বিপ্লবী লক্ষ্মী সেহগল

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর খুব কাছের সহযোদ্ধা, ব্রিটিশবিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেত্রী, বিশিষ্ট সমাজসেবী এবং চিকিৎসক ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল ছিলেন ভারতের জীবন্ত কিংবদন্তি। গত ২৩ জুলাই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর ইচ্ছে অনুসারে ভারতের কানপুরের মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্য তাঁর দেহ দান করা হয়।


ক্যাপ্টেন ডাক্তার লক্ষ্মী সেহগল জন্মগ্রহণ করেন ২৪ অক্টোবর, ১৯১৪ সালে। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। জানা যায় তিনি সিঙ্গাপুরের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি তাঁর কর্মজীবন ত্যাগ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এশিয়ায় এই প্রথম এ ধরনের নারীবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল এবং এই বাহিনীর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাও ছিল। এ দায়িত্বের পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী সংগঠন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীও ছিলেন। বিয়ের আগে তাঁর নাম ছিল লক্ষ্মী স্বামীনাথন। লক্ষ্মী সেহগল ভারতের জনগণের কাছে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী হিসেবে পরিচিত। বার্মার কারাগারে অবস্থানকালীন সময়ে র‌্যাংক হিসেবে তাঁকে এ পদবী দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কে. আর. নারায়ণ তাঁকে পদ্মবিভূষণ পদকে ভূষিত করেন।
অবিভক্ত ভারতের মাদ্রাজে ২৪ অক্টোবর, ১৯১৪ সালে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এস. স্বামীনাথন মাদ্রাজ হাইকোর্টে অপরাধ আইন চর্চা করতেন। তাঁর মা এ.ভি. অম্মুকুট্টি যিনি পরবর্তীতে অম্মু স্বামীনাথনরূপে পরিচিত, তিনি একজন সমাজকর্মী ছিলেন। পাশাপাশি কেরালার পালঘাট এলাকার আনাক্কারায় ঐতিহ্যবাহী বদক্কাথ পরিবার থেকে স্বাধীনতা কর্মী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৩৪ সালে সেহগাল মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। এর এক বছর পর গাইনোকোলজি বিষয়ে তিনি বিশেষ ডিগ্রী লাভ করেন । মাদ্রাজের সরকারী কস্তুর্বা গান্ধী হাসপাতালে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪০ সালের দিকে তিনি কয়েক বছরের জন্য সিঙ্গাপুরে ডাক্তার হিসেবে চাকরি করেন। এরপরে তাঁর বিয়ে হয়ে যায় কর্নেল প্রেম সেহগালের সঙ্গে। ১৯৪৭ সাল থেকে তিনি কানপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। সেখানে তিনি চিকিৎসা চর্চা ও ভারত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে আগত ব্যাপকসংখ্যক শরণার্থীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। সেহগাল দম্পতির কন্যা সুভাষিণী আলী একজন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক কর্মী। সুভাষিণী আলীর মতে, তাঁর মা কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন না ।

বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যোগদান
সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালীন সময়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। লক্ষ্মী ভারত থেকে সিঙ্গাপুরে অবস্থিত দরিদ্র শ্রমিকদের সেবার জন্য একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘে তিনি যোগ দেন এবং এতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সেই সময় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল । ১৯৪২ সালে জাপানী বাহিনী সিঙ্গাপুর দখল করে। আহত যুদ্ধবন্দীদের চিকিৎসা করার দায়িত্ব পড়ে লক্ষ্মীর ওপর । চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে যুদ্ধে আহত অনেকেই ভারতীয় স্বাধীনতা সেনাবাহিনী গঠনে উৎসাহী। ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর যান । সেখানে তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নারী রেজিমেন্ট তৈরির কথা বলেন। এতে করে অনেক নারীই ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। লক্ষ্মী ছিলেন তাদের একজন। তিনি নেতাজীর নারী রেজিমেন্ট গঠনের নীতিমালা সম্পর্কে বিস্তারিত শোনেন। এ নারী রেজিমেন্টই পরবর্তীকালে ইতিহাস বিখ্যাত ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট নামে পরিচিতি লাভ করে। নেতাজীর ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক নারী বিভিন্ন ব্রিগেডে অংশ নেয়। লক্ষ্মীও ব্যাংক পান ক্যাপ্টেন হিসেবে যা কিনা আজীবন তাঁর বিশেষ পরিচিতি হিসাবে রয়ে গেছে। ১৯৪৪ সালে ভারতের ন্যাশনাল আর্মি জাপানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বার্মার দিকে যাত্রা করে। প্রবল বাধার মুখে এই বাহিনী পিছু হাঁটতে বাধ্য হয়। এর ফলে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ইম্ফলে প্রবেশ করে। ১৯৪৫ সালে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং পরবর্তী এক বছর তিনি বার্মায় কারারুদ্ধ অবস্থায় থাকেন। দিল্লীতে বিচারের জন্য তাকে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৭১ সালে লক্ষ্মী সেহগাল সিপিআই (এম)-এ যোগ দেন ও রাজ্যসভায় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বিশাল ভূমিকা রাখেন। উদ্বাস্তু শিবির তদারকিসহ কলকাতায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা দেবার ব্যাপারে তিনি প্রধান ভূমিকা রাখেন। ১৯৮১ সালে সিপিআই (এম)-এর অখিল ভারতীয় জনবাদী মহিলা সমিতির নারী শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন বলে বিভিন্ন দলীয় কাজে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৮৪ সালে ভূপালের গ্যাস বিপর্যয়ের আক্রান্তদের তিনি চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন। এছাড়াও নানা ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি আগ্রহী ভূমিকা পালন করেন। ২০০২ সালে ভারতের চারটি বামপন্থী দল তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দেয়। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এ.পি.জে. আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে । এ বছরের জুলাই মাসে এই সংগ্রামী নেত্রী মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে এক কিংবদন্তির।

No comments

Powered by Blogger.