চারদিক- আজ নীল চাঁদের রাত by মশহুরুল আমিন

ক্ষুধার্ত চাঁদের সময় থেকেই বরফগুলো ধীরে ধীরে নরম হতে হতে জলের ধারায় গড়িয়ে বেড়ায়। চারদিকে ফুল-ফল, কীটপতঙ্গের উৎসব। জলাধারগুলো পূর্ণ হতে হতে ব্যাঙেদের আনাগোনা... কিচ্ছুই বোঝা গেল না? আরে তাই তো! এই কথাগুলো কিন্তু আমার নয়।
এগুলো হচ্ছে আমেরিকা মহাদেশে বসবাসকারী আদিবাসী, এই যেমন আনাসাজি, ইনকা, আজটেক, টুকানা—তাদের কথা। তাদের সময় গণনা চলত চাঁদের হিসাবে। নতুন চাঁদ বা পূর্ণ চাঁদ এগুলোর হিসাবেই চলত সময় গণনা।
ফেব্রুয়ারিতে বরফ গলছে আর একে একে দীর্ঘ শীতনিদ্রা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে ক্ষুধায় কাতর সব ভালুকশাবক। সে সময়ের পূর্ণ চাঁদের নাম হচ্ছে ‘ক্ষুধার্ত চাঁদ’। মার্চে প্রকৃতি ফুল ফল পোকামাকড়ে ভরে উঠছে। আর তাই মার্চের পূর্ণ চাঁদ হচ্ছে ‘পোকার চাঁদ’। এভাবে আছে নেকড়ে ব্যাঙ স্ট্রবেরি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব গণনা চলত তাদের কৃষিকাজ শুরু বা শেষের সময়ের হিসাবের জন্য।
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। আমাদের এখন নীল চাঁদের গল্প বলো।’
প্রতি সাড়ে ২৯ দিন পর পর আমরা পূর্ণিমা দেখি। মানে পূর্ণিমার প্রায় ৩০ দিন পর আবার পূর্ণিমা।
এই আগস্ট মাসের ২ তারিখ সকালে পূর্ণিমা হয়েছিল। এরপর আবার এই আজই ৩১ আগস্ট রাতেই হচ্ছে পরবর্তী পূর্ণিমা। এই যে একই মাসের মধ্যে দুটি পূর্ণিমা দেখা যাচ্ছে। বর্তমান মাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমার চাঁদকে নীল চাঁদ বলে ডাকা হয়।
না, আজ রাতের এই চাঁদটি দেখতে কিন্তু নীল নয়।
তা হলে নীল চাঁদ বলে ডাকা কেন?
আর কি, আহ্লাদ আর ভালোবাসায় ভাসিয়ে এই নামকরণ ‘নীল চাঁদ’।
এই নীল চাঁদ কিন্তু প্রতি মাসেই দেখা যায় না। প্রতি দুই-তিন বছর পর পর এই নীল চাঁদ দেখা যায়। এই যেমন শেষবারের মতো নীল চাঁদ দেখা গেছে ২০১০ সালের ৩০ মার্চ। আবার পরবর্তী নীল চাঁদ দেখা যাবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই।
আরে! দারুণ একটা কথা তো বলাই হয়নি।
২০২৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখের পূর্ণিমাটি নীল চাঁদ। আর সে রাতেই থাকবে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ।
‘এবার বলবে কী, এই নীল চাঁদ শব্দটি কীভাবে এল?’
১৯৪৬ সালের কথা। জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক পত্রিকা স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ-এ একটি লেখায় জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস হুগ ১৯৩৭ সালের পঞ্জিকা অনুসরণে ‘নীল চাঁদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন, যা পরবর্তী সময়ে ১৯৭০ সালে ছোটদের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের মাধ্যমে এলিস এবং সিগল এই ‘নীল চাঁদ’ শব্দটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
এবার একটু নীল চাঁদবিষয়ক অতিরিক্ত কিছু জানার চেষ্টা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে ৩১ আগস্ট নীল চাঁদ দেখে আবার এই ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে কোরিয়া বেড়াতে গেলে, সেখান থেকেও নীল চাঁদ দেখা যাবে! একই বছরে দুবার নীল চাঁদ দেখা!!
নিশ্চয় জানা আছে, বাংলাদেশের সময় জোন বা রেখা হচ্ছে +৬ আর কোরিয়া হচ্ছে +৯। ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায় চাঁদের ১০০ ভাগ অংশই আলোকিত হবে বা পূর্ণিমা শুরু হবে। সেই বাংলাদেশের রাত নয়টা মানে কিন্তু কোরিয়ার রাত ১২টা মানে সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ শুরু। ফলে কোরিয়ায় পরবর্তী পূর্ণিমা হবে সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে। মানে আরও একটি নীল চাঁদ! +৯ মানে কিন্তু শুধু কোরিয়া নয়, সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া অস্ট্রেলিয়া আর অ্যান্টার্কটিকা ও সাইবেরিয়ার কিছু অংশ ইত্যাদি...।
এই নীল চাঁদের মাসেই আমাদের মাঝ থেকে শারীরিকভাবে আর নেই, এই মানবজাতির প্রথম প্রতিনিধি নিল আর্মস্ট্রং। যিনি ১৯৬৯-এর ২০ জুলাই আমাদের এই পৃথিবীর সবার পক্ষ থেকে প্রথম চাঁদের বুকে ছোট্ট একটি পদচিহ্ন এঁকে দেন।
নীল চাঁদের মাসে নিল আর্মস্ট্রং নেই আমাদের মাঝে। আর তাই বুঝি বেদনার রং হয়ে যায় নীল!
আমরা নীল চাঁদের আলোয় টেলিস্কোপ দিয়ে নীল চাঁদ দেখতে দেখতে নিল আর্মস্ট্রংয়ের চন্দ্র অভিযান নিয়ে কথা বলতে পারি।
‘আজ রাতে নীল চাঁদের আসর কোথায় হবে?’
ধানমন্ডি ৮ নম্বর রোডের শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব খেলার মাঠ থেকে এই নীল চাঁদ দেখার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন। সময় সূর্যাস্ত থেকে রাত ১১টা ৫৯ পর্যন্ত।
‘সবাই আসতে পারবে এখানে?’
সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে। তবে আকাশ কিন্তু মেঘমুক্ত থাকতে হবে। তবেই দেখা যাবে নীল চাঁদকে।
আমি যাব, আমরা যাব।
আপনি আসছেন তো?
সবার মেঘমুক্ত আকাশের প্রত্যাশায় ...
মশহুরুল আমিন

No comments

Powered by Blogger.