আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে তোমার নয়ন আমায়... গান গাহিবারে- গানে গানে কবিগুরুকে স্মরণ by মোরসালিন মিজান

একটিও কথা নেই। কেবল কবিগুরুর বাণী। কবিগুরুর সুর। সবই ছায়ানটের শিল্পীদের কণ্ঠে। সঙ্গত কারণেই বড় ভাললাগা নিয়ে শুনতে এসেছিলেন শ্রোতা। তবে শুধু গাওয়া আর শোনা নয়, আয়োজনের মাধ্যমে শুক্রবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধা ভালবাসায় স্মরণ করে ছায়ানট।


উপলক্ষÑ কবিগুরুর প্রয়াণ দিবস। হ্যাঁ, কয়েক দিন পিছিয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে বলতেই হবেÑ অনবদ্য।
প্রথমেই চোখ যায় বৃক্ষের সবুজ দিয়ে সাজানো মঞ্চের দিকে। এর পেছনে সাইটস্ক্রিন। সেখানে নদী। নদীতে ঢেউ। সব মিলিয়ে চোখ জুড়ানো সুন্দর। সে সুন্দরের মাঝখানে তরুণ বয়সী রবীন্দ্রনাথ। মঞ্চের দুই সারিতে হাঁটু ভাঁজ করে বসেছেন ১৮ জন গায়ক গায়িকা। একেবারে সামনের দুই কোণে সুর তোলার অপেক্ষায় হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা, এস্রাজ আর মন্দিরা। অপেক্ষার শেষ হয় সকাল সাড়ে দশটায়। ভরপুর মঞ্চ থেকে একসঙ্গে কণ্ঠ ছাড়েন শিল্পীরাÑ তপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে/ হৃদয় আমার, শ্যামল-বধূর করুণ স্পর্শ নে...।
প্রথম পরিবেশনাতেই মুগ্ধ মিলনায়তন। মুহুর্মুহু করতালি। এর পর প্রথম সারি থেকে একক কণ্ঠ বাজে। শিল্পী দীপ্তি দাস। শ্রাবণের আনন্দ অনুভূতির কথা জানিয়ে তিনি গেয়ে শোনানÑ আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে/ দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে, ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে...। চমৎকার এ পরিবেশনা শেষ হলে পেছনের সারি থেকে সুর তোলেন ফারজানা আক্তার পপি। অদ্ভুত সুন্দর একটি কণ্ঠ। এ কণ্ঠে আকুলতাÑ আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে/ যে কথা শুনায়েছি বারে বারে...। অনুষ্ঠানের প্রথম পুরুষ কণ্ঠশিল্পী সুদীপ সরকার। তিনি গেয়ে শোনানÑ তোমার নয়ন আমায় বারে বারে বলেছে গান গাহিবারে/ ফুলে ফুলে তারায় তারায়...। এ গানের সঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর বেজে যায় তবলা।
সামনের সারির মাঝখানে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছিলেন শিল্পী শারমিন জাহান বুব্লি। মিষ্টি কণ্ঠে তিনি গেয়ে শোনান সেই বিখ্যাত গানÑ বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান...। গানটি শেষ হলে মঞ্চের সব আলো একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। সুর তোলেন সকল শিল্পীÑ পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণ গগন-অঙ্গনে।/ শোন্ শোন্ রে, মন রে আমার, উধাও হয়ে নিরুদ্দেশের সঙ্গে নে...। সম্মেলকের পর মাকছুরা আখতারের একক কণ্ঠ কিছুটা শীতল মনে হয়। তিনি গেয়ে শোনানÑ আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল্/ হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল...।
এ গানের মাঝখানে আবার হঠাৎই জ্বলে ওঠে অডিয়েন্স লাইট। অকারণ এই আলো কিছুটা বিরক্তই করে শ্রোতাদের। যেন ধ্যান ভাঙায়। অবশ্য কয়েক সেকেন্ড পর ফের নিভে যায় সব বাতি। গান শেষ করেন মাকছুরা। প্রথম সারির বাম কোন থেকে নতুন করে সুর ওঠে। ওখানে মানস ভট্টাচার্য। তাঁর কণ্ঠেও শ্রাবণ। চোখ বুজে শিল্পী গেয়ে যানÑ আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি/ মম জল-ছলো-ছলো আঁখি মেঘে মেঘে...। পরের অংশটি এরকমÑ যে গিয়েছে দেখার বাহিরে আছি তারি উদ্দেশে চাহি রে...। মজার ব্যাপার হচ্ছে এ অংশটি গাওয়ার সময়ও দু’চোখ বন্ধ ছিল শিল্পীর। এর পর নিজের জায়গা থেকে একটু সরে এসে হারমোনিয়ামে হাত রাখেন বেনজীর হাফিজা। তাঁর কণ্ঠে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া রাত। বর্ণনাটি এরকমÑ গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে,/ কেন গো মিছে জাগাবে ওরে...। পরের শিল্পীর নাম-ই কিনা বৃষ্টি! অনিন্দিতা বৃষ্টি। কিশোরী এ গায়িকা বাদল দিনে কবিগুরুর মনের চঞ্চল অনুভূতিটুকু জানিয়ে গায়- মন মোর মেঘের সঙ্গী,/ ওড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে/ নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে/ রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম...। এ সময় কণ্ঠে যতটা, তারও বেশি রিমিঝিম রিমিঝিম যেন শোনা যায় প্রদীপ কুমারের মন্দিরায়। গৌতম সরকার ও সুবীর ঘোষও এ সময় মাতিয়ে রাখে মিলনায়তন। তাঁদের তবলায় কান পেতে আশ্চর্য মেঘ গুড়গুড় শোনেন শ্রোতা। অভিভূত হন। কান পেতে রাখেন অনেকক্ষণ। পরের গানটি সম্মেলক। এবারও জেগে ওঠে যেন পুরো মিলনায়তন। শিল্পীরা গেয়ে শোনানÑ এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে।/ সেই আগুনের কালোরূপে যে আমার চোখের ’পরে নাচে...।
সম্মেলক শেষে পর পর দুটি গান করেন শিল্পী আশিকুর রহমান ও সুশান্ত রায়। যখন অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন একটি কণ্ঠ আবার নতুন করে কানে বাজে। গানে ফেরায় শ্রোতাদের। ওঠার প্রস্তুতি নিয়েও অনেকে উঠতে পারেন না। শিল্পীর নাম সুতপা সাহা। পেছনের সারি থেকে তিনি সুর তুলেনÑ বন্ধু, রহো রহো সাথে/ আজি এ সঘন শ্রাবণ প্রাতে।/ ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে...। অসাধারণ এ কণ্ঠের সঙ্গে অপূর্ব বেজে যায় অশিত বিশ্বাসের এস্রাজ আর বীথিকার তানপুরা। গানের মাঝে বিদ্যুত বিভ্রাট দেখা দিলে আবারও একই গান গেয়ে শোনান শিল্পী। শুরুর মতো শেষটিও হয় সম্মেলন পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। এবারÑ যায় দিন, শ্রাবণ দিন যায়।/ আঁধারিল মন মোর আশঙ্কায়...। সবশেষে জাতীয় সঙ্গীত। শিল্পী শ্রোতা সকলেই উঠে দাঁড়ান। সকলেই শিল্পী তখন। এ দৃশ্য কত সুন্দর তা বলে বোঝানো মুশকিল।

No comments

Powered by Blogger.