ধর্ম- নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাতৃদুগ্ধ পান by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাতৃদুগ্ধ পান ও নবজাতক শিশুর জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং নবজাত শিশুর লালন-পালনের যাবতীয় ব্যবস্থা তিনিই করেছেন।


মানুষের শরীর থেকে একটা মাত্র খাবারই তৈরি করে তিনি শিশুদের জন্য নিয়ামতস্বরূপ উপহার দিয়েছেন। অবুঝ-নিরুপায় শিশুকে দুনিয়ায় প্রেরণের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার মায়ের স্তনে প্রয়োজনীয় খাবার পাঠান। তাই মানবসন্তান জন্মের পর মায়ের দুধই শিশুর প্রথম খাদ্য; যা শিশুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। দয়াময় আল্লাহ তাআলা নবজাতককে মায়ের দুধ দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। ইসলামের দিকনির্দেশনা যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে মা ও শিশুর জীবনে বিরাট কল্যাণ সাধিত হয়। মহান সৃষ্টিকর্তা একমাত্র তাঁর বিধিবিধান মেনে চলার মধ্যে ইহকাল ও পরকালে মানবজাতির সর্বাঙ্গীণ সুখ-শান্তি ও সফলতা রেখেছেন।
পবিত্র কোরআনের আটটি সূরায় ১৫ বার মায়ের দুধপান-সংক্রান্ত বিভিন্ন আয়াতে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দানের কথা বলা হয়েছে। তাই ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়ের প্রথম দুধ, অর্থাৎ শালদুধ শিশুদের পান করানো একান্ত আবশ্যক। শালদুধ শিশুর জীবনের প্রথম টিকা। কেননা এতে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় এমন মূল্যবান পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে, যা শিশুকে বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করে থাকে। শালদুধ নবজাতকের পরিপূর্ণ পুষ্টির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। শালদুধে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আমিষ, শর্করা, স্নেহজাতীয় পদার্থ, খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিনস এবং নবজাতকের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক উপাদান; যা শিশুকে অন্ধত্বের হাত থেকে সুরক্ষা করে। জন্মের পর পর শালদুধ খেলে শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিও লাভ করে। সুতরাং, জন্মের পর পর শিশুকে মায়ের বুকের প্রথম শালদুধ খাওয়ানো উচিত। শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর সময়সীমা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘জননীগণ পুরো দুই বছর সন্তানদেরকে মাতৃদুগ্ধ পান করাবে, যদি তারা মায়ের দুধ খাওয়ানোর সময় পূর্ণ করতে চায়।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৩৩)
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নবজাতক শিশুর জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প বা পরিপূরক নেই। আল্লাহ তাআলা শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং যেহেতু মায়ের যত্নের ওপর শিশুর সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে, তাই প্রতিটি শিশুর জন্মের পর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ অবশ্যই দিতে হবে। এতে মা ও শিশু উভয়েই সমান উপকৃত হবে। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুসারে শিশুকে তার মা পূর্ণ দুই বছর দুধ পান করাবেন। প্রয়োজনে আরও ছয় মাস সময় বাড়ানো যেতে পারে। শিশুকে বুকের দুধ দুই থেকে আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত খাওয়ানো হলে মানবসন্তান প্রাকৃতিক নিয়মেই বেড়ে উঠবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে।’ (সূরা লুকমান, আয়াত-১৪) অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও দুধ ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস, ক্রমে সে পূর্ণ শক্তিপ্রাপ্ত হয়।’ (সূরা আল-আহকাফ, আয়াত-১৫)
মায়ের বুকের দুধ নবজাতক শিশুর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নিয়ামত। মায়ের দুধ বিশ্বস্ত ও নিরাপদ এবং শিশু সহজেই হজম করতে পারে। স্তন্যপানে মা ও শিশুর মধ্যে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং শিশু নিজেকে অধিক নিরাপদ মনে করে। শিশুকে বুকের দুধ দিলে মায়ের স্তনে ও জরায়ুতে ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে না এবং সাধারণত গর্ভনিরোধ হয়। কাজেই মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শিশুদের বুকের দুধ সেবন অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে হজরত মূসা (আ.)-এর শৈশবকালীন অবস্থার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইরশাদ করেছেন, মূসা-জননীর অন্তরে আমি ইঙ্গিতে নির্দেশ করলাম যে, ‘তুমি শিশুটিকে দুগ্ধদান করতে থাকো।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত-৭)
মাতৃদুগ্ধে আল্লাহ প্রদত্ত এমন সব উপাদান দেওয়া হয়েছে, যা নবজাতক শিশুকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে। মায়ের দুধের মধ্যেই রয়েছে শিশুর সবল হয়ে বেড়ে ওঠার বীজমন্ত্র। শিশুর পুষ্টির জন্য এত ভালো খাদ্য আর নেই। মায়ের দুধের অমৃত স্বাদের মধ্য দিয়ে শিশুর শিরায়-উপশিরায় প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যা সঞ্চারিত হয়ে যায়। মায়ের দুধ তখন নবজাতকের কাছে শুধুই খাদ্যপানীয় নয়, প্রথম অবলম্বন, নিরাপত্তার প্রথম নিশ্চয়তা, বিশ্বসংসারের সঙ্গে প্রথম যোগসূত্র ঘটায়। দিনে দিনে শিশু যখন বাড়তে থাকে, মাতৃদুগ্ধ তাকে দেয় পর্যাপ্ত জীবনীশক্তি, বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ। মায়ের দুধপানে শিশুর স্মরণশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, চোখের জ্যোতি, আচার-ব্যবহার, সামাজিকতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুন্দর বহিঃপ্রকাশ হয়; মা ও শিশুর মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক ও চিরস্থায়ী আত্মার বন্ধন তৈরি হয়। আর দুধের মাধ্যমে মায়ের আচার-আচরণ ও স্বভাবের আদান-প্রদান হয়, এ ব্যাপারে হাদিসে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের দুশ্চরিত্রা ও অপ্রকৃতিস্থ রমণীর দুগ্ধপান করানোর ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করো।’
শিশুস্বাস্থ্যের জন্য বুকের দুধ একটি সুষম খাদ্য। মাতৃদুগ্ধের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ করলে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালের প্রথম দিকে যেহেতু মাতৃদুগ্ধ পানরত শিশুরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আর্থিক অনুদান পেত না; সেহেতু মায়েরা শিশুদের জন্য অনুদান পাওয়ার আশায় তাড়াতাড়ি বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দিতেন। এ অবস্থা লক্ষ করে খলিফা হজরত ওমর (রা.) শিশুদের বুকের দুধ দানে মায়েদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে জন্মের পর থেকে এ আর্থিক অনুদান চালু করেন।
ইসলাম পরিপন্থী ভেজাল সংমিশ্রণের কৃত্রিম দুধ শিশুর জন্য মোটেই কল্যাণকর নয়। জীবাণুযুক্ত গুঁড়ো দুধ শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বর্তমানে বিষাক্ত মেলামিন মিশ্রিত কিছু গুঁড়ো দুধের বিজ্ঞাপন ও বিপণনের ওপর যেমন বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে, তেমনি শিশুর মায়ের দুধপানকে উৎসাহিত করা এবং সুরক্ষা করাও সবার কর্তব্য। কৌটার দুধ যেসব শিশু খায়, তারা প্রায়ই অসুস্থ হয় এবং তাদের মৃত্যুহারও বেশি। প্রথম ছয় মাস মায়ের দুধই শিশুর খাদ্য ও পানীয়ের চাহিদা মেটায়। ইসলাম মাতৃদুগ্ধ পান সম্পর্কিত শিশুদের অধিকারের বিষয়ে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় কল্যাণ ও সাফল্যের পথ বলে দিয়েছে। সে অধিকার যাতে কোনো কারণে খর্ব না হয়, এ ব্যাপারে অভিভাবকদের যথেষ্ট সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা ‘আজকের শিশু, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’।
 ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.