দেখা মিলবে আজ নীল চাঁদের পূর্ণিমার

পূর্ণিমা এমন একটি নিয়মিত মহাজাগতিক ঘটনা যার সঙ্গে আমরা ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। তবে আজ যে পূর্ণিমাটি ঘটবে তা সাধারণ দৃষ্টিতে গতানুগতিক পূর্ণিমা মনে হলেও এর রয়েছে খানিকটা বিশেষত্ব। এদিনের পূর্ণিমাটি হবে নীল চাঁদের পূর্ণিমা বা ব্লু মুন।


গড়ে প্রতি ২.৭ বছরে একবার ব্লু মুন সংঘটিত হয়ে থাকে। পরবর্তী ব্লু মুনের দেখা মিলবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই।
প্রচলিতভাবে আমরা প্রতি মাসে একটি মাত্র পূর্ণিমা দেখতে পাই, কিন্তু কখনও কখনও এমন ঘটে যে একটি মাসে দুইটি পূর্ণিমা ঘটে থাকে। কোন মাসের এই দ্বিতীয় পূর্ণিমাটিই হচ্ছে ব্লু মুন। এক্ষেত্রে প্রথম পূর্ণিমাটি মাসের একদম শুরুতে বা শুরুর কাছাকাছি সময়ে হয়ে থাকে। কারণ চান্দ্রমাস ২৯.৫ দিনে সম্পন্ন হয়। ফলে ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া অন্য যে কোন মাসেই দুটি পূর্ণিমা ঘটতে পারে।

ব্লু মুন কেন ঘটে
সৌর বর্ষপঞ্জিতে বারোটি পূর্ণ চান্দ্রমাস সম্পন্ন হয়ে থাকে অর্থাৎ বারোটি পূর্ণিমা ঘটে। তবে সৌর মাসের তুলনায় চান্দ্রমাসে দৈর্ঘ্য কম। চান্দ্রবছর সৌর বছরের তুলনায় গড়ে এগারো দিন কম হয়ে থাকে। এই অতিরিক্ত দিনগুলোর কারণে গড়ে প্রতি ২.৭ বছরে এমন একটি মাস পাওয়া যায় তখন একই মাসে দুটি পূর্ণিমা ঘটে। একইভাবে প্রতি ১৯ বছরে ৭ বার এমন পূর্ণিমা পাওয়া যায়।

একই বছরে দুইবার ব্লু মুন
বছরে দুইবারও ব্লু মুনের দেখা পাওয়া। গড়ে প্রতি ১৯ বছরে মাত্র একবারই এমনটি ঘটে। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে পর পর দুইবার ব্লু মুন দেখা গিয়েছিল। তবে এই ঘটনা শুধু জানুয়ারি এবং মার্চ মাসেই ঘটা সম্ভব। কারণ এই দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মাস ফেব্রুয়ারি রয়েছে, এর দৈর্ঘ্য সাধারণত মাত্র ২৮ দিন। তাই প্রতি ১৯ বছরে ফেব্রুয়ারি মাসটি একবার প্রভাবক হিসেব কাজ করে। তবে যদি জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে পর পর এমন ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি মাসে কোন পূর্ণিমা দেখা যাবে না। কারণ জানুয়ারি মাসের একবার শেষ দিকে পূর্ণিমা ঘটলে চান্দ্রমাসের হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে কোন পূর্ণিমা না ঘটে মার্চ মাসের শুরুতে পূর্ণিমা ঘটবে। এরকমটি আবার ঘটবে ২০১৮, ২০৩৭ সালে। এভাবে ১৯ বছর পর পর নিয়মিতভাবে।

কেন ব্লু মুন বলা হয়
এই বিশেষ পূর্ণিমাকে ব্লু মুন বা নীল চাঁদ নাম দেয়া হলেও দৃশ্যত এই পূর্ণিমায় চাঁদকে মোটেও নীল রঙের দেখায় না, বরং অন্য পূর্ণিমার মতই পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ। তাহলে নীল চাঁদ নামের কারণ কি? ইংরেজিতে ইষঁব গড়ড়হ পদটি দ্বারা কোন অসাধারণ বা দুষ্প্রাপ্য ঘটনাকে প্রকাশ করা হয়। এই নামটি প্রায় চারশ’ বছর ধরেই প্রচলিত ছিল। তবে গত ২৫ বছর ধরে বর্ষপঞ্জিতে এই নামটি বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রাচীন সময়ে মানুষের মনের বিভিন্ন কুসংস্কার বা বিশ্বাস থেকে এই ব্লু মুন নামটি এসে থাকতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কিছু ঘটনা থেকে এই নামকরণের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা কিছুটা ঐতিহাসিকও বটে। ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ক্রাকাতোয়া অগ্ন্যুৎপাতের কারণে পরবর্তী দুই বছর সূর্যাস্তের সময় সবুজ এবং চাঁদকে নীলাভ দেখা গেছে। এ ছাড়া ১৯২৭ সালে ভারতীয় মৌসুমি বায়ু দেরিতে আসার কারণে গ্রীষ্মকাল অতি দীর্ঘ হয়ে পড়ে, যা বায়ুম-লে ধুলার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। তখন রাতের আকাশে চাঁদকে নীলাভ দেখাত। ১৯৫১ সালে উত্তর আমেরিকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের চাঁদকেও নীল দেখা গিয়েছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ব্লু মুন প্রকৃতপক্ষে দেখতে মোটেও নীল নয়। তবে আকাশে ধুলাবালি বা ধোঁয়ার কারণে সাময়িকভাবে নীলাভ মনে হতে পারে। এটি সময়ের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হওয়া একটি মহাজাগতিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

অমাবস্যা-পূর্ণিমার রসায়ন
চাঁদ নিজ অক্ষের ওপর আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীকেও প্রদক্ষিণ করে চলছে। নক্ষত্রের পটভূমিতে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে চাঁদের সময় লাগে ২৭.৩ দিন। এটি হচ্ছে চাঁদের নক্ষত্রিক কাল বা সিডেরিয়াল পিরিয়ড। তখন সূর্য প্রতিদিন ১ ডিগ্রী করে পূর্ব দিকে এগোতে থাকে। অর্থাৎ এই সময়ে পৃথিবী নিজের কলা পূর্ণ করার জন্য এই অতিরিক্ত ২৭ ডিগ্রী পরিভ্রমণ করতে হয়। এর জন্য চাঁদের সময় লাগে ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ড বা সহজভাবে বললে ২৯.৫ দিন, যা সাইনোডিক পিরিয়ড।
নতুন চাঁদের দিন অর্থাৎ অমাবস্যা থেকেই চাঁদের মাস গণনা করা হয়ে থাকে। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের কলা পরিবর্তিত হতে থাকে। অমাবস্যার দিন চাঁদ সূর্যের মুখোমুখি অবস্থান থেকে একটু সরে যেতে থাকে। শুরু হয় শুক্লপক্ষ। সপ্তম দিনে চাঁদ সূর্য থেকে ৯০ ডিগ্রী সরে যায়। তখন আমরা অর্ধেক চাঁদ দেখতে পাই। চৌদ্দ থেকে পনেরোতম দিনে আমরা পূর্ণিমা দেখতে পাই। এ সময়ে চাঁদ সূর্যের বিপরীত দিকে অবস্থান করায় পৃথিবী থেকে চাঁদের পিঠকে আলোকিত দেখা যায়। এদিনের পর থেকে শুরু হয় কৃষ্ণপক্ষের। পরিবর্তিত হতে শুরু করে চাঁদের কলা। বাইশতম দিনে চাঁদ তার কক্ষপথের তিন-চতুর্থাংশ পরিভ্রমণ সম্পন্ন করে। তখন চাঁদের অর্ধেকটা আলোকিত দেখা যায়। ২৯.৫ দিনে পূর্ণ হয় একটি চান্দ্রমাস। আবার নতুন চাঁদের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় নতুন আরেকটি চান্দ্রমাসের।

পূর্ণিমার পুরাণাখ্যান
প্রাচীন প্রধান ধর্মগুলোতে পূর্ণিমার উল্লেখযোগ্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে খ্রিস্টিয়ান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে পূর্ণিমাকে আমরা দেখতে পাই বিশেষ নির্দেশক রূপে। বাইবেলের পুরাতন নিয়মের তৃতীয় পুস্তক “লেবিয় পুস্তক” অনুসারে সুস্পষ্টভাবে দুটি প্রধান পবিত্র পর্বের উল্লেখ রয়েছে, যা পূর্ণিমার সাথে মিল রেখে করা হয়েছিল। এর একটি নিস্তারপর্ব (চধংংড়াবৎ) এবং অন্যটি প্রায়শ্চিত্তকালীন পর্ব (ঝঁশশড়ঃ)।
সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, বাইবেলে মাসের শুরু হতো অমাবস্যার দিন থেকে এবং দিনের শুরু ধরা হতো সূর্যাস্ত থেকে। কাজেই বাইবেলের মাসের হিসেবে চৌদ্দতম দিনের সন্ধ্যা থেকে পনেরোতম দিন পর্যন্ত হতো পূর্ণিমা।

কুসংস্কার ত্যাগ করুন
মানুষের জীবন ও কাজের ওপর সাধারণ পূর্ণিমা বা ব্লু মুন কোনটিরই প্রভাব নেই। এটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে চলা একটি মহাজাগতিক ঘটনা মাত্র। তাই মানুষের শরীরের ওপর পূর্ণিমার ক্ষতিকর প্রভাব বা ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের মতো বিশ্বাস নেহায়ৎ কুসংস্কার। তবে দারিদ্র্র্য-অশিক্ষা-অজ্ঞানতা-সাম্প্রদায়িকতা-রোগ-মানসিক যন্ত্রণা নানা কারণে আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন খুব সহজেই মহাজাগতিক ঘটনাবলীকে ভর করে নিজেদের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে নেয় বা তার বশবর্তী হয়ে পড়ে। তাই কোন রকম কুসংস্কারে বিশ্বাস না করে, ভ্রান্ত ধারণায় পরিচালিত না হয়ে স্নাত হোন এই বিশেষ পূর্ণিমার অপূর্ব জোছনায়। নয়তো অপেক্ষা করতে হবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত।
কসমিক কালচার

No comments

Powered by Blogger.