ঢাকা আর্ট সেন্টার- সমকালীন শিল্প পাঠ by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

গত দুই দশক ধরে সমকালীন বাংলাদেশের শিল্পরচনায় বিষয় ও মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়। এ প্রদর্শনীতে শিল্পকলায় বহুবিধ নিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট। সমকালীন ভাবনায় সৃষ্ট ২১ জন শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ নিয়ে ১০ আগস্ট ঢাকা আর্ট সেন্টারে শুরু হয়েছে দলীয় প্রদর্শনী।


ব্যক্তিগত জীবনবোধ, সমাজ-ভাবনা, মানুষের জীবনাচরণের বিভিন্ন দিক প্রকাশ পেয়েছে এসব শিল্পকর্মে। তেলরং, অ্যাক্রিলিক, মিশ্র মাধ্যম, স্থাপনাশিল্প, ছাপচিত্রের নানা মাধ্যমে শিল্পীরা কাজ উপস্থাপন করেছেন। এ প্রদর্শনীতে শিল্পের পরিশীলিত রূপ প্রকাশ পায়নি কিন্তু সমকালীন ভাবনায় সৃষ্ট শিল্পকর্মগুলোতে প্রত্যেক শিল্পী নিজস্বতা বজায় রেখেছেন। এসব শিল্পকর্মে শিল্পীদের পথযাত্রা সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল তাঁর কাজে বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন মানুষের ওপর মানুষেরই আগ্রাসী আচরণ। কাগজের গায়ে মিশ্র মাধ্যমে করা ছবিগুলোতে মানুষই প্রধান। মানুষের দেহে আঘাত হানছে আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড, ধারালো অস্ত্র। আনিসুজ্জামানের ‘বাউন্ড টু এনজয়’ শিরোনামের দুটি কাজেই চিত্রতলে বিষয় সাজিয়েছেন স্পেস ছেড়ে দিয়ে। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান কাগজে মিশ্র মাধ্যমে করেছেন দুটি কাজ। ক্যানভাসে তেলরঙে এঁকেছেন তিনটি ছবি। জ্যামিতিক আকৃতি উলম্ব ও আড়াআড়ি হয়ে চলাচল করছে স্থির হালকা ছাইরঙের জমিনে। গাঢ় রঙের রেখা প্রকাশ করছে শিল্পীর অন্তর্গত অনুভূতি। ওয়াকিলুর রহমানের ছবির শিরোনাম টি ১, ২, ৩, ৪, ৫। আবদুল হালিম চঞ্চল অ্যাক্রিলিকে দুটি কাজ করেছেন। জয়া শাহরিন হকের স্থাপনাশিল্প ‘ধ্যান, জ্ঞানবিশ্ব সংসার’।
রফি হক ছাপচিত্রে বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্বপ্নের প্রার্থনা। কোমল রঙের জমিনে সূক্ষ্ম রেখার প্রয়োগে ছন্দের রূপ প্রকাশ পেয়েছে। ‘ইমেজ অব এক্সপ্রেশন ইন সাইলেন্স’ শিরোনামের সাতটি ছবিতে নীরবতার অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করা হয়েছে। এক ফ্রেমে অনেক ইমেজকে উপস্থাপন করে রফি হক তাঁর নিজস্ব করণ-পদ্ধতি অক্ষুণ্ন রেখেছেন। রশিদ আমিন ছাপচিত্রের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় কাজ করলেও এ প্রদর্শনীর কাজগুলো মিশ্র মাধ্যমে করা। হালকা রঙের সঙ্গে জ্যামিতি ও রেখার সম্পর্ক রশিদ আমিনের কাজে প্রধান হয়ে উঠেছে। সহিদ কাজী দুটি ক্যানভাস পাশাপাশি রেখেছেন। শিরোনাম ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ বা ‘মা ও শিশু’। গাঢ় কালো জমিনে দুটি ক্যানভাসের একটিতে শিশু ও অন্যটিতে মায়ের অবয়ব। দুজন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে চিত্রতলের রঙের মাধ্যমে। প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আবদুস সাত্তার তৌফিকের ‘যখন অন্য বেদনা মস্তিষ্কে’। ক্যানভাসের রং হুবহু রেখে চারকোলে রেখার সাহায্যে গতি তৈরি করেছেন শিল্পী। কালো রঙের চারকোলে জ্যামিতি আর স্থূল ও সূক্ষ্ম রেখায় শিল্পী বেদনার রূপ প্রকাশ করেছেন। রঘুনাথ সূত্রধর ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে বাস্তব রীতিতে এঁকে চৌকোনো আকৃতির সাহায্যে বাস্তবধর্মী বিষয়ে বিভ্রম তৈরি করেছেন। ছবির শিরোনাম ‘কনটেমপরারি রিয়েলিটি’ বা সমকালীন বাস্তবতা। হাসপাতালে বেদনার্ত মানুষের আর্তনাদ মানুষের জীবনযাপনে এ বেদনাভরা মুহূর্তকে শিল্পী তুলে ধরেছেন দুটি ক্যানভাসে। শিশির ভট্টাচার্যের ‘শিরোনামহীন’ ক্যানভাসে স্থূল রেখার সাহায্যে বিষয়ের উপস্থাপন করেছেন গাঢ় রঙে। রুহুল করিম কাঠখোদাই ‘হুইল অব ঢাকা’ শিরোনামের ছবিতে রিকশার চাকাকে উপস্থাপন করেছেন। কাঠের বুনটের আশ্রয়ে বাস্তবধর্মী রিকশা ঢাকার গতিকে শিল্পী ভেঙেছেন সচেতনভাবে। নানা মাধ্যমের ব্যতিক্রমী এ প্রদর্শনী শেষ হবে ২৭ আগস্ট। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন আবদুল হালিম চঞ্চল, আবদুস সালাম, আবদুস সাত্তার আলী আকবর, আনিসুজ্জামান সোহেল, অনুকূলচন্দ্র মজুমদার, অসমিতা আলম, জয়া শাহরিন হক, মনিকা জাহান বোস, নিত্যানন্দ গাইন, রফি হক, রশিদ আমিন, রত্নেশ্বর সূত্রধর, রোকনুজ্জামান, রুজভেল্ট বিডি রোজারিও, রুহুল করীম, সহিদ কাজী, সাব্বির আলম, সনজীব দত্ত, শিশির ভট্টাচার্য্য, ওয়াকিলুর রহমান।

No comments

Powered by Blogger.