ঈদ অণুগল্প- ভূত হওয়ার আগে

বাবা, আমরা যেহেতু ভূতদের সহ্য করতে পারি না, তেমনি ভূতরাও আমাদের সহ্য করতে পারে না। তাই না?
-হুম্। আমি যখন ভূত ছিলাম, তখন আমাকেও মানুষ দেখতে পারত না।আলাপচারিতার এই পর্যায়ে সামীর পা নাচানো বন্ধ করল। ভুরু কুঁচকে বাবাকে বলল, ‘ধুর। শুধু ননসেন্স জোক!’


আসাদ সাহেব হো-হো করে হেসে ফেললেন। সামীরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘সত্যি। যখন প্রথম মোহাম্মদপুরে এলাম, তখন আমি ভূতই ছিলাম। তোর দাদুও একটা ভূত ছিল। সে ছিল বড় ভূত আর আমি ছোট ভূত। বুঝলি?’
সামীর বলল, ‘বাবা, তুমি কি গল্প বলার চেষ্টা করছ?’ আসাদ সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, ‘না না। আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। শোন, তোর দাদু মানে বড় ভূতটা চাইত ছোট ভূতটা গ্রামে থাকুক। আর মুদির দোকানটা দেখুক। কিন্তু...’
সামীর কথা থামিয়ে দিল। প্রশ্ন করল, ‘মানে, গ্রোসারি শপ?’ ‘হুম, ওইটাই।’ আসাদ সাহেব বললেন, ‘তো, ছোট ভূতটা প্রায়ই বাজারের এক দোকানে রাখা টিভিতে দেখত লাল, হলুদ শহরের একটা ছবি। চার চাকায় গাড়ি চলছে। গাড়ি থেকে রঙিন জামা পরা ছেলেমেয়েরা নামছে। কারও চুল খাড়া, কারও লম্বা বাবরি।
ছোট ভূতটার মতো তেল ল্যাপটানো চুল কারও ছিল না। একটা ইচ্ছা ছিল বুঝলি? ইচ্ছাটা হলো মানুষ হওয়া। ভূত হয়ে আর কদ্দিন?
আসাদ সাহেব হাসলেন। চটাশ করে বাঁ হাতের একটা মশা মারলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘আমি বড় ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ করে এই মানুষের শহরে এলাম। আমার তো ওই একটাই ইচ্ছা। ভূত থেকে মানুষ কীভাবে হওয়া যায়।’
সামীর বলল, ‘মেলভিন মনস্টারের মতো?’
‘কি জানি? ওই হলো। তো শোন, আমি মানুষ হওয়ার চক্করে নেমে পড়লাম বিপদে। কত বড় বড় বিলবোর্ড। গাড়ির হর্ন। রাত-দিনের ঠিক নেই। হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো—ধুর, ভূতরা মানুষ হয় নাকি? ভূতরা ভূতই। আমি তা-ও ভূত হয়ে মানুষের পড়া পড়তাম। কিন্তু যখন মানুষের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করতাম, কেউ দেখতে পেত না। সহ্য করতে পারত না আর কি।’
সামীর পা নাচানো শুরু করল আবার। বলল, ‘হাহ্, মানুষ এত খারাপ না।’
আসাদ সাহেব বললেন, ‘মানুষ মোটেই খারাপ না। আসলে তাদের মাথাটা চট্ করে কোনো কিছু নিতে চায় না।’
সামীর বলল, ‘তারপর?’
আসাদ সাহেব আবার শুরু করলেন, ‘তার পরও আমি মানুষের মতো কথা বলতে চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে বড় ভূতটাকে খুব মনে পড়ত। সে একা ভূতনগরে পড়ে আছে। সে কাছে থাকলে আমার এত কষ্ট হতো না। তো যাই হোক, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমার মানুষ হওয়ার প্রস্তুতি চলতেই থাকল।’
সামীর চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ও-ও-ও।’
‘হুম, মাঝে মাঝে মনে পড়ত, এই মানুষের শহরে আমি একা ভূত। আমার কী হবে? আর এই ভাবতে ভাবতেই একদিন তোর মায়ের সঙ্গে দেখা। বুঝে ফেললাম, শেষমেশ মানুষ হয়ে গেছি। আর ভূত হয়ে মানুষের চোখের অদৃশ্য থাকতে হবে না। দারুণ না?’
সামীর ও কথায় কান দিল না। উল্টো প্রশ্ন করল, ‘আর বড় ভূতটা?’
‘বড় ভূতটা মারা গেছিল।’ আসাদ সাহেব বললেন, ‘আমি অনেক কেঁদেছিলাম। বড় ভূতটা আমার চোখের পানি মুছে দিতে আসেনি। কীভাবে আসবে?’
সামীর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল, ‘হুম, আসলে কীভাবে আসবে?’
দূর থেকে ট্রেনের হুইসল শোনা গেল। স্টেশনমাস্টার ঘণ্টা বাজাচ্ছে। মাস্টারের সঙ্গে স্কুলের মাহতাব কাকুর অনেক মিল। একজন ছুটি হলে ঘণ্টা বাজায়, আরেকজন ট্রেন এলে।
আসাদ সাহেব পাঁচিলের ওপর থেকে সামীরকে নিয়ে নেমে এলেন। সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে। গ্রামের স্টেশনে সন্ধ্যা মানেই ঝুপ করে রাত নামা।
সামীর ট্রেনে ওঠার আগে আসাদ সাহেবের গলা ধরে চুমু খেল। আসাদ সাহেব বললেন, ‘তুই তাহলে কী হতে চাস্ বড় হয়ে?’
‘ভূত হতে চাই বাবা। বড় ভূতটার মতো ভূত।’
‘কী? ভূত?!!! ভূত হবি?’
‘হুম। ভূত হব।’
ততক্ষণে ট্রেন গড়াতে শুরু করেছে। ট্রেনের জানালার ওপাশে তখন ভ্যানগগের ‘দ্য স্টারি নাইট’, আর জানালার এপাশে পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’।
 জুবায়ের আলম
এনএস রোড, কুষ্টিয়া

No comments

Powered by Blogger.