ছুটির ফাঁদে হাসপাতালে রোগীদের করুণ দশা by তৌফিক মারুফ

ক্যাম্পাসজুড়ে ঈদের সাজ। লাল-নীল-হলুদ রংবেরঙের উৎসব-পতাকা চারদিকে। ভবনের ভেতরে দেয়ালে, ছাদে রঙিন কাগজের বাহারি সজ্জায় ঝলমল করছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বর। ঈদের চার দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবারও এমন চিত্র চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।


কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই সব পাল্টে যায়-সাজানো-গোছানো পরিবেশের ভেতরই মর্গের ফটক আর বাথরুমের ঠিক সামনে বারান্দার খাটে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা যুবক রোগী সোহেল। পাশে দাঁড়ানো মা ফরিদা বেগম মলিন মুখে বলেন, 'একদিকে পোলাডার এই যন্ত্রণা, আরেকদিকে বাথরুমের দুর্গন্ধ; ওয়ার্ডের মধ্যে সিট পাই নাই। এই কয় দিন মাটিতে ছিল। কাইলকা এক বেডারে ৭০ টাকা দিয়া এই খাটটা জোডাইলাম। কাইলকা একবার ডাক্তার আইছিল, স্যালাইন লাগাইয়া গেছেগা। পোলাডার অবস্থা যে কী, কইতে পারতাছি না।'
ফরিদা বেগম যোগ করেন, 'একরহম গায়ের উপর থেইক্কা ওই রুমডা দিয়া লাশ আনে-নেয়, গত চার দিনে যে কতগুলান লাশ আনছে-নিছে, হিসাব কইতে পারুম না।'
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দেয়ালে লাগানো বোর্ডে ২২ আগস্টের তারিখে লেখা দেখা যায়, মৃতের সংখ্যা সাত। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. হরিদাস সাহা প্রতাপ কালের কণ্ঠকে জানান, জরুরি বিভাগের বোর্ডে কেবল জরুরি বিভাগে মৃতদের তালিকা দেওয়া থাকে। এখানে ইনডোরের মৃতের হিসাব থাকে না। তিনি বলেন, 'ঈদের বন্ধে যে রোগী বেশি মারা যায়, সেটা বলা ঠিক হবে না। বরং ঢাকা মেডিক্যালে ঈদের সময় জরুরি বিভাগে অনেক বেশি কার্যকর চিকিৎসা চলে।' তিনি বলেন, 'আমি টানা চার দিন হাসপাতালে অবস্থান করে সার্বিক জরুরি চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি।'
ঢাকা মেডিক্যালের একাধিক ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'ঈদের বন্ধে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার ও আবাসিক সার্জনদের ওপর। অধ্যাপক চিকিৎসকরা আসেন না বললেই চলে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সমস্যা হয়। রোগীদের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।'
আরেক চিকিৎসক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'কেবল জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে বড়রা ঈদ উপভোগ করে বেড়াবেন, সেটা ঠিক নয়। আগে দেখতাম অনেক অধ্যাপক-সহযোগী অধ্যাপক ঈদের দিন বা ঈদের আগে-পরের দিন হাসপাতালে এসে অন্তত কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে যেতেন। এখন সেই আচরণটুকুও আর নেই। জুনিয়র ডাক্তাররা জরুরি প্রয়োজনেও অধ্যাপকদের বলার সাহস পান না। নিজেরাই যা পারেন, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন।'
এমন অভিযোগ রয়েছে নার্সদের পক্ষ থেকেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নার্স বলেন, 'নিয়ম অনুসারে সব ইউনিটপ্রধানরা সার্বক্ষণিক অন কলে থাকেন। কিন্তু অনেককে কল দিলেও তাঁরা আসেন না। আবার দায়িত্বরত জুনিয়র অনেক ডাক্তার জরুরি প্রয়োজন হলে নিজেরা কল না করে আমাদের দিয়ে সিনিয়রদের কল করানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু রাগারাগি শোনার ভয়ে আমরাও কল করতে পারি না।'
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এবার ঈদের বন্ধে চিকিৎসার শৈথিল্যে বা অবেহেলায় কোনো রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। বরং অন্য সময়ের তুলনামূলক হিসাবে ঈদের দিনে রোগী মৃত্যুর হার এবার কম ছিল।'
পরিচালক জানান, এবার সিনিয়র ডাক্তারদের উপস্থিতি অনেক বেশি। মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদসহ আরো বেশ কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার ঈদের দিনও হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যরা না থাকলেও কোনো সমস্যা হয়নি। জুনিয়ররা সামলে নিয়েছেন। এ ছাড়া অধ্যাপকদের চেয়ে আবাসিক চিকিৎসক ও রেজিস্টারদের ওপরই মূল দায়িত্ব থাকে।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও কলেজের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের দিন যেসব ইউনিটে ভর্তি ছিল, সেসব ইউনিটের ফুল টিম দায়িত্ব পালন করেছে। অন্য ইউনিটগুলোতে অধ্যাপক-সহযোগী অধ্যাপকরা সবাই না এলেও অন্যদের নিয়ে জরুরি চিকিৎসা টিম করে দেওয়া হয়েছিল।
ওই দিন দুপুর পৌনে ২টায় একই হাসপাতালের দোতলায় ২১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সামনের করিডর থেকে ভিতর পর্যন্ত মানুষের ভিড় ছিল। ভেতরে কী হচ্ছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। অনেক চেষ্টার পর ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ওয়ার্ডের বি-১ নম্বর বেডের সামনে কয়েকজন চিকিৎসক রোগী দেখছেন। মানুষের সারি গিয়ে ঠেকেছে ওই চিকিৎসকদের সামনে। সবাই চেষ্টা করছে চিকিৎসকদের সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য। কেউ কেউ হাতে করে নিয়ে আসা এক্স-রে প্লেট বা ফাইল এগিয়ে ধরছে সামনের দিকে। কার আগে কে দেখাবে তা নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতা। ঘটনা জানতে চাইলে পাশে দাঁড়ানো এক রোগীর স্বজন বলেন 'এই কয়দিন তো রোগীরা বড় ডাক্তারকে পায়নি, আজ পেয়েছে। তাই সবাই নিজের রোগীর অবস্থা নিয়ে বড় ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইছে।'
২০৮ নম্বর ওয়ার্ডের (শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি) একটি বেডের ছোট্ট রোগীর বাবা এক হাত দিয়ে তাঁর সন্তানের মাথা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে রেখে আরেক হাত দিয়ে চোখ মুছছেন। আরেক পাশে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে আছে তরুণ বয়সী এক ডাক্তার ও দুজন নার্স। শিশুটির কপালে হাত দিয়ে দেখা যায় জ্বর খুব বেশি। ডাক্তার দেখেছেন? জানতে চাইলে শিশুটির বাবা বলেন, 'আইজক্যা ছয় দিন মাইয়াডার এই অবস্থা। জ্বর কমতাছেই না। ঈদের দুই দিন আগে বড় ডাক্তার আইয়া গেছে, তারপর ওইরম কমবয়সী ডাক্তার আহে-যায়, হেগো লগে সহজে কথা কওন যায় না। রোগীর সমস্যা খুইল্যা কইতে গেলে ধমক দেয়।'
টাঙ্গাইলের মধুপুরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ঈদের দিন রাতে এ হাসপাতালে ভর্তি হন ৭০ বছরের জুলহাস উদ্দিন। ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায় ভর্তি হলেও আরো অনেকের মতোই মূল ওয়ার্ডের ভেতরে বা বাইরে খাটেও জায়গা হয়নি তাঁর। শুয়ে আছেন নিচতলার মূল করিডরের পাশে। ছেলে সানোয়ার বলেন, 'চিকিৎসা হচ্ছে, তবে সিনিয়র কোনো ডাক্তার এখনো দেখিনি। জুনিয়র ডাক্তাররা এসে মাঝেমধ্যে দেখে যান।'
একই হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তিন ও চার তলার বারান্দায় দেখা যায় বিভিন্নভাবে অগ্নিদগ্ধ হওয়া রোগির ভিড়। কেউ খাট পেয়েছে, কেউ নিচে বিছানা বিছিয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোগী বলেন, ঈদের ছুটিতে বড় ডাক্তারদের দেখা পাওয়া যায়নি। যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরকেও ডেকে ডেকে হয়রান হতে হয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারা কোনো কোনো রোগীর অবস্থা নিজেরাই ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছিলেন না। নিরুপায় হয়ে কয়েকজন রোগী এখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে।
বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঈদের দিনও অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন নিজে এসে এ ইউনিটে দুপুর পর্যন্ত ছিলেন। এ ছাড়া আমার নেতৃত্বে একটি টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছে। অন্য সিনিয়র স্যারদের কল দেওয়ার মতো কোনো সমস্যা দেখিনি।'
হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্রের সামনের বারান্দার মেঝেতে গতকাল সকাল ১১টায় গড়াগড়ি দিয়ে আহাজারি করছিলেন পাবনার গুলজার হোসেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'একজন বড় ডাক্তার দেখলাম না। অল্প বয়সী কয়টা ছেলে ডাক্তার কী করছে না করছে বুঝলাম না, আমার মাকে যখন এখানে আনলাম তখনও সে কথা বলছিল। কিন্তু এখন লাশ নিয়ে যাচ্ছি।' একটু থেমে তিনি আরো বলেন, 'আমার মনে হয় নতুন ডাক্তার ছেলেরা ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে পারেনি। সিনিয়র কোনো ডাক্তার থাকলে হয়তো উপযুক্ত চিকিৎসা দিয়ে আমার মাকে সুস্থ করে তুলতে পারতেন।'
একই হাসপাতালের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পুরুষ ইউনিটের ডিউটি নার্সের কাছে এসে এক রোগীর স্বজন উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চান, বড় ডাক্তার কখন আসবেন, ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না। এ কথা শুনে ডিউটি নার্স উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'আমাদের কাজ আমরা করি, স্যাররা কখন আসবেন না আসবেন, তা আমাদের জানার ব্যাপার না। যান এখান থেকে। স্যাররা তাঁদের সময়মতো আসবেন।' একটু দূরে সরে এসে রোগীর স্বজন বলেন, 'আমার রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। কী করব না করব বুঝতে পারছি না। ঈদের কয় দিন বড় ডাক্তারদের চিহ্নও দেখি নাই। ইয়াং ডাক্তারা এত বেশি সেনসেটিভ যে তাদের সাথে কথা বলা মুশকিল হয়ে যায়। বারবার আকুতি জানালে তারা আর রোগীর কাছে আসে না।'
এই হাসপাতালের আউটডোরে গতকালও দেখা যায় অনেক ডাক্তারের রুম তালাবদ্ধ। রোগীর ভিড়ও কম। বেশ ফাঁকা ফাঁকা পরিবেশ।
পাশেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সকাল ১০টায় ৮ নম্বর ব্লকের সামনের করিডরে দেখা যায় দীর্ঘ সারি। একই ব্লকের মধ্যে গাইনি ও ইএনটির ডাক্তাররা বসেন।
আসমা বেগম নামের একজন বলেন, 'এ কয় দিন বন্ধ থাকার ফলে আজ এত ভিড়।' আবাসিক চিকিৎসক নাজমুল হকের রুমের সামনে ঠেলাঠেলি করে কার আগে কে ঢুকবেন, তা নিয়ে রোগীদের মধ্যে কিছু সময় চলে হট্টগোল।
একই ভবনের আরেক প্রান্তে চর্ম ও যৌন বিভাগের প্রধান ডা. রাশেদ মো. খানের রুমের সামনে বেশ কয়েকবার ঘুরে ঘুরে হতাশ হয়ে একটু সামনে এগিয়ে এক ব্যক্তি আপন মনে বলেন, 'ঈদ গেছে কবে, এখনো বড় ডাক্তারদের ঘুম ভাঙছে না। উনি যে কবে আসবেন, আল্লায়ই জানে।' এ সময় ডা. রাশেদের রুমের তালা খুলে একটি চেয়ার বের করে অন্য রুমে নেওয়ার সময় একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'স্যার শনিবার আসবেন, ওনার ছুটি শেষ হয় নাই।'
হাসপাতালের পরিচালক ডা. মজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো কোনো ডাক্তার হয়তো ঈদের ছুটির পরও ঐচ্ছিক ছুটি কাটাচ্ছেন, এটা অনিয়ম নয়। সহকর্মীদের ম্যানেজ করে তাঁরা এ ছুটি ভোগ করতে পারেন।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সি ব্লকের নিচে লিফটের সামনে উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আকবর আলী। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলেন, 'বাবারে নিয়া এইখানে আছি আজ আট দিন। ঈদের মধ্যে কোনো বড় ডাক্তারের দেখা পাইনি। আজ নাকি বড় ডাক্তার আসছেন। তাঁর সাথে কথা বলার জন্য রুমে গিয়ে পেলাম না। শুনি এইমাত্র বের হয়ে গেছেন।'
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল মজিদ ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের এখানে এবার কোনো চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটেনি। সবাই টিভিতে দেখেছেন যে এখানে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে চিকিৎসা চলেছে।' তিনি বলেন, 'সবাই অন কলে ছিলেন। প্রয়োজনমতো সিনিয়র ডাক্তাররা এসে রোগী দেখে গেছেন।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) মোমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগে থেকেই আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলাম ঈদের ছুটিতে চিকিৎসা নির্বিঘ্ন রাখতে। সে অনুসারে সবাই কাজ করেছে। কোথাও থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি।'

No comments

Powered by Blogger.