পঁয়ষট্টি বছর ধরে কবিতা লিখছেন আবুল হোসেন। তাঁর নব্বইতম জন্মবার্ষিকীতে এই বিশেষ রচনা- কবিতার এক জীবন by সাজ্জাদ শরিফ

আবুল হোসেন কবি হতে চেয়েছিলেন সুদূর ছেলেবেলা থেকেই। শৈশবে তাঁর মধ্যে কবিতার তৃষ্ণা জেগে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সূত্রে। স্কুলে ছাত্র ভালো ছিলেন। তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার সময় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় পেয়ে গিয়েছিলেন অনেকগুলো বই: যকের ধন, ঝিলে জঙ্গলে, লালকালো।’


জমজমাট সেসব গল্পের বই পড়তে পড়তে হাতে আরেকটি যে বই এসে ঠেকল, সেটি বড়ই বেখাপ্পা। নেহাত সাদামাটা সে বইয়ের পাতলা হলুদ মলাট। মলাটে লাল হরফে লেখা সোনার তরী। তার নিচে লেখা: শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ বইটি ঠিক অন্যগুলোর মতো নয়। তাতে কোনো কাহিনি নেই, ঘটনার আড়ম্বর নেই। কেবল গানের মতো সুরেলা কিছু কথা। সদ্য-কিশোর আবুল হোসেন একনিঃশ্বাসে পড়ে উঠলেন নামকবিতাটি। চকিতে বিদ্যুৎসঞ্চার ঘটে গেল তাঁর মধ্যে। আবুল হোসেন জানাচ্ছেন, “‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা’র গ, ঘ, র-এর ডম্বরু, ওরা আমাকে কোথায় যেন নিয়ে গেল। কোথায় তা জানি না। শুধু বুঝতে পারি ভেতরে ভেতরে কী একটা হচ্ছে।”
কবিতার সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম মুখোমুখি।
এর পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। আবুল হোসেনের বড় বোনের বিয়ে। সেকালে বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়দের মধ্যে বিতরণের জন্য পুস্তিকা বেরোত। তাতে মজা করে লিখত বরকনের নিকটজনেরা। সে পুস্তিকার জন্য জীবনের প্রথম কবিতাটি লিখলেন তিনি। কীভাবে কীভাবে যেন কবিতাটি গিয়ে পড়ল তাঁর স্কুলের বাংলা শিক্ষক চারুবাবুর হাতে। চারুবাবু ভারিক্কি মেজাজের মানুষ। বাংলা পড়াতেন। কবিতাটি হাতে নিয়ে ক্লাসে গম্ভীর হয়ে চারুবাবু সেটি পড়লেন। পড়া শেষ করে আঙুলের ইশারায় ডাকলেন আবুল হোসেনকে। আবুল হোসেনের বুক তখন ঢিবঢিব করছে। কিন্তু চারুবাবুর গলায় ঝরে পড়ল অনিঃশেষ স্নেহ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা তুই লিখেছিস? এসব তুই কোথায় পেলি?’ আবুল হোসেন জানালেন, এসব তাঁর মনে এসেছে, তাই লিখেছেন। চারুবাবু তাঁকে কাছে টেনে নিলেন। মাথায় হাত রেখে গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘তুই লিখে যা। আমি আশীর্বাদ করছি, তুই খুব ভালো করবি।’
এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। তত দিনে তাঁর সেরা বন্ধু হয়ে উঠেছেন গোলাম কুদ্দুস। তিনিও লেখেন। দুই বন্ধু মিলে নানা কাণ্ড করার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলেন কবিতা নিয়ে।
একদিন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি কবিতা লিখলেন আবুল হোসেন। শিরোনাম দিলেন ‘হে ধরণীর কবি’। কাউকে না জানিয়ে—এমনকি কাছের বন্ধু গোলাম কুদ্দুসের কাছেও গোপন রেখে—সেটি খামে ভরে পাঠিয়ে দিলেন রবিঠাকুরের উদ্দেশে। যদি কবি খুলে পড়েন কবিতাটি। যদি কিছু লিখে জানান। কিন্তু চিঠি আর আসে না। মাস চারেক পরে আশা যখন প্রায় নির্বাপিত, তখনই অকস্মাৎ তাঁর হাতে এ ছোট্ট একটি চৌকো চিরকুট। চিরচেনা অতি বিশিষ্ট সেই হস্তাক্ষরে তাতে লেখা একটিমাত্র শব্দ— ‘আশীর্বাদ’। নিচে স্বাক্ষর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ছোট্ট চিরকুট তাঁর একটি নির্জন দুপুরকে চিরদিনের মতো সোনায় মুড়ে দিয়ে যায়।
শুরু হলো আবুল হোসেনের নতুন জীবনের সূচনা।
আবুল হোসেনের সারাটা জীবন প্রায় শহরেই কেটেছে। তিনি লিখেছেন, ‘বলতে গেলে আমি শহরেই মানুষ। বেড়ে উঠেছি তিনটি ছোট-বড়-মাঝারি শহরে: কৃষ্ণনগর, কুষ্টিয়া ও কলকাতায়। বন্ধুর বাড়ানো হাতের মতো ইট-কাঠ-বালি-সিমেন্ট, কাচ, ধুলো-কাদা, কলের পানি, পিচের রাস্তা, খোলা নর্দমায় আকীর্ণ আমার শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো।’
কিন্তু শহরে বেড়ে উঠলে কী হবে, আবুল হোসেনের জন্ম হয়েছিল গ্রামে। বাগেরহাট তখন খুলনার একটি মহকুমা। সেই বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার আড়ুয়াভাঙা গ্রামের নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। জন্মের পর কৈশোরে আর একবার মাত্র সেই গ্রামে যাওয়া হয়েছিল তাঁর। তবু অকিঞ্চিৎকর সেই গ্রামের কাছেই তাঁর জন্মের ঋণ। শ্রাবণের এক বৃষ্টিহীন সকালে তাঁদের জন্ম হয়। তাঁদের বলতে আবুল হোসেন আর তাঁর এক বোনের। তাঁরা দুই ভাইবোন একত্রে এই পৃথিবীতে আসেন। মায়ের মুখে শুনেছেন, সামান্য একটু আগে-পরে। প্রথমে বোন, তারপর তিনি।
সেই প্রজন্মের আরও বহু বাঙালি মুসলমানের মতো আবুল হোসেনও তাঁর জন্মতারিখ নিশ্চিত করে কখনো জানতে পারেননি। মা বলতে পারেননি স্পষ্ট করে। শুধু বলেছিলেন, তাঁর জন্ম হয়েছিল ঝড়ের বছর, শ্রাবণ মাসের ১৫ তারিখে। বাবা বলেছেন, দিনটি ১৯২২ সালের আগস্ট। আগস্ট মাস শ্রাবণেই পড়ে। মায়ের তারিখ আর বাবার বছর নিয়ে তাঁর জন্মতারিখ হয়ে দাঁড়ায় ১৫ আগস্ট ১৯২২।
শিক্ষাজীবনে বা সরকারি নথিপত্রে অবশ্য এ তারিখের কোনো অস্তিত্ব রইল না। স্কুলে প্রথম ভর্তি করতে গিয়ে ভর্তির ফরমে বাবা জন্মতারিখ লিখেছিলেন ১ ফেব্রুয়ারি ১৯২২। কোত্থেকে এল এ তারিখ, সেটা তাঁর কাছেও এক রহস্য। কিন্তু কাগজে-পত্রে, দলিলে-নথিতে তাঁর জন্মতারিখ ১ ফেব্রুয়ারি হয়েই থেকে গেল। তবু জন্মদিন হিসেবে তাঁর মনে এখনো জায়গা করে আছে ১৫ আগস্ট তারিখটিই।
স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আবুল হোসেন কলকাতায় এসে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন গদ্যকবিতা লিখতে শুরু করেছেন। ছন্দমিলের তুলনায় রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা আবুল হোসেনের কাছে সরস লাগেনি। প্রেসিডেন্সি কলেজের ম্যাগাজিনে ‘রবীন্দ্রনাথ ও গদ্যকবিতা’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ লিখলেন তিনি। লেখাটি শিক্ষকেরা খুবই পছন্দ করলেন। ছাত্রমহলে তাঁর পরিচিতিও বাড়ল। সে প্রবন্ধ পরে তিনি আরও মার্জনা করলেন। দীর্ঘ সেই প্রবন্ধ দুই কিস্তিতে ছাপা হলো মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়।
বছরখানেক পর লেখাটি কেউ নজরে আনেন রবীন্দ্রনাথের। সেটির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনিও একটি লেখা লেখেন। তাতে আবুল হোসেনকে ‘মোহাম্মদীর লেখক’ বলে উল্লেখ করে তাঁর লেখার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজের যুক্তি পেশ করেন। লেখাটি প্রথমে তিনি পড়েন শান্তিনিকেতনের এক সাহিত্য আসরে। পরে সেটি প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের মতো মহীরুহের প্রতিক্রিয়ায় স্বভাবতই তিনি চুপসে যান। তবে কবির বক্তব্য তিনি তখনো মেনে নিতে পারেননি, এখনো নয়।
আবুল হোসেন জানাচ্ছেন, এটি সেই সময়, যখন রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন সব বিষয়ে ছন্দমিলে লেখা যায় না। কিছু কিছু বিষয়ের আশ্রয় গদ্যছন্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাট্টা করে তখন একবার সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বলেছিলেন, ‘মোরগ নিয়ে ছন্দেমিলে কবিতা লিখে দেখাও তো!’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সত্যি সত্যি মোরগ নিয়ে একটি কবিতা লিখে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়ে দেন তাঁর সুবিখ্যাত ‘কুক্কুট’ কবিতাটি।
যা হোক, আরও পরে, আবুল হোসেন গদ্যকবিতার প্রকৃত সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন সমর সেনের কবিতায়। আবুল হোসেন বলেন, ‘সমর সেনের কবিতা পড়লে মনেই হয় না যে ওর মধ্যে ছন্দ নেই। তাঁর কবিতায় অদ্ভুত একটি ছন্দঝংকার আছে। গদ্যকবিতার চাল আমি শিখেছি তাঁর কাছে।’
১৯৪০-এর দশক। শহর কলকাতা। বাঙালি মুসলমানদের হাতে আধুনিক সাহিত্য তখন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। এরও এক দশক আগে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতার অভিষেক ঘটেছে।
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের আবাস সে সময় কলকাতায়। আবু সয়ীদ আইয়ুব তখন মারাত্মক সব প্রবন্ধ লিখে কলকাতার বিদ্বৎমহলে তোলপাড় তুলে দিয়েছেন। এই আইয়ুবের সঙ্গে ওয়েলেসলি স্ট্রিটে তখন শওকত ওসমান প্রতিদিন হাঁটতে বেরোতেন। আইয়ুব একদিন শওকত ওসমানকে বললেন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে আসতে। তিনি তাঁদের মার্কসবাদে দীক্ষা দেবেন। শওকত ওসমান, আবু রুশদ, আবুল হোসেন আর গোলাম কুদ্দুস নিতে গেলেন সেই দীক্ষা। দু দিন ধরে চলল দীক্ষা গ্রহণ। দীক্ষা নিয়ে, বলাই বাহুল্য, সূচনা ঘটল নতুন এক বুদ্ধিবৃত্তিক সাহচর্যের। সেখানেই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য হলো সাহিত্যের আরেক দিকপাল সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে। আরও পরে এসে যোগ দিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও শামসুদ্দীন আবুল কালাম।
বাঙালি মুসলমানদের সেই আধুনিকায়নের কালে তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছেন সাতটি যুবক। কবিতায় ফর্রুখ আহমদ, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন আর গোলাম কুদ্দুস; কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান আর আবু রুশদ। আজাদ পত্রিকার উপসম্পাদক মুজিবর রহমান খান সকৌতুকে তাঁদের নাম দিলেন ‘সপ্তরথী’।
প্রথম যৌবনে যখন কবিতা লিখতেন আবুল হোসেন, তখন তার সবটাই হয়ে যেত রবীন্দ্রনাথের মতো। কলকাতায় আধুনিক কবিতার সংস্পর্শে এসে বুঝলেন, কবিতা হতে হবে এই রকম। আরও কিছুদিন পর উপলব্ধি করলেন, অন্যদের মতো করে লিখলে তো তাঁকে আলাদা করে চেনা যাবে না। এবার তিনি খুঁজতে শুরু করলেন নিজের এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর।
বাংলা কবিতা যে অতি সহজেই কাব্যিকতার পথ ধরে, আবুল হোসেন দ্রুতই সেটি বুঝে গিয়েছিলেন। তাই কবিতা থেকে আলগা কাব্যিকতা ঝেড়ে ফেলার ব্রত নিয়েছিলেন যৌবনেই। নিজের কণ্ঠস্বর রপ্ত করার সাধনায় তিনি কবিতা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন বাড়তি সব রং, অযথা সব আবেগ। কবিতার ভাষাকে গড়াপেটার জন্য ধরতে চাইলেন পথচলতি মানুষের আটপৌরে শব্দ আর কথা বলার ভঙ্গি। পুরো কবিজীবনে এই ছিল তাঁর মূল সাধনা। এক সমালোচক তাঁর কবিতার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, আবুল হোসেন আবেগকে বাঘের মতো ডরান।
আবুল হোসেন কবিতা লিখছেন প্রায় পঁয়ষট্টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কবিতাচর্চাকে কখনো দূরে ঠেলে দেননি। তবে পাদপ্রদীপের আলোর নিচে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা তিনি কখনো করেননি। ধীরে ধীরে তৈরি করে গেছেন কবিতার স্বতন্ত্র এক ভাষা, যা একই সঙ্গে স্ফটিকস্বচ্ছ এবং স্ফটিক-কঠিন।
৯০ বছরে কবিতার এই নিরলস অভিযাত্রীকে সালাম।

No comments

Powered by Blogger.