টুঙ্গিপাড়ার খোকা by বেবী মওদুদ

নানা নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বেশ বড় নাম। তিনি বলতেন, ‘এ নাম জগতজোড়া হবে।’
মা-বাবা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’। ছোট ভাইবোন ও আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশী ছোটরা ডাকত ‘মিয়াভাই’ বলে। আর বন্ধুরা মুজিব বলে।


স্কুলের স্যারেরা ডাকতেন মুজিবর বলে। ছোটবেলায় রোগা-পাতলা এই ছেলেটির মাথাভর্তি ছিল ঘন কালো চুল। ধীরে ধীরে খোকা বড় হচ্ছে। শৈশব কাটল টুঙ্গিপাড়া নামে গ্রামে। এখানেই তার জন্ম। বড় দুই বোন ও ছোট দুই বোন এবং একমাত্র আদরের ভাই। বাড়িতে আশ্রিত আত্মীয়-স্বজনের ছেলেমেয়েরাও আছে। পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুরা আছে। খোকা সবার কাছে আকর্ষণীয় মিয়াভাই। লেখাপড়ার জন্য বাড়িতে মাস্টার আসেন, সবাই এক সঙ্গে পড়ে। আবার খেলার মাঠেও সবাই এক সঙ্গে খেলে। স্কুলেও যায় এক সঙ্গে। নদীর পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি-সাঁতার কাটা, মাছ ধরাও চলে দল বেঁধে। রাতের বেলা উঠোন যখন জ্যোৎস্না ঝরে ঝরে পড়ে তখন মেজ চাচির কাছে সবাই গল্প শোনে। শুনতে শুনতে কেউ কেউ ঘুমিয়ে যায়। আবার খেতেও বসে সবাই এক সঙ্গে। মা তাকে এক বাটি দুধে ভাসা সর দিতেন খেতে, কখনও বা ঘরে তৈরি মাখন চিনি মাখিয়ে খোকা একা খেতে পছন্দ করত না। আশপাশে কাউকে তুলে দিয়ে ভাগাভাগি করে খেত। খোকা প্রাণ খুলে হাসত, মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলত।
ধানক্ষেত-পাটক্ষেতের আলপথ ধরে চলে যেত নদীর ধারে। সারি সারি নৌকা বাঁধা থাকত ঘাটে। নদীর পানিতে রোদ পড়ে ঝিলিমিলি ঢেউ তুলত। লাল-নীল-হলুদ পাল তুলে নৌকা ভাসত দূরে দূরে। দেখতে দেখতে দু’চোখ জুড়িয়ে যেত খোকার। আবার কখনও বাড়ির কাছে লম্বা বাঁশের সাঁকোর ওপর হেঁটে নদীর ওপারে হাটে চলে যেত। কত রকম মানুষ আসে, চাল-ধান-ডাল-দুধ-শাকসবজি-মাছ-ফল নিয়ে কেনা বেচা করতে। খোকা ঘুরে ঘুরে তাদের দেখত।
কখনও বা বড় দীঘির পারে বিরাট বরই গাছ তলায় বসে মাছরাঙা পাখির মাছ ধরা দেখত। নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। খোকা অবাক হয়ে দেখে। সাদা সাদা কাশফুলে মাঠ ভরে থাকে। খোকা সেই ফুলের ভেতর লুকোচুরি খেলে। সঙ্গে ছেলের দল। কারও কারও গায়ে গেঞ্জি নেই। পরনের প্যান্ট-লুঙ্গিও ছেঁড়া। খোকা মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে আজ খাস নি? মুখটা ব্যাজার ক্যান তোর?’ ছেলেটা উত্তর দেয়, ‘বাজানের অসুখ। কামে যায়নি। চাল কিনবার পারে নাই।’
খোকা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটা কেঁদে ফেলে। খোকা তার চোখের পানি মুছিয়ে বলে, ‘চল। আমাদের বাড়ি গিয়া সবাই ভাত খাব একলগে।’
সবাইকে নিয়ে খোকা ঘরে ফেরে। দেখে মা তার প্রতীক্ষায় বসে আছে। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ও মা, ক্ষুধা লাগছে। আমাগো ভাত দিবা না।’
মা তাকিয়ে দেখে খোকার সঙ্গে সাত জন। সবাইকে একবার দেখে নিয়ে মা হেসে ফেলে। বলে, ‘আসছ তোমার সৈন্য-সামন্ত নিয়া, খাইতে দিতে তো হবেই। যাও গোসল করে আসো।’
আর কি! খোকা সবাইকে নিয়ে হৈ চৈ করতে করতে গোসল করতে যায়। আবার হৈ চৈ করতে সবাই এসে খেতে বসে। মাদুল বিছিয়ে মা তাদের খাওয়াল ভাত, শাক চচ্চড়ি আর কই মাছের সালুন। সঙ্গে আলু ভর্তা। সবই খোকার প্রিয়। সে খাবে কী! সবার থালার তুলে তুলে জোর করে খাওয়াল। বাবা চাকরি করেন মাদারীপুর কোর্টে। অফিস ছুটির পর সোজা নৌকায় উঠে বাড়ির পথ ধরেন। সপ্তাহে দুটো দিন বাড়িতে এসে থাকেন। খোকা সন্ধ্যা নামতেই তারাকে সঙ্গে নিয়ে হ্যারিকেন হাতে বাড়ির ঘাটে ঘাটে গিয়ে বসে থাকে। বাবার নৌকা দেখামাত্র খুশিতে হৈচৈ করে ওঠে। তারপর বাবার নৌকা ঘাটে এলে তার গলা জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলে, ‘বাপজান আজ কিন্তু আগের চেয়েও আগে আসছেন।’
তার কথা শুনে বাবাও হাসেন। ঘরে ফিরে সে বাবার সঙ্গে ভাত খায়। মা এক বাটি দুধ এনে খাওয়া তাকে। রাতের বেলা বাবার পাশে শুয়ে শুয়ে গল্প করে খোকা। এ ক’দিনে জমিয়ে রাখা কত মজার ঘটনা, মাছরাঙাটার মাছ না পেয়ে উড়ে যাবার কথা। সেই ছেলেটার ভাত না খেতে পারার কথা। কাশবনের সাদা ফুলের কথা। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে খোকা ঘুমিয়ে যায়। বাবার বুকের কাছে মাথা রেখে কত শান্তি। বাবা চিন্তা করলেন, খোকাকে এবার শহরে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করবেন। সে এখন বড় হচ্ছে। খোকা এরপর মাদারীপুর শহরে স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করল। তারপর গোপালগঞ্জ শহরে মিশন স্কুলে ভর্তি হলো। প্রবেশিকা পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হযে বিএ পাস করল। সেই ছোট্ট খোকা শৈশবের স্মৃতি কখনও ভোলে না। সেই গ্রাম, বন্ধুরা, কাশবন, নদীতে পাল তোলা নৌকা, হাটে-বাজারের মানুষ, ভাত খেতে না পারা ছেলেটার কান্না-তার মনে গাথা ছিল। খোকা কৈশোর থেকেই রাজনীতির শিক্ষা নিল তার গৃহশিক্ষক হামিদ মাস্টারের কাছে। সেই ছোট্ট খোকা একদিন বড় হয়ে উঠল কলেজে পড়তে পড়তে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ল।
ব্রিটিশদের তাড়িয়ে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্র হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিষয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হলো। কিন্তু রাজনীতি তার রক্তে ঢুকে গেছে। তার বুকে স্বপ্ন তৈরি করেছে মানুষের উন্নত জীবন গড়ে তুলতে হবে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে বক্তৃতা দিত। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন করার কারাবন্দি হতে হলো। একদিন বাঙালীর স্বাধিকারের দাবিতে ছয়দফা ঘোষণা করল। আবার কারাবন্দি হলো। কিন্তু তার প্রিয় বাংলার ছাত্র-জনতা তাকে কারামুক্ত করল। বাংলার ছাত্র-জনতা তাকে উপাধি দিল ‘বঙ্গবন্ধু’। দেশে নির্বাচন হলে তার দল বিপুলভাবে বিজয়ী হলো। টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা এবার প্রধানমন্ত্রী হবে। পাকিস্তানের শাসক হবে। কিন্তু পাকিস্তানের স্বৈরশাসকেরা চায়নি, বাঙালী তাদের শাসন করুক। তারা ষড়যন্ত্র পাকাল। কিন্তু খোকা ঘোষণা করে দিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ খোকার নেতৃত্বে সব বাঙালী ঐক্যবদ্ধ হলো, একাত্ম হলো পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সৈন্য নামিয়ে লাখ লাখ বাঙালী মারল, আগুন জ্বালাল ঘর-বাড়ি-বস্তিতে, লুটপাট করল। দীর্ঘ নয় মাস লড়াই করে বিশ্ববাসীর সাহায্যে বাংলার বীর সন্তানেরা বাংলাদেশ স্বাধীন করল। খোকার নেতৃত্বে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্ন সফল হলো। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বীরের বেশে খোকা একদিন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে ফিরে এল।
খোকা আর খোকা রইল না। বিশ্বজোড়া নাম হলো শেখ মুজিবুর রহমান। আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে তিনি হলেন বাঙালী জাতির পিতা। খোকার নাম হলো ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

No comments

Powered by Blogger.