প্রসঙ্গ ইসলাম- নজরুল মননে সূফী চেতনা by অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

কাজী নজরুল ইসলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তাঁর কবি সত্তা নানা মাত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়েছে। সূফী চৈতন্য বিভাসিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু কাব্য কর্মে এবং ঐতিহাসিক অভিভাষণে। তাঁর এক পূর্ব পুরুষ বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে এসেছিলেন ইসলাম প্রচার করবার


জন্য। এখানেই পীরের দরগাহ্র খাদেম ছিলেন তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ। স্বাভাবিকভাবেই সূফী ধ্যান ধারণা ও আচার-আচরণের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে শৈশবেই। ৯ বছর বয়সকালে তিনি পিতৃহারা হন। ইতোমধ্যে তিনি গ্রামের মক্তব থেকে কুরান ও দীনিয়াত শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে সেই মকতবের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষক হন এবং পীরের মাজারের খাদেমও হন। এসব ছাড়াও এখানকার মসজিদে ইমামতিও করেন। পিতার মৃত্যু এবং দারিদ্র্য একদিন তাঁকে বাধ্য করে গৃহ ত্যাগ করতে। প্রতিকূল পরিবেশে পড়েও তিনি স্বকীয় সত্তায় সজাগ ছিলেন। এক পর্যায়ে সৈনিকের উর্দি পরে হাতে অস্ত্র ধারণ করে যুদ্ধের ময়দানে অবতরণ করেছেন, ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছেন। সৈনিক জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর দেহ-মনে সচেতনতা প্রবল করে দিয়েছে। তিনি বিদ্রোহী ও বিপ্লবী হয়ে উঠেছেন। বাল্যকালেই তাঁর অস্তিত্বে সুপ্ত থাকা সত্য-সুন্দরের প্রবল স্পন্দন নবতর বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। পুরুষ পরম্পরায় যে মননের উত্তরাধিকারে তিনি অভিষিক্ত ছিলেন তা বলীয়ান হয়ে ওঠে, আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত না করার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই তো তিনি নিজেকে জনসমক্ষে হাজির করেন বিদ্রোহীরূপে যা কেবল সম্ভব একজন সূফীর পক্ষে। তিনি নির্ভীক চিত্তে বলে ওঠেন : বল বীর/বল উন্নত মম শির/শির নেহারি আমারি নত শির/ঐ শিখর হিমাদ্রির। ...
আমরা তাঁর কিছু রেকর্ডের গাত্রে ‘পীর’ নজরুল ইসলাম লেখা দেখে কিম্বা তাঁর কাব্য-আমপারার ভূমিকায় খাদেমুল ইসলাম নজরুল ইসলাম লেখা দেখে অবাক হই না।
মহান সূফী মনসুর হাল্লাজ আনাল হক অর্থাৎ আমিই সত্য ঘোষণা করেছিলেন সেই ঘোষণার স্পষ্ট অনুরণন আমরা দেখতে পাই তাঁর বিদ্রোহী কবিতায়। তাতে বড়পীর গওসুল আজম হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হির ফয়েযের অনুরণনও ধ্বনিত হয়।
কাসিদায়ে গওসিয়াতে গওসুল আজম (রহ) বলেন : ওয়া ওয়াল্লানী আলাল আকতাবি জামআন/ফা হুকমীাফিযুন্ ফী কুল্লি হালী/আনাল জীলিয়ূ মুহিউদ্দীন ইসমি/ওয়া আলামী ‘আলা রাসিল জিবালী/ওয়া আবদুল কাদিরিল মশহুর ইসমী? ওয়া আকদামী ‘আলা উনুকীর রিজালী। সার্বিক কর্তৃত্ব সবার উপরে আমার/আমি যে জিলানী মুহিউদ্দীন নামটি আমার/সব পাহাড় শীর্ষে উড্ডীন পতাকা আমার/আমি আবদুল কাদির মশহুর নাম আমার/সব মানব স্কন্ধে স্থাপিত কদম আমার।
কাজী নজরুল ইসলামের ভেতর সূফী চেতনার যে অনুরণন অনুরণিত ছিল, তাঁর শোনিত ধারায় যে সত্য-সুন্দরের ধ্যান অনুধ্যানের চেতনা বিদ্যমান ছিল তার স্পষ্ট আভাস পরিলক্ষিত হয় তাঁর লেখায়, তাঁর অভিভাষণে।
নজরুল ইসলাম বলেন : আল্লাহ পরম প্রিয়তম মোর, আল্লা ত দূরে নয়, নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে পরম সে প্রেমময় ... কিম্বা রূপ আছে কিনা জানি না, কেবল মধুর পরশ পাই,/এই দুই আঁখি দিয়া সে অরূপে কেমনে দেখিতে চাই! আবার তিনি বলেন : খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে কিম্বা তাঁরি নাম লয়ে বলি, “বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো,/ তাঁর সাথে ভাব হয় যার, তার অভাব থাকে না কোনো।”/তাঁহারি কৃপায় তাঁরে ভালোবেসো বলে আমি চলে যাই,/তাঁরে যে পেয়েছে, দুনিয়ায় তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই। ...
তিনি আরিফের খোঁজ করেছেন। আরিফ সূফীগণের উচ্চ পর্যায়ের উপাধি। ইলমে তাসাওউফ অনুশীলন করার মাধ্যমে যে সালিক বা আল্লাহর পথের পথিক ফানাফিল্লা মকামে উন্নীত হন তখন তার আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় ও জানাজানি প্রত্যক্ষভাবে ঘটে ফলে তিনি আরিফ বিল্লাহ হয়ে যান। তিনি ওলীআল্লাহ হয়ে যান, তিনি ওলিত্বের রাজত্ব লাভ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, এই আরিফ বিল্লাহ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে মহান সূফী হযরত মনসূর হাল্লাজ রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি (৮৫৭ খৃ:-৯২২ খৃ:) আনাল হকÑআমিই সত্য ঘোষণা করেন। ফানাফিল্লাহ মকামে উন্নীত হয় কারও কারও আত্মবিস্মৃতি এমনভাবে ঘটে যে, তাঁর নিজ অস্তিত্ব জ্ঞান ও অনুভূতি থাকে না। লা মওজুদা ইল্লাল্লাহÑআল্লাহ ছাড়া কোনো অস্তিত্ব নেইÑএই চেতনা তাঁর মধ্যে প্রবল হয়ে যায়, তাঁর মধ্যে দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের জীবন একাকার হয়ে যায়। হযরত মনসূর হাল্লাজ (রহ) বলেছেন : আমিই মহা সত্য, কেননা আল্লাহ ছাড়া আমি (অস্তিত্ব) দেখা যায় না।
আরিফ বিল্লাহ মকামে উন্নীত সূফী আনাল হক চেতনা ধারণ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম সেই আরিফকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন : আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান/কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবন-মৃত্যু জ্ঞান॥/যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম/ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম/ যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জিন-পরী ইনসান॥/স্ত্রী-পুত্রেরে আল্লারে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক/হেসে কোরবানী দিত প্রাণ, হায়! আজ তারা মাগে ভিখ।/কোথা সে শিক্ষা-আল্লাহ ছাড়া/ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা/আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে লয়ে কোরআন ॥
কাজী নজরুল ইসলামের এই অসাধারণ ললিত উচ্চারণে আরিফের বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলো গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আরিফ যে মহামনা ও নির্ভীক চিত্ত সত্তা, আরিফ যে, সত্য সুন্দর সুমুন্নত রাখতে সর্বাত্মক সচেষ্ট এবং জিহাদী চেতনা ধারণ করেন তা কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বহু সার্থক সূফী সুলতানুল আরিফীন অর্থাৎ আরিফগণের সুলতান খেতাবে ভূষিত হয়েছেন, যেমন : সুলতানুল আরিফীন হযরত হাসান বস্রী (রহ.), সুলতানুল আরিফীন হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.) প্রমুখ।
আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে দেখি আরিফের মতো একজন নির্ভীক চিত্ত মানুষ হিসেবে। তিনি বলেন : আমার কিসের শঙ্কা,/ কোরআন আমার ডঙ্কা,/ ইসলাম আমার আমার ধর্ম,/মুসলিম আমার পরিচয়। ...
আরিফ একজন মুসলিমের সর্বোচ্চ মর্যাদার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হন। নফ্সের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করার মাধ্যমে অর্থাৎ প্রবৃত্তিকে দমন করার মাধ্যমে প্রকৃত মনুষ্যত্বের গুণাবলী অর্জন করার মাধ্যমে যখন কেউ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি প্রাপ্ত হয়ে যায় তখন তিনি আল্লাহ্তে আত্মসমর্পিত হয়ে যান। কবি বলেন : কোথা সে আজাদ? কোথা সে পূর্ণ মুসলমান?/আল্লাহ্ ছাড়া করে না কারও ভয়, কোথা সেই প্রাণ?/ কোথা সে আরিফ, কোথা সে ইমাম, কোথা সে শক্তিধর?/ মুক্ত যাহার বাণী শুনি কাঁপে ত্রিভুবন ত্রিভুবন থরথর। ...
আরিফ আল্লাহ্ ছাড়া কারও ভয় করে না। কারণ তিনি আল্লাহর ওলী অর্থাৎ আল্লাহ্র বন্ধু হয়ে যান। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : জেনে রাখো। নিশ্চয়ই ওলী আল্লাহ্গণের কোনো ভয় নেই। এবং তারা দুঃখিতও হবেন না (সূরা ইউনুস : আয়াত ৬২)।
কাজী নজরুল ইসলাম আরিফ পর্যায়ে উন্নীত হবার পথপরিক্রমে আগ্রসরমান ছিলেন বলে মনে হয়। তার প্রমাণ মেলে তাঁর নির্বাক হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বে প্রদত্ত একাধিক অভিভাষণে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে প্রদত্ত দীর্ঘ বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন : আপনাদের অনেকে বহুদিন থেকে এই দ্বীন ফকিরের কাছে আসা-যাওয়া করেছেন -যাঁরা আসেন না তাঁরও নাকি বসে আছেন শিরনির আশায়। যে ফকিরের ঝুলি রইল আজও শূন্য, আল্লাহ্র রহমতের আশায় যে ভিক্ষুক আজও ঊর্ধ্বের পানে হাত পেতে বসে আছে, তারই কাছে যখন আপনারা হাত পাতেন, তখন আমার আঁখি অশ্রুতে ভরে ওঠে। পরম করুণাময়ের পরম রহমত পাওয়ার শুভক্ষণ যখন এলো ঘনিয়ে যে ভা-ার হতে তাঁর অনন্ত অসীম করুণা নিয়ত বিতরিত হচ্ছে সেই অতি গোপন ভা-ারের দ্বারে পৌঁছে যদি আমি আপনাদের আহ্বানে পিছু ফিরে যাই, তাহলে। বঞ্চিত শুধু আমিই হব না। হবেন বঞ্চিত আপনারা। ... পবিত্র কাবা ঘরের ছায়া যখন আকাশের নীল শিশায় ফুটে উঠেছে তখন আমার আত্মীয় যারা তারাই যদি পিছু ডেকে ফিরাতে চায়, তাহলে আমার দুনিয়া ও আখেরাত দুই হবে বরবাদ। আমার এই ঘোর দুর্দিনের, দুর্যোগের মরুভূমি দিয়ে তীর্থযাত্রা হবে নিষ্ফল। ‘সলুক’ (লড়ঁৎহবু) ও ‘তরিকতেই’ (চধঃয) হবে আমার মৃত্যু। ... আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই আল্লাহ্র রহমত আমি পেয়েছি আমার পরম প্রিয় ‘আল্ গফুরুল ওদুদ’ ( পরম ক্ষমা-সুন্দুর ও প্রেমময়) আমার নাযাত দিয়েছেন কিন্তু মুক্ত করার শক্তি তিনি দেননি। ...
এই অভিভাষণে তিনি যে সলুক ও তরিকতের উল্লেখ করেছেন তা তাসাওউফের দিক নির্দেশ করে।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ও ৬ এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিস্টিউট হলে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির এক সভায় জীবনের শেষ ভাষণে কবি বলেন : অসুন্দরের সাধনা আমার নয়, আমার আল্লাহ্ পরম সুন্দর। তিনি আমার নিত্য প্রিয়-ঘন, সুন্দর, প্রেম-ঘন সুন্দর, রস-ঘন সুন্দর, আনন্দ-ঘন সুন্দর। আপনাদের আহ্বানে আহ্বানে যখন কর্ম জগতের ভিড়ে নেমে আসি, তখন আমার পরম সুন্দরের সািন্নধ্য থেকে বঞ্চিত হই, আমার অন্তরে বাহিরে দুলে ওঠে অসীম রোদন। আমি তাঁর বিরহ এক মুহূর্তের জন্যও সইতে পারি না। আমার সর্বঅস্তিত্ব, জীবন-মরণ-কর্ম অতীত- বর্তমান-ভবিষ্যত যে তাঁরই নামে শপথ করে তাঁকে নিবেদন করেছি। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, আমার ক্ষমা-সুন্দর প্রিয়তম আমার আমিত্বকে গ্রহণ করেছেন। ...
তবে কি কাজী নজরুল ইসলাম আল্লাহ্ প্রেমে বিভোর হয়ে মজ্জুব হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ বনগাঁ সাহিত্য সভায় সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন : আজ আমার সকল সাধনা, তপস্যা, কামনা, বাসনা, চাওয়া, পাওয়া, জীবন, মরণ তাঁর পায়ে অঞ্জলি দিয়ে আমি আমিত্বের বোঝা বওয়ার দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছি। ...
কবি ইচ্ছে পোষণ করতেন যে, মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই॥ ... তাঁর সে ইচ্ছেও আল্লাহ্ পূরণ করেছেন। কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে শুয়ে আছেন।
মান্ আরাফা নাফ্-সাহু-ফাকাদ আরাফা রব্বাহুÑযে নিজেকে চেনে সে তার রবকে চিনতে পারে। কবি নজরুল ইসলাম তাঁর রবকে চিনেছিলেন।

লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.