ফরমালিনের লিটার ৩০ টাকা, বরফেও মেশানো হচ্ছে by রাজীব আহমেদ

এক মণ মাছ এক দিন সংরক্ষণ করতে যেখানে প্রায় ১২০ টাকার বরফ প্রয়োজন হয়, সেখানে কয়েক ফোঁটা ফরমালিন দিয়ে ওই পরিমাণ মাছ সংরক্ষণ করা যাবে দুই দিন। এক লিটার ফরমালিনের খুচরা মূল্য মাত্র ৩০ টাকা। ছোট এক বোতল ফরমালিন কিনতে ব্যবসায়ীদের ১০ থেকে ১৫ টাকার বেশি লাগছে না, কার্যকারিতাও বেশি। ফলে সামান্য


কিছু বরফ দিয়ে এর মধ্যে দুই-এক ফোঁটা ফরমালিন মিশিয়ে মাছ সংরক্ষণে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বিদ্যুতের দাম বাড়ার সঙ্গে বরফের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে ফরমালিনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে মাছ ব্যবসায়ীদের। অভিযোগ রয়েছে, ফরমালিন মেশানোর দৃশ্য অন্য কেউ যাতে দেখতে না পায় সে জন্য অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বরফের মধ্যে ফরমালিন মিশিয়ে আনছেন বরফকল থেকেই। ঢাকার মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
খাদ্যপণ্যে ফরমালিনের ব্যবহার নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়। সূত্র জানায়, ওই সভায় কিছু ফরমালিন আমদানিকারক দাবি করেন, দেশে দুই ধরনের ফরমালিন আমদানি হয়। ভালো ফরমালিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০০ টাকার বেশি। এসব ফরমালিন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, রোগ পরীক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়। আর সাধারণ ফরমালিনের দাম লিটারপ্রতি ৩০ টাকা। সেগুলো অহরহ বিভিন্ন দোকানে পাওয়া যায় বলে আমদানিকারকরা জানান।
সস্তা দামের ফরমালিন ছোট ছোট বোতলে বিক্রি হয়। আমদানিকারকরা আমদানি করে বিক্রি করে দিয়েই খালাস। ওই ফরমালিন কার কাছে বিক্রি করা হলো, তিনি কার কাছে বিক্রি করলেন এর কোনো তথ্য থাকে না। ফলে এগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় ফরমালিনের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধের জন্য চালান ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ করা, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের চিঠি ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং এসিডের মতো এটির আমদানি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব করা হয়। তবে আমদানিকারকরা আমদানি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নন। তারা চান ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ হোক।
মৎস্য অধিদপ্তরের ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার বাজারে অভিযান চালালেই ফরমালিন পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি ১০০ নমুনার আটটিতে ফরমালিন মেশানোর প্রমাণ পাচ্ছেন তাঁরা। আমদানি করা মাছ বেনাপোল ও টেকনাফ বন্দরে আমেরিকা থেকে আমদানি করা কিট দিয়ে পরীক্ষা করে ফরমালিনের উপস্থিতি পাননি। ফলে কর্মকর্তাদের ধারণা, খুচরা বাজারে ফরমালিন বেশি মেশানো হচ্ছে।
সভা সূত্র জানায়, সস্তা ফরমালিন যারা আমদানি করেন তাঁরা সভায় উপস্থিত ছিলেন না। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অনেক সংস্থাও উপস্থিত ছিল না। এ কারণে সবাইকে নিয়ে আরেকটি সভা হবে বলে জানানো হয়।
ফরমালিন যখন একেবারেই সস্তা তখন আরেক পণ্য সংরক্ষক বরফের দাম এক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ঢাকার কারওয়ান বাজারের বিসমিল্লাহ মৎস্য আড়তের ব্যবস্থাপক ইয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, গত বছর এক ক্যান বরফের দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা। এখন সেটি ১২০-১৩০ টাকা। যেদিন বাজারে সংকট হয় সেদিন দাম আরো বেড়ে যায়। তিনি জানান, এক মণ মাছ সংরক্ষণ করতে ১২০ টাকার বরফ প্রয়োজন।
ঢাকা মহানগর মাছ ও কাঁচাবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, মাছে ফরমালিন দিতে হলে হাতে গ্লাভস পরতে হয়। আবার সবার সামনে দিলে তা দেখে ফেলার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে বেশি পরিমাণে মাছ থেকে গেলে অনেক ব্যবসায়ী বরফকল থেকেই বরফে ফরমালিন মিশিয়ে এনে ব্যবহার করেন। তিনি জানান, গত বছর তিনি নিজে ফরমালিন কিট দিয়ে পরীক্ষা করে বরফে ফরমালিন পেয়েছিলেন। পরে আর পরীক্ষা করা হয়নি।
চেইন শপ স্বপ্ন মাছ কেনার সময় ফরমালিন পরীক্ষা করে কেনে। গত ৩ জুলাই তাদের একটি বিক্রয়কেন্দ্রের বরফে ফরমালিন পাওয়া যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটিকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। যদিও বরফ তারা একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিনেছিল।
স্বপ্নের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা জানতামই না বরফে ফরমালিন মেশানো হতে পারে। এখন থেকে বরফও পরীক্ষা করে কিনি। এর পর থেকে সরকারি সংস্থাগুলো আর ফরমালিন পাচ্ছে না। আজও (বৃহস্পতিবার) বিএসটিআই অভিযান চালিয়ে কিছু পায়নি।'
বরফে ফরমালিন মেশানোর খবর মৎস্য অধিদপ্তরের কাছেও আছে। তবে আইনি ক্ষমতা না থাকায় তারা বরফকলগুলোতে অভিযান চালাতে পারছে না। মৎস্য অধিদপ্তরের ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা প্রকল্পের পরিচালক জি এম সামসুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ করতে এর আমদানি ও ব্যবহার তদারকি জরুরি। খাদ্যে দেওয়ার জন্য কেউ ফরমালিন আমদানি করতে পারে না। যে উদ্দেশ্যে আমদানি করা হয়, ব্যবহার তাতেই সীমাবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ফরমালিন আমদানি ও ব্যবহার নীতিমালা জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.