পদ্মা সেতু হবেই-জোর দিয়ে বললেন এডিবি কর্মকর্তা, অর্থমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী চুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে এডিবি জাইকা

'আজকের দিনে আপনাদের জন্য সবচেয়ে বড় সংবাদ হচ্ছে, পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে'- এ কথা বললেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) হুয়ান মিরান্ডা। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে নিজেদের করা ঋণচুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশকে আরো এক মাস সময় বাড়ানোর সম্মতির কথা জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার


হুয়ান মিরান্ডা ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে এ ঘোষণা দেন। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও গতকাল জোর গলায় বলেন, 'পদ্মা সেতু হবেই হবে।' কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও বলেছেন, 'পদ্মা সেতু আমরা নির্মাণ করবই।' ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রও চাইছে পদ্মা সেতু হোক। এক দিন আগেই ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা এ কথা জানিয়েছেন। আবার পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বাংলাদেশের সঙ্গে করা ঋণচুক্তি কার্যকরের মেয়াদ এক মাস বাড়াচ্ছে। আজ শুক্রবার চুক্তির এ নবায়ন হবে বলে জানা গেছে। ফলে সরকার, সহায়তাকারী সংস্থা, কূটনীতিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যেই নতুন করে আশা জেগেছে, পদ্মা সেতু হয়তো হবেই।
কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচের প্রায় অর্ধেক দেওয়ার কথা যে বিশ্বব্যাংকের, তাকে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে কি না, তা বলেননি অর্থমন্ত্রী, মিরান্ডা, ড্যান মজিনা বা অন্য কেউই। তবে এডিবি ও জাইকা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সরকার বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে বাড়তি এক মাস সময় পাচ্ছে। সরকার আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও জাপানের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন, অন্য ঋণদাতা সংস্থা ও সরকারের নানা তৎপরতার মধ্য দিয়ে এই এক মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল সকালে বৈঠকের পর এডিবির কর্মকর্তা হুয়ান মিরান্ডা সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবি এখনো আছে, থাকবে। পদ্মা সেতু হবে। বিকেলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের পরও মিরান্ডা একই কথা বলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'আজকের দিনে আপনাদের জন্য সবচেয়ে বড় সংবাদ হচ্ছে পদ্মা সেতু হবে। এ বিষয়ে আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। আপনাদের টাকা দরকার। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। আপনাদের পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে।'
ওদিকে গতকাল সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর অনেকটা হাসি-খুশি ও উৎফুল্ল মেজাজে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, 'পদ্মা সেতু হবেই হবে।' পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য চুক্তিবদ্ধ জাইকা কাল (আজ) শুক্রবারের মধ্যে ঋণচুক্তির মেয়াদ এক মাস বাড়াবে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আজ (গতকাল) সকালে এডিবির সুখবর তো আপনারা পেয়েছেন। কাল জাইকার সুখবরটাও পেয়ে যাবেন।'
আর জাতীয় প্রেসক্লাবে আলাদা এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করবই।'
গতকাল বিকেল ৩টা থেকে পৌনে ৪টা পর্যন্ত হুয়ান মিরান্ডার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ যখন বৈঠক করছিলেন, তখন সেখানে গিয়ে হাজির হন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির দায়ে সরে যাওয়া সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। পরে তিনি ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চলে যান। অন্যদিকে ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পর মিরান্ডা যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
হুয়ান মিরান্ডার সঙ্গে বৈঠকের পর ইকবাল মাহমুদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, 'এডিবি ও জাইকার ঋণচুক্তির মেয়াদ আজ শুক্রবার পর্যন্ত রয়েছে। আমরা আশাবাদী, কালকের (আজ শুক্রবার) মধ্যে ওই দুই সংস্থার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণচুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির একটি ইতিবাচক সংবাদ পাওয়া যাবে। কারণ, পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে দুই সংস্থারই আগ্রহ রয়েছে। এডিবির পক্ষ থেকে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।'
তবে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক ফিরছে কি না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি কেউ। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমরা একটা ডেলিকেট নেগোসিয়েশন (নিবিড় দরকষাকষি) করছি। বিষয়টি সুরাহার জন্য সবাই মিলে এক ধরনের দরকষাকষি চলছে। এই রকম অবস্থায় আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। আমার কিছু বলারও নেই। এসব নিয়ে প্রতিদিন আলোচনা হচ্ছে। প্রতিদিন কী আলোচনা হচ্ছে-না হচ্ছে, তা বলা উচিত নয়। তার পরও তো বলছি। এটা এক ধরনের টক শো হয়ে যাচ্ছে', হাসিমুখে বলতে থাকেন অর্থমন্ত্রী।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার বিবৃতি দেওয়ার কথা ছিল অর্থমন্ত্রীর। ওই দিন তা স্থগিত করে তিনি বলেছিলেন, আরো দুই দিন সময় আছে। তার পরই সরকারের অবস্থান জানানো হবে। সে হিসাবে আজ শুক্রবার তাঁর ওই বিবৃতি দেওয়ার কথা। তবে আগামী রবিবারের আগে যে তিনি বিবৃতি দিচ্ছেন না, গতকালই তা স্পষ্ট করেছেন এভাবে, 'আমি নিজের আয়কর বিবরণী তৈরির কাজে ব্যস্ত। ছুটির দিনে আর কথা হবে না।'

সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান পদত্যাগ করলেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে ফিরে আসবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। তাই মসিউর রহমানও পদত্যাগ করছেন না। অন্যদিকে মসিউর রহমান পদত্যাগ না করায় বিশ্বব্যাংক কোনো সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে না। এভাবেই দিন অতিবাহিত হচ্ছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি বাতিল করে। ঋণচুক্তি বাতিল হলেও ওই অর্থ এখনো বাংলাদেশের নামেই বরাদ্দ রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের অনুরোধে এডিবি ও জাইকা তাদের চুক্তি কার্যকরের মেয়াদ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ায়। এর মধ্যেই তারা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে অনুরোধ জানায় সরকারকে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হওয়ায় গত বুধবার সরকার ওই দুই সংস্থাকে আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই এক মাস করে মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সংস্থা দুটি। আর পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য চুক্তিবদ্ধ অন্য সংস্থা ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) অর্থায়ন নিয়ে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তা নেই বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.