বিলছড়িঃ পাহাড়ে এক অগ্রসর জনপদ by শিমুল সুলতানা

লাইনঝিড়ি, মধুঝিড়ি-এরকম আরো অনেক পাহাড়ি জলধারার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জনবসতির নাম ‘সাবেক বিলছড়ি’। লামা সদর থেকে আলীকদম যাওয়ার রাস্তা ধরে প্রায় তিন কিলোমিটার এগুলোই বিলছড়ি। আঁকা-বাঁকা সেই রাস্তাই পাহাড়ি ধান ক্ষেতের বুক চিড়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেল সাবেক বিলছড়ি।

গিয়ে দেখি শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম চর্চায় বিলছড়ি অনেকটাই এগিয়ে। 
দূরে ছোট ছোট পাহাড় তার পাদদেশে সবুজ ধানক্ষেত। এরই মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বৌদ্ধ বিহার।

পাহাড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই বিহারের ভেতরে বুদ্ধের তিনটি রূপ-তিনটি মূর্তি। মাঝখানের মূর্তিটি আনা হয়েছে মিয়ানমার থেকে। দুই পাশের মূর্তি দুইটি দেশেই তৈরি।

বিহারের এই প্রধানভবনের দুইটি অংশ। পেছনের অংশে রয়েছে বুদ্ধের আরো কয়েকটি রূপ। হেঁটে সামনে এগুলে আরো একটি ভবন। এখানে রয়েছে এখানকার সবচেয়ে বড় মূর্তিটি। এটি দেশেই তৈরি। তবে কারিগর আনা হয় মিয়ানমার থেকে।

পাহাড়ের উপর রয়েছে মৃত বৌদ্ধদের কবরসহ আরো বেশকিছু ছোট ছোট স্থাপনা।

এ বৌদ্ধ বিহারের ঠিক উল্টো দিকে রাস্তার পাশে মহামুনি শিশু সদন।

সদনের ভেতরটা ঘুরে দেখতে গেলাম। স্থানীয় সাংবাদিক আরমান এবং লামার মাতামুহুরী ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি বাবু মং ও উকেঅনু নামে তিন বন্ধু আমাদের সঙ্গী। দেখা হলো এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সিং মংয়ের সঙ্গে। জানালেন তার পৈত্রিক বাড়ি কক্সবাজারে তবে এখন লামাতেই স্থায়ী আবাস। 

তিনি জানালেন, এ শিশু সদনে তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। মোট ৪৮টি শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে এর একটি ভবনে বসবাস করেন সিং মং। তিনিই এ পাহাড়ি শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্মাতা।

শিশু সদনের ছেলে মেয়েদের বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, কারাতে, নাচ, গান, ছবি আঁকা ও অভিনয়সহ বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়। 

এতে নিজস্ব চারটি বড় বড় কক্ষ ছাড়াও পাশের বুদ্ধ মন্দিরের একটি কক্ষে শিশুদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর একেকটিতে কক্ষে আট থেকে দশজন শিশু থাকে। দোতলা খাটের ব্যবস্থা রয়েছে। 

শিশু সদনে কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র নেই। প্রয়োজনে লামা বাজার এলাকায় অবস্থিত লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

তবে এসব শিশু নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীর চর্চার মধ্যে থাকে বলে তাদের খুব একটা স্বাস্থ্য সমস্যা হয় না ।

বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অনগ্রসর জনপদের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবারের ছেলে মেয়েদের এখানে বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়।

জানা গেল, এ প্রতিষ্ঠানটি চলে জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও একজন বিদেশি দাতা ফাদার লুপির অর্থায়নে। লুপি নামে ইটালিয়ান ওই ফাদারই মূলত এর ও দাতা।

কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, সিং মংয়ের স্ত্রী জউ প্রু ১৯৯৭ সাল থেকে জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন।

কথা হলো জউ প্রু’র সাথে। জানালেন, এ সময়ের মধ্যে তিনি জিতেছেন কয়েকটি স্বর্ণ পদকসহ অনেকগুলো পদক, ২০১০ তিনি সাউথ এশিয়ান গেম স্বর্ণ পদক জিতেছেন। আরও জিতেছেন বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদের স্বীকৃতি-সম্মাননা।

দুই সন্তানের জননী ক্রীড়াবিদ জউ প্রু’ স্বামীর সঙ্গে শিশু সদনের শিশুদের দেখাশোনা করছেন, তাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষা দিচ্ছেন কারাতে। নিজেও প্রস্তুত হচ্ছেন আগামীতে যেসব টুর্নামেন্ট হবে তাতে অংশগ্রহণের জন্য।

প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর মনোবল থাকলে মানুষের পক্ষে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। দেশের অনগ্রসর একটি জনপদ-বিলছড়ি এসে এটিই আমার সবচেয়ে বড় উপলব্ধি। মানুষের জন্য কিছু করতে চাইলে স্থান বা লোকালয় কোন বিষয় নয় প্রয়োজন মানুষের জন্য ভালোবাস। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন জউ প্রু ও সিং মং দম্পতি তারই প্রতীক।

No comments

Powered by Blogger.