পদ্মা সেতু হবেই হবে- * বিশ্বব্যাংকের গ্রীন সিগন্যাল- * পদ্মা সেতু হবে ॥ হুয়ান মিরান্ডা- * ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ॥ তাকাও তোদা- * পদ্মা সেতু হবেই হবে ॥ অর্থমন্ত্রী মুহিত by মিজান চৌধুরী ও হামিদ-উজ-জামান মামুন

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আরও এক ধাপ এগিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সিগন্যাল পাওয়ার পর অপর দুই অংশীদার দাতা সংস্থা জাইকা ও এডিবির ঋণের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়াচ্ছে। বৃহস্পতিবার ওই দুই দাতা সংস্থা তাদের ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে। আজ শুক্রবার তা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে জানানো হবে।


এদিকে বিশ্বব্যাংকও পদ্মা সেতুর ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে। বৃহৎ এই দাতা সংস্থা তাদের দেয়া সর্বশেষ শর্ত পূরণের অপেক্ষায় আছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেই বিশ্বব্যাংকের বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় কোন সমস্যা নেই এমন সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। তাই পরবর্তী ধাপের অগ্রগতি নির্ভর করছে তাঁর পদত্যাগের ওপর।
সূত্র মতে, মঙ্গলবার মধ্যরাতে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিং হয়। ওই মিটিংয়ে বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর পদ্মা সেতু নিয়ে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিশ্বব্যাংকের গ্রীন সিগন্যাল পাওয়ার পর অংশীদার দাতা সংস্থাগুলো নতুন করে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন এডিবির দক্ষিণ এশীয় বিভাগের মহাপরিচালক হুয়ান মিরান্ডা। দুপুরে ইআরডির সচিবের সঙ্গে হুয়ান মিরান্ডা বৈঠক করেছেন। অবশ্য দুই দিনের সফরে মঙ্গলবার রাতে ঢাকায় আসেন হুয়ান মিরান্ডা।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবি ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ঋণ কার্যকারিতার মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়েছে। এ নিয়ে চতুর্থবার সময় বাড়াতে যাচ্ছে সংস্থা দুটি। আজ শুক্রবার এডিবি ও জাইকা সময় বাড়ানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানাবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বাংলাদেশ অফিস থেকে সময় বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা হলেও বৃহস্পতিবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ম্যানিলায় অবস্থিত এডিবির কেন্দ্রীয় অফিস থেকে আনুষ্ঠানিক কোন চিঠি পায়নি সংস্থাটি।
উল্লেখ্য, ২৯০ কোটি ডলারে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল। এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং জাইকা ৪০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন হুয়ান মিরান্ডা। ওই বৈঠক শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষামান সাংবাদিকদের হুয়ান মিরান্ডা বলেন, পদ্মা সেতু হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবি থাকছে কি না, জানতে চাইলে হুয়ান মিরান্ডা বলেন, এডিবি এখনও আছে, থাকবে। এই প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার এডিবি। ঋণচুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি সরাসরি উত্তর এড়িয়ে বলেন, পদ্মা সেতু হবে।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু এদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি আবারও বলছি, পদ্মা সেতু হবেই। আমি চাই, এটা আপনাদের সংবাদের শিরোনাম হোক।
পরে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বার্তা তো আপনারা পেয়েই গেছেন। আমি কখনও বলিনি যে, পদ্মা সেতু হবে না। এটা আপনারাই বলছেন। পদ্মা সেতু নিয়ে শুক্রবার কিংবা শনিবার কথা বলবেন কিনা জানতে চাইলে মুহিত বলেন, বন্ধের দিনে আমি এ বিষয়ে আর কথা বলব না। আমি আমার আয়কর রিটার্ন দাখিল নিয়ে ব্যস্ত থাকব।
এরপর অর্থমন্ত্রী যোগ দেন সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে। ওই বৈঠকের পর সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রত্যয় নিয়ে কথা বলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পদ্মা সেতু হবেই হবে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে এডিবির সুখবর তো আপনারা পেয়েছেন। কাল জাইকারটাও পেয়ে যাবেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে এডিবি ও জাইকার ঋণচুক্তির বর্ধিত মেয়াদ আজ শুক্রবার ৩১ অগাস্ট শেষ হওয়ার কথা ছিল।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংককে ফেরাতে আলোচনা চলছে। আমরা একটা ‘ডেলিকেট নেগোসিয়েশন’ করছি। এই রকম অবস্থায় আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। তারপরও তো বলছি, এটা এক ধরনের টক শো হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে পড়ন্ত দুপুরে এডিবির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক হুয়ান মিরান্ডা বৈঠক করেছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে মিরান্ডা সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে তোমাদের টাকা দরকার, সেই টাকার ব্যবস্থা হবে। ঋণ কার্যকারিতার সময় বাড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর দেননি। এসময় সংস্থার বাংলাদেশ মিশনের আবাসিক প্রধান তেরেসা খো বলেছেন একটু অপেক্ষা করতে হবে।
বৈঠক শেষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব ইকবাল মাহমুদ বলেন, এডিবি পদ্মা সেতুতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেবে। সময় বাড়ানোর বিষয়ে কাল (আজ শুক্রবার) পর্যন্ত সময় আছে। তাই একটু অপেক্ষা করতে হবে।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। এছাড়া অন্যান্য দাতা সংস্থার মধ্যে ওই বছরের ১৮ মে জাপানের জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে এবং ৬ জুন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়।
কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় স্থগিত করলে অন্য দাতারাও তা স্থগিত করে। এ ঋণ কার্যকারিতার মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ সময় পার হওয়ার পূর্বেই সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয় এডিবি ও জাইকা। এডিবি ও জাইকার বাড়ানো সময় শেষ হয়ে যায় ২৭ এপ্রিল। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে ফের সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়। এ প্রেক্ষিতে সংস্থা দুটি ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিন মাস সময় বাড়িয়ে দেয়।
আশা করা হয়েছিল এরই মধ্যে বিশ্ব্যাংকের সঙ্গে একটি সন্তোষজনক সমাধান আসবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ৩১ আগস্ট পর্যন্ত একমাস বাড়িয়ে দেয় সংস্থাদুটি। এর মধ্যেও কোন সমাধান না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আবারও এক মাস অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এডিবি ও জাইকা।
এদিকে বিশ্বব্যাংক এখন পুরোপুরি প্রস্তুতি নিলেও অপেক্ষায় আছে তাদের সর্বশেষ শর্ত পূরণের। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ শর্ত পূরণ হবে। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাওয়ার আগে উপদেষ্টাকে এক ধরনের পদত্যাগের প্রস্তুতির ম্যাসেজ দিয়েছেন। এখন নির্দেশ এলেই ওই উপদেষ্টা পদত্যাগের সম্ভাবনা রয়েছে। ওই উপদেষ্টা পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি এ্যাডভাইজর হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
২৯০ কোটি ডলারে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে গত বছর বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকার সঙ্গে সরকারের ঋণচুক্তি হলেও গত ২৯ জুন এই প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে দাবি করে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের পর থেকে তাদের ফেরানোর চেষ্টা চলছে।

No comments

Powered by Blogger.