে ব্রিটিশদের সামরিকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব এবং ব্রিটিশ সিংহকে অতটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর এ ক্ষেত্রে তাঁরা বাজি রেখেছিলেন, নিজেদের—তরুণ জীবন।
তাই এটা আশ্চর্য করে না যে অনেক ‘সফল’ রাজনীতিবিদের চেয়ে সূর্য সেন ও প্রীতিলতাদেরই ইতিহাস মনে রেখেছে এবং তাঁদের এই আত্মত্যাগ হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে। বইটির নাম তাই হয়তো ডু অ্যান্ড ডাই হওয়াই সবচেয়ে যথার্থ ছিল। কাজটা করো এবং মৃত্যুবরণ করো। লাভ-ক্ষতির হিসাব করুক ক্ষীণপ্রাণ গেরস্থ রাজনীতিবিদেরা।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার গ্রামটিতে অনেক রক্তাক্ত গোলাগুলির পর আরও নিরীহ মানুষের মৃত্যু এড়াতে কল্পনা দত্ত যখন আত্মসমর্পণের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন ইংরেজ বাহিনীর সুবেদার তাঁকে থাপড় মারে। কল্পনা দত্ত জানাচ্ছেন যে সাধারণ সৈন্যরা তখন সুবেদারকেই ঘিরে ধরে, ‘ওর গায়ে হাত তুলবে না। তাহলে তোমার আদেশ আমরা আর মানব না।’ কল্পনা দত্ত জানাচ্ছেন যে তাঁর চোখে তখন জল এসে গিয়েছিল! চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের এত চেষ্টা, এত আত্মত্যাগ তাহলে বৃথা যায়নি। খোদ ব্রিটিশ বাহিনীর চাকুরে ভারতীয় সৈন্যরাও আজ তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে!
চট্টগ্রাম বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু ইংরেজ রাজশক্তির অন্তরে গভীর একটা ভীতি এই বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ রকম ভীতি ও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ব্রিটিশরা এ দেশে আর কখনোই তেমন ভোগেনি। শাসক ইংরেজদের নৈতিক সাহস ও আত্মসন্তুষ্টির গভীরেই চিড় ধরেছিল। এখানেই চট্টগ্রামের বীর বিপ্লবীদের সার্থকতা।
পরবর্তীকালে গান্ধীর অহিংস আন্দোলন এবং পাকিস্তান-ভারত দেশভাগ—এসবের কারণে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা কিছুটা চাপা পড়েছে। প্রয়োজন ছিল তাই এ রকম পরিশ্রমী গবেষণায় ডু অ্যান্ড ডাইয়ের মতো সুলিখিত একটি বই, যা নতুন প্রজন্মকে দেবে গভীর দেশপ্রেমের দীক্ষা।

No comments

Powered by Blogger.