সোনালী ব্যাংকে আরো ৩০০ কোটি টাকার জালিয়াতি

সোনালী ব্যাংকের গুলশান ও আগারগাঁও শাখায়ও প্রায় একই ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। আর এতে করে আরো প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতছাড়া হয়েছে ব্যাংকটির। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের সময় এ বিষয়টি ধরা পড়ে। গত ২৬ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে এ জালিয়াতির বিষয়টি তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক।


তএ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনানশিয়াল ইন্টিগ্রেটেড অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গুলশান ও আগারগাঁও শাখায় জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটেছে ২০১১ সাল থেকে এ বছরের মে পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে। তবে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এসংক্রান্ত যে দাবি বা ক্লেইমগুলো এসেছে সেগুলোর কোনো রেকর্ড তাঁদের শাখায় নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ কথা বিশ্বাস করে না।'
এদিকে হোটেল রূপসী বাংলা শাখায় সংঘটিত তিন হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকার (সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী) আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বাকি ২৯ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে সোনালী ব্যাংক গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো তা জানানোর জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে আরো কিছুটা সময় চাইছে সোনালী ব্যাংক। তবে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সময় চেয়ে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও মুখ খোলেননি।
গুলশান ও আগারগাঁও শাখার অনিয়ম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের গুলশান শাখার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালিত পরিদর্শনে দেখা গেছে, কোনো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই একই স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিলম্বিত ঋণপত্র স্থাপন করে ব্যাংকের টাকা সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ওই শাখা থেকে মেসার্স রোর্জবার্গ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অনুকূলে রূপসী বাংলা শাখার স্বীকৃত বিল কেনা হয়েছে, যা নিয়মের মধ্যে নেই। মেসার্স লিমরা জেনারেল ট্রেডিংয়ের অনুকূলে স্বীকৃত বিল সৃষ্টির মাধ্যমে ১০৬ কোটি ৪১ লাখ টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রূপসী বাংলা শাখা কর্তৃক স্বীকৃত মেসার্স এলএনএস গোষ্ঠীভুক্ত সাতটি প্রতিষ্ঠানকে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই প্রায় ৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা অভ্যন্তরীণ বিল কেনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা গুরুতর অনিয়ম।
আগারগাঁও শাখা থেকেও একইভাবে গ্রীন প্রিন্টার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৪১ কোটি মূল্যমানের অভ্যন্তরীণ ঋণপত্র সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক ও আগারগাঁও শাখার পাঁচ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গত বুধবার সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, 'এই শাখাগুলোতে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমাদের শাখায় যে রেকর্ড রয়েছে সেই টাকাটা আমরা নিয়মিত করেছি। কিন্তু বাকি টাকার কোনো রেকর্ড ব্যাংকের শাখায় নেই। কিন্তু বাইরে থেকে এ বিষয়ে যে দাবি এসেছে সে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এ জন্য আমরা ফাংশনাল অডিটরও নিয়োগ দিয়েছি। ১০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন আমাদের হাতে পাঠানো হবে। প্রতিবেদন হাতে পেলে বুঝতে পারব এখানে আমাদের দায়-দায়িত্বটা কী।'
২৯ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, এ জন্য আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন। তবে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জোর দিয়ে বলেন। উল্লেখ্য, এ ঘটনায় রূপসী বাংলা শাখার তিন কর্মকর্তাকে আগেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের তিন শাখায় একই ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় বের হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে সেই কর্মকর্তাদের দ্রুত সাময়িক বরখাস্ত করা প্রয়োজন। এটা কোনো শাস্তি নয়। এর উদ্দেশ্য এটা যে ওই কর্মকর্তারা যেন ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা।'
তিনি আরো বলেন, 'কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করার তুলনায় হাতছাড়া হয়ে যাওয়া টাকাটা উদ্ধার করার কাজ শুরু করাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা অর্থনৈতিক অপরাধ (ফিনানশিয়াল ক্রাইম)। এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে কিভাবে টাকা উদ্ধার করা যায় সেভাবেই এগোতে হবে।' তবে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আইনি সহায়তা নিতে অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.