নারী ও মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ ১৯৭১ সাল কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক গৌরবময় বছর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। একাত্তরের ভয়াবহতা নিয়ে অনেকেই রাজনৈতিক ফয়েদা ল লোটার চেষ্টা করেছে, এই নৃশংসতার ওপর রচিত হয়েছে বহু গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস।


ফলে নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচিতও হয়েছিল। এত কিছুর পরও এই যুদ্ধের পৈশাচিকতার একটি দিক বেশ অন্ধকারেই রয়ে গেছে। এই যুদ্ধে কয়েক লাখ নারীকে হারাতে হয় তার সম্মান-সম্ভ্রম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাবি করেছিলেন যে, পাকিস্তানী সেনাদের হাতে প্রায় দুই লাখ নারী সম্ভ্রম হারায়। নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচারের কথা বলার জন্য বলা হলেও এই দিকটি নিয়ে খুব একটা সরব হতে কাউকে শোনা যায়নি। তবে ইদানীং, একাত্তরের পাক সেনা ও তাদের সহযোগীদের হাতে এ দেশের অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম হারাবার কথা স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে হলেও সকল নীরবতা ভেঙ্গে আলোচনায় আসতে শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বিনা ডি কস্টার ‘নেশন বিল্ডিং, জেন্ডার এ্যান্ড ওয়ার ক্রাইম ইন সাউথ এশিয়া’তে (জাতি গঠন, জেন্ডার ও দক্ষিণ এশিয়ার যুদ্ধাপরাধ) ফুটে উঠেছে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের ওপর নৃশংসতার চিত্র। লেখিকা মন্তব্য করেছেন যে অনেক বছর পরে নারীদের সেই সব দুর্বিষহ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়া কতটুকু মানবিক কাজ তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেক পরে হলেও ক’বছর আগে বাংলাদেশে শহীদ নারীদের ওপর গবেষণা করেছেন জোবাইদা নাসরিন। প্রকাশিত হয়েছে শহীদ নারীদের নিয়ে লেখা বই। এগুলো সবই ইতিবাচক। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজসেবী ড. নীলিমা ইব্রাহিম ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করেন ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বইটি প্রকাশ করেছিল। একাত্তরের যুদ্ধে নির্যাতিত অনেক নারীর নিজের মুখের কথার ভিত্তিতেই তিনি বইটি লেখেন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে নারীবাদী লেখিকা ইয়াসমিন সাইকিয়া রচনা করেনÑ ‘ওমেন ওয়ার এ্যান্ড দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ।’ বইটি প্রকাশ করেছিল ওয়াসেন আনলিমিটেড। একাত্তরে অত্যাচারিত নারীদের মৌখিক বিবরণের ভিত্তিতেই বইটি লেখা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদী নেত্রী কমলা ভাসিন বহু জায়গায় একাত্তরের ঘটনা বলতে গিয়ে বলেছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলমান পাক সেনা ও তাদের দোসররা ধর্মের দোহাই দিয়ে যেভাবে নিজের ধর্মের নারীদের ধর্ষণ করেছে তা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। তিনি আরও বলেন যে পাকিস্তান পরিকল্পিতভাবে এদেশের মানুষের মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে দেবার জন্য নারীদের ওপর অকথ্য বর্বরতা চালিয়েছিল। যুদ্ধের একটি অস্ত্র ছিল গণধর্ষণ। কমলা ভাসিনের লেখায় উঠে এসেছে ধর্ষণের শিকার অনেক নারী কিভাবে পরিবারের পবিত্রতা রক্ষার্থে বাধ্য হয়েছে আত্মহত্যা করতে। মার্কিন নারীবাদী সুসান ব্রাউনমিলার দুটি বড় যুদ্ধের সময়কার নারী নির্যাতন বিশেষত ধর্ষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই দুটি যুদ্ধের একটি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আর অপরটি হচ্ছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। তাঁর রচিত ক্ল্যাসিক ‘এগেনস্ট আওয়ার উইল : মেন, উইমেন এ্যান্ড রেপ’ বইটিতে বলা হয়েছে যুদ্ধে নারীদের ধর্ষণ করার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিরোধী পক্ষের মনোবল ভেঙ্গে ফেলা। যারাই গবেষণা করেছেন ধর্ষিত নারীদের নিয়ে তারাই নিজের বিবেকের কাছে বার বার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন, একজন নারীর কাছে জীবনের কালো পর্বের কথা জানতে চাওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত। স্বাধীনতার পর পর অনেক ধর্ষিত নারীকেই তার পরিবার আর ঠাঁই দেয়নি। তাদের অনেকেই আত্মহত্যা করেছিল, অনেকে আবার বাধ্য হয়েছিল যৌনকর্মী হতে। ইতিহাসে আছে জার্মানি নাজি সৈন্যরাও ব্যাপকভাবে গণধর্ষণ চালিয়েছিল। তারা এভাবে গড়ে তুলেছিল একটি পতিতালয়। যেখানে যৌনতার জন্য ধর্ষণ করা হতো না বরং ধর্ষণের জন্য বিকৃত যৌনতা করা হতো। আমাদের দেশের ধর্ষিত নারীদের সম্মান জানানোর জন্য তাদের বীরাঙ্গনা উপাধি দেয়া হয়েছিল। ‘বীরাঙ্গনা’ অর্থ ‘যুদ্ধের বীর নারী’। কিন্তু উপাধি দিলেও সমাজ ও পরিজনরা তাদের মোটেই যোগ্য সম্মান বা ভালবাসা দেয়নি। তারা পদে পদে উপেক্ষিত হয়েছে আর অপমানিত হয়েছে। দেশের জন্য এত বড় ত্যাগের কথা তারা গর্বের সঙ্গে মাথা উঁঁচু করে বলতে পারেনি । সবচেয়ে কষ্টের বিষয় ছিল নিজের গর্ভজাত সন্তানদের ত্যাগ করা। স্বাধীনতার পরে অনেক নারী সমাজসেবী এগিয়ে আসেন। তারা ধর্ষণের ফলে জন্মানো অনেক শিশুর পুনর্বাসনের চেষ্টা করেন। মায়েদের কোল থেকে প্রিয় সন্তানটিকে বিচ্ছেদ করা ছিল ভীষণ কষ্টকর। কিন্তু শিশুদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে অনেক শিশুকেই পাঠিয়ে দেয়া হয় বিদেশে। বহু বিদেশীরা যুদ্ধ শিশু বা ওয়ার চাইল্ডদের দত্তক নিয়েছিলেন সেই সময়। আন্তর্জাতিক পরিম-লের অনেক বড় ব্যর্থতা হচ্ছে নারীর ওপর সংঘটিত অপরাধগুলোর আলাদাভাবে বিচার করতে না পারা। সকল যুদ্ধেই নারীদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার কিন্তু সেই নির্যাতনের কোন বিচার কখনই হয় না। আন্তর্জাতিক পরিম-লের অনেক বড় ব্যর্থতা হচ্ছে নারীর ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলোর আলাদাভাবে বিচার করতে না পারা। এমনকি যুদ্ধের পরে স্বাধীন দেশে এই সব অপরাধীর বিচার না করে তাদের পুনর্বাসিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছুই হতে পারে না। এমন ঘটনাও জানা গেছে যে যুদ্ধের পরে ‘বীরাঙ্গনা’ পরিচয় দেয়ায় অনেক নারীকে অপদস্ত হতে হয়েছে। তাই অনেক নারীই এই ধরনের ঘটনাগুলো প্রকাশ হবার ভয়ে অস্বীকার করে গেছে সবকিছু অথবা এই স্বাধীন দেশেও লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রেখেছে। কেবল একজন সাহসী নারী ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী গর্ব করে তাঁর ওপর সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন । তাঁর মতে, বীরাঙ্গনা বললে নারীর অবদানকে খাটো করে দেখা হয়। বরং নারীরা এভাবেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে বলেই তিনি মনে করেন। আজ তাই বাংলাদেশী নারীদের সংগঠিত হতে হবে নিজেদেরকেই একত্রিত হয়ে অন্যায়ের বিচার দাবি করতে হবে। আশা করা যায় বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচারকাজ চলছে যেখানে এই যুদ্ধকালীন সংঘটিত ধর্ষণের সুবিচার হবে ।

রানা সুলতানা

No comments

Powered by Blogger.