বুয়েট শিক্ষক নেতাদের সরকার অচলের হুমকিতে তোলপাড় by বিভাষ বাড়ৈ

‘আমাদের কথামতো না চললে সরকার অচল করে দেব, বঙ্গবন্ধু সেতু ও বিমানবন্দরের সংস্কারকাজ বন্ধ করে দেয়া হবে’Ñবুয়েট শিক্ষক নেতাদের এমন হুমকিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। হুমকিদাতা জামায়াতী শিক্ষককে রক্ষা ও অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত করতে গভীর রাতে ক্যাম্পাসের একটি হলে জরুরী বৈঠক করেছে বুয়েট শিক্ষক সমিতির জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরপন্থীরা।


প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকির পর এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিশিষ্টজনদের সামনে শিক্ষামন্ত্রীকে হুমকি দিয়েছে শিক্ষক সমিতির নেতারা। আর এ হুমকি দেয়ার ঘটনায় কঠোর এ্যাকশনে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সরকার। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটা এখন পরিষ্কারÑ শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের পেছনে ক্যাম্পাসের বাইরের শক্তির হাত আছে। শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে ভুল তথ্য দিয়েই এতদিন খেপিয়ে রাখা হয়েছিল। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ১৫ দিনেও বুয়েটের মৌলবাদী শিক্ষক নেতা হাফিজুর রহমান রানা গ্রেফতার না হওয়ার ঘটনায় হতবাক প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষক সমিতির লাগাতার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ বলেছেন, বুয়েটে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকারের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে শিক্ষক সমিতির গণপদত্যাগের হুমকি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর সম্মানে চলমান আন্দোলন ২ দিন বন্ধ রাখা হয়েছেÑ শিক্ষক সমিতির এমন মন্তব্যকে বিভ্রান্তিকর অভিহিত করে তিনি বলেছেন, আমার সম্মানে আন্দোলন বন্ধ রাখা নয়, আন্দোলনে মাঝেমধ্যে বিরতি না দিয়ে আন্দোলন চালানো যায় না। সেটি তাঁর ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া সমীচীন হয়নি। বরং তাঁদের সিনিয়র শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রকৌশলীদের সম্মানে তাঁরা আন্দোলন প্রত্যাহার করতে পারতেন। তা না করে আমাকে সম্মান দেখানোর কথা বলে দুদিন বিশ্রাম নিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। বুয়েটের সাবেক উপাচার্যবৃন্দ, এ্যালামনাই, সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সমাধানের পথে এগোনোর ৪০ মিনিটের মধ্যে সভা ডেকে শিক্ষক সমিতি নেতারা গণপদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুয়েটের মতো একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকদের গণপদত্যাগের হুমকি দেশবাসী প্রত্যাশা করেন না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই বুয়েট সমস্যার সমাধান হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, যুগ্ম সচিব আহসানুল জব্বার প্রমুখ। শিক্ষকরা গণপদত্যাগ করলে বুয়েট কিভাবে চলবেÑ সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দেখা যাক না কী করে চলে। শিক্ষামন্ত্রী অভিযোগ করেন, বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষকরাই সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে বাধা সৃষ্টি করেছেন। এখন তাঁরাই বিবেচনা করবেন কিভাবে তা দূর করবেন। বুয়েট পরিস্থিতি সমাধানে সরকার ‘আপ্রাণ’ চেষ্টা করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিক্ষকরা আন্দোলন কর্মসূচী দুই দিনের বিরতি দিয়ে হুমকি অটুট রেখে তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন। আমার প্রতি তারা সম্মান দেখিয়ে দু’দিন কর্মসূচী বিরতি দিয়েছে। এ ধরনের সম্মান দেখানোর মাধ্যমে দেশবাসী বিভ্রান্ত হবে। তাই আপনাদের ডেকেছি। দু’দিন আন্দোলন স্থগিত রাখা বড় বিষয় নয় উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, এর আগে তারা বলেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে তাঁরা আলোচনায় বসবেন না। সমস্যা সমাধানে বুয়েটের সাবেক উপাচার্য ও সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে আমরা সভা করলাম। কিন্তু তাঁরা আমাদের সভাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছেন। সকলকে সম্মান দেখানো যেখানে সম্ভব ছিল সেখানে তারা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে বাধা সৃষ্টি করেছেন। দু’দিন কর্মসূচী স্থগিত রেখে আমাকে সম্মান দেখানোর মানে নেই। আন্দোলনরত শিক্ষকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, তাঁরা আমাকে বোকা ভাবতে পারেন, কিন্তু দেশবাসী তো আর বোকা নয়। গণপদত্যাগ করার চেয়ে আর চরম কি হতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয় অচল হবে, ধ্বংস করা হবে এই পথেই তারা এগোচ্ছে।
শিক্ষক সমিতির দু’দিনের আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিতের ঘোষণাকে ‘বিশ্রাম’ অ্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমারও ৫২ বছরের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আছে। আন্দোলনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরিয়ে দিলেও বুয়েট উপাচার্যের বিষয়ে দীর্ঘদিনেও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না কেনÑ জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককালে শিক্ষক সমিতির জামায়াতপন্থী নেতা ও ডিন ড. জাকারিয়া এবং নেত্রী ও বিভাগীয় প্রধান জেবুন্নাসরিনের প্রকাশ্য হুমকি দেয়ার ঘটনা নিয়ে সরকারের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকির ঘটনার পর এ ধরনের ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সরকারের উচ্চমহলে। বৃহস্পতিবার সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের সর্বশেষ অবস্থা জানান। জানা গেছে, বৈঠকের প্রারম্ভেই উত্তেজিত বক্তব্য শুরু করেন ড. মুহাম্মদ জাকারিয়া। শিক্ষক সমিতির আল্টিমেটাম অনুযায়ী অনতিবিলম্বে ভিসি ও প্রো-ভিসিকে অপসারণের দাবি করে শিক্ষামন্ত্রীর দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে তিনি বলেন, ‘দাবি কিভাবে আদায় করতে হয় আমরা জানি। সরকার তাদের অপসারণ না করলে আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সংস্কারকাজ বন্ধ করে দেব। দেশ অচল হয়ে পড়বে। তাতে সরকার বাধ্য হবে দাবি মানতে। দেশের সম্মানিত ব্যক্তিরা, বুয়েটের ৩ সাবেক ভিসি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, ইউজিসির চেয়ারম্যান ড. একে আজাদ চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ ধরনের বক্তব্যে স্তম্ভিত হয়ে যান সকলেই। তাঁর এই বক্তব্যের পর পর প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সূত্র জানায়, হুমকি শুনে উত্তেজনায় কাঁপছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি ওই শিক্ষকের কাছে জানতে চান, আপনি কি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন? দেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে এনে আমরা বসেছি সমস্যা নিরসনের উপায় খুঁজতে। আমি তো কোন ঠিকাদারকে ডাকিনি। আমি শিক্ষকদের ডেকেছি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইন আছে, নিয়ম আছে। ইচ্ছা করলেই কেউ কিছু করতে পারে না। আপনি দেশ অচল করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। আমাদের প্রচেষ্টা ভ-ুল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। আপনারা শিক্ষকতা রেখে আর কত কী করেন? এখানে ঠিকাদারি নিয়ে আসছেন কেন? আমরা আপনাদের কাছ থেকে শিক্ষকসুলভ আচরণ আশা করি। শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর চুপসে যান হুমকিদাতা শিক্ষক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই উত্তেজিত হয়ে সরকারকে হুমকি দেন সমিতির এক নেত্রী। জানা গেছে, জামায়াতপন্থী এই নেত্রীর বাবা ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। এদিকে কদিন ধরে শিক্ষক সমিতি নেতারা গণপদত্যাগের নামে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে মাঠ গরম করলেও গত দুদিনে পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। এরই মধ্যে আন্দোলন থেকে সরে গেছেন অনেক শিক্ষক। এসব শিক্ষকের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও রয়েছে। সূত্র জানায়, এক ফরমেটে পদত্যাগপত্র টাইপ করে তা ফটোকপি করে আন্দোলনরতরা সব শিক্ষকের স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করছেন। একাধিক শিক্ষক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরে সম্মত হননি বলে জানা গেছে। সোমবার শিক্ষক সমিতির বৈঠকের পর অনেক শিক্ষকের কাছ থেকে জোর করে ভয় দেখিয়ে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। বৈঠকের পর কক্ষের ভেতর আটক রেখে বিশেষত জুনিয়র শিক্ষকদের চাপ দিয়ে স্বাক্ষর নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজন চাপ দেয়ার পরেও স্বাক্ষর করেননি বলে জানা গেছে। এছাড়া পদত্যাগের নামে যে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে তার সর্বশেষ নজির স্থাপন করেছেন সিভিল বিভাগের পদত্যাগকারী ডিন ড. জাকারিয়া। ডিন পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বলে প্রচার করে মাঠ গরম করলেও ১৬ জুলাই তিনি ডিন হিসেবেই কাগজে স্বাক্ষর করেছেন এবং নিয়মিত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া এমএমইর পদত্যাগী বিভাগীয়প্রধান অধ্যাপক মোহর আলী ১৭ জুলাই বিভাগীয় প্রধান হিসেবেই কাগজে স্বাক্ষর করেছেন এবং নিয়মিত কাজ করেছেন। অথচ গণমাধ্যমের কাছে প্রচার করছেন তাঁরা ডিন ও বিভাগীয়প্রধানের পদে নেই।
তবে প্রধানমন্ত্রীকে ফেসবুকে হত্যার হুমকির মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ১৫ দিনেও শিক্ষক নেতা হাফিজুর রহমান রানা গ্রেফতার না হওয়ার ঘটনা নিয়ে হতবাক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, শিক্ষক সমিতির নেতারা নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রক্ষার অপচেষ্টা করলেও ৫ জুলাই নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই বিতর্কিত শিক্ষকের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। ডিবির তদন্তে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পর দ-বিধির ৫০৬ ও তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭(১) ধারায় মামলা দায়ের করলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়ে হাফিজুর রহমান রানা স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘হায়েনা ওই হায়েনা তুই দেশকে খেয়েছিস, এখন তুই বুয়েটকে খাবি... পারবি না... আমরা বুয়েটের শিক্ষকরা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছি শিকারি। প্রথমে তোর মাথাতে গুলি করব তারপর তোর পেটে। তারপর তোর মাথা কেটে বুয়েটের গেটের সামনে টানিয়ে রাখব। যাতে আর কোন হায়েনার আক্রমণে বুয়েট আক্রান্ত না হয়।’

No comments

Powered by Blogger.