কাঁচপুর সেতু এলাকায় নতুন করে ১৭ বিঘা জায়গা দখল by অরূপ দত্ত

আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে দখল চলছেই। গত প্রায় দুই মাসে কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন এলাকায় নদীর অন্তত ১৭ বিঘা জায়গা বাঁধ তৈরি করে দখল করা হয়েছে। সেখানে বালু-পাথর-মাটির অবৈধ ব্যবসাও অব্যাহত রয়েছে।
কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এখন কারও নামে জায়গার ইজারা নেই। সেখানে বালু-পাথর ব্যবসা নিষিদ্ধ। দখলদার আর অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও নদী দখলসহ অবৈধ কার্যকলাপ বন্ধ হয়নি।
কাঁচপুর সেতুর নিচে ও দুই পাশে নতুন করে অন্তত ১৭ বিঘা জায়গা কৌশলে দখল করার কথাটি জানিয়েছেন নদীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দায়িত্বশীল সূত্র। এ ছাড়া নদীর তীরের প্রায় আধা কিলোমিটার অংশজুড়ে চলছে বালু, পাথর ও মাটির অবৈধ ব্যবসা।
বিআইডব্লিউটিএর দাবি, কয়েক দফা নিলাম ডেকে ভরাট করা জায়গা থেকে মাটি সরানো হলেও বারবার দখল হয়ে যাচ্ছে।
নদীর ১৭ বিঘা জায়গা দখল: গত সোমবার গিয়ে দেখা যায়, বিআইডব্লিউটিএর কাঁচপুর ল্যান্ডিং স্টেশনের দুই পাশে নদীর বিশাল জায়গাজুড়ে চারকোনা আকৃতির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এর ভেতরে মাটি ফেলা হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিএর আনুমানিক হিসাবে দখলের প্রক্রিয়ায় থাকা ওই জমির আয়তন অন্তত ১৭ বিঘা। এর মধ্যে নদীর পশ্চিম পারে সেতুর নিচ থেকে বরাবর ডানে প্রায় চার বিঘা জায়গা বাঁধ দিয়ে ঘেরা হয়েছে। এর পাশে ল্যান্ডিং স্টেশন। তার ঠিক ডানে আরও অন্তত ছয় বিঘা জায়গায় একইভাবে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
নদীর একই তীরে সেতুর বাঁ পাশে প্রায় সাত বিঘা জায়গায় বাঁধ দিয়ে ধীরে ধীরে ভরাট করা হচ্ছে। ভরাট করা জমির ওপর দিয়ে চলছে বালুবাহী ট্রাক। সোমবার বেলা একটার দিকে দেখা গেল, দুটি বালুভর্তি ট্রলার থেকে প্রথমে বালু নামানো হয় ভরাট করা জায়গায়। পরে সেই বালু ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে। এ সময় এ রকম অন্তত ৫০টি ট্রাক দেখা যায়।
কাঁচপুর সেতুর আশপাশে বালু-পাথর বিক্রির গদি রয়েছে ৬০টির মতো। এগুলোর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেন কোনো না-কোনোভাবে জড়িত বলে স্থানীয় লোকজন এ প্রতিবেদককে জানায়। কর্মরত শ্রমিকেরা জানান, এখান থেকে দিনে ও রাতে কমপক্ষে ৩০০ ট্রাক বালু বিভিন্ন স্থানে যায়।
নদী দখল, বালু ব্যবসা এবং নদীর সীমানায় ‘ওয়াকওয়ে’ নির্মাণকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে গত ৩ জুন বিআইডব্লিউটিএ নূর হোসেন ও তাঁর ভাই জজ মিয়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করে। মামলায় বলা হয়, মে মাসের শেষদিকে কাঁচপুর সেতু এলাকায় নদীর সীমানায় ‘ওয়াকওয়ে’ নির্মাণ তথা সরকারি কাজে নূর হোসেন ও তাঁর ভাই বাধা দেন।
জানতে চাইলে কয়েকজন শ্রমিক বলেন, জজ মিয়া মাঝেমধ্যে আসেন। এ ছাড়া টেলিফোনে নিয়মিত যোগাযোগ করেন। নূর হোসেন গত কয়েক দিন আসেননি।
অন্য কেউ বালু ও পাথর ব্যবসায় যুক্ত কি না, প্রশ্ন করলে একাধিক শ্রমিক বলেন, তাঁরা শুনেছেন ওই দুই ভাই-ই নদীর জায়গার ইজারা নিয়েছেন। অন্য কেউ সরাসরি যুক্ত নন। মাঝেমধ্যে ‘সাব-কন্ট্রাক্ট’ নেন কেউ কেউ।
মামলার পরও নদী দখল, অবৈধ বালু ব্যবসা বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। কর্মরত শ্রমিক, স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিআইডব্লিউটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নূর হোসেন ও জজ মিয়া এখনো নদী ভরাট ও বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
জানা গেছে, নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জ জেলা, থানা বা উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে না থাকলেও নিজেকে সব সময় এই দলের নেতা বলে দাবি করেন। তিনি আন্তজেলা ট্রাকশ্রমিক ইউনিয়নের শিমরাইল শাখার সভাপতি। এ পরিচয়ের কারণে তাঁর নদী ভরাট ও অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, এমন অভিযোগ করেছেন বিআইডব্লিউটিএর কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী।
মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে নূর হোসেন বলেন, কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদী দখলের সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই যুক্ত নন। বালু বা পাথর ব্যবসার সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর ভাই আগে ব্যবসা করলেও এখন করেন না। নূর হোসেন দাবি করেন, কাঁচপুরের বালু-পাথর বিক্রির গদিগুলোর মধ্যে ৪৩টি বিএনপির লোকদের।
নদী দখল ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না হলে মামলা হওয়ার পর প্রতিবাদ বা পাল্টা মামলা করেননি কেন?—এই প্রশ্নে নূর হোসেন বলেন, ‘নৌমন্ত্রীর সঙ্গে আমার ২৫ বছরের সম্পর্ক। কীভাবে মামলা করতে পারি?’
এ বিষয়ে বুধবার যোগাযোগ করা হলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, নূর হোসেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। এই পর্যন্তই। কাঁচপুর বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনাই হয়নি। বিষয়টি বিআইডব্লিউটিএ দেখবে।
অভিযান আর পুনর্দখলের খেলা: বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রায় এক বছর আগে কাঁচপুরে তাঁদের ল্যান্ডিং স্টেশন করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নদীর জায়গায় বালু-পাথরের অবৈধ ব্যবসা ঠেকানো। কিন্তু অবৈধ এ ব্যবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, নদীর দখল করা জায়গাগুলো থেকে এ পর্যন্ত পাঁচবার মাটি সরানো হয়েছে। কিন্তু অভিযানের কিছুদিনের মধ্যেই আবার তা দখল হয়ে যায়। মাস দেড়েক আগে নিলাম ডেকে কিছু মাটি অপসারণ করা হয়। তা আবার ভরাট করা হয়েছে। ১৩ আগস্ট আবার নিলাম ডাকা হয়।
যোগাযোগ করা হলে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর) সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁচপুর সেতু এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী দখল বা বালু ব্যবসা বন্ধে নারায়ণগঞ্জ বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়কে নির্দেশ দেওয়া আছে। সে মতো শিগগিরই কাজ হবে।’

No comments

Powered by Blogger.