বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৮১ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. বিলাল উদ্দিন, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরে অবস্থানরত মো. বিলাল উদ্দিন খবর পেলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা তাঁর এলাকায় ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে।


পরে আরও কয়েক দিন তিনি একই খবর পেলেন। এরপর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজ গ্রামবাসীকে সাহস জোগাতে তিনি তাঁর নিজ এলাকায় যাবেন।
তারপর একদিন (সঠিক তারিখ তাঁর জানা নেই) মো. বিলাল উদ্দিন দিনের বেলা ভারতের ঢালু থেকে রওনা হলেন। তাঁর সঙ্গে ৩৫ থেকে ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের দলনেতা তিনি। তাঁদের কাছে অস্ত্র বলতে স্টেনগান, রাইফেল আর হ্যান্ড গ্রেনেড। ভারী কোনো অস্ত্র নেই।
সীমান্ত পেরিয়ে মো. বিলাল উদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও মানুষজন নেই। পথে পড়ল বিরাট এক খোলা ময়দান। হঠাৎ তাঁরা দেখতে পেলেন, সেই খোলা ময়দানের ভেতর কয়েকটি গরুর গাড়ি। সঙ্গে একদল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার। গাড়িতে নানা জিনিসপত্র।
পাকিস্তানি সেনারাও হয়তো তাঁদের দেখতে পেয়েছে। আচমকা শত্রুর সামনে পড়ে ভ্যাবাচ্যাকা মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা মাত্র প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন। যুদ্ধে অংশ নেননি। একমাত্র মো. বিলাল উদ্দিন পেশাদার সৈনিক। তবে তিনিও রেকি (পর্যবেক্ষণ) দলের সদস্য। সরাসরি যুদ্ধ না করে ছদ্মবেশে দেশের ভেতরে রেকি করেন।
পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। মো. বিলাল উদ্দিন মনোবল হারালেন না। তবে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত; সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হবেন কি না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। শেষে সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে সিদ্ধান্ত নিলেন সরাসরি যুদ্ধ না করার।
সহযোদ্ধাদের বললেন, তিনি একাই পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করবেন। তখন তাঁর সহযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরে যাবেন। তারপর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা কাছাকাছি আসামাত্র তিনি তাঁর অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে থাকেন। পাকিস্তানিরাও পাল্টা গুলি শুরু করে।
মো. বিলাল উদ্দিন ছিলেন গাছের আড়ালে ও নিরাপদ স্থানে। আর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা খোলা মাঠে। গুলি বিনিময়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বেশ কয়েকজন হতাহত হলো। এরপর তিনি দ্রুত ওই এলাকা থেকে সরে পড়েন। তাঁর সহযোদ্ধারা আগেই সরে পড়েছেন। এ ঘটনা শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার মরিচপুরানে।
মো. বিলাল উদ্দিন চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি)। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েক বা ক্লার্ক। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট ইবিআরসিতে আক্রমণ করে। সে সময় তাঁরা নিরস্ত্র অবস্থায় ঘুমিয়ে ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে ইবিআরসিতে অবস্থানরত বেশির ভাগ নিহত হন। অল্পসংখ্যক বেঁচে যান। তিনি বেঁচে যান এবং পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১১ নম্বর সেক্টরে পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে মরিচপুরান যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. বিলাল উদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১০৬।
মো. বিলাল উদ্দিন ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি জামালপুর জেলার সদর উপজেলার নরুন্দি ইউনিয়নের নরুন্দি গ্রামে। এখন বসবাস করেন সদর উপজেলার ঘোড়াধাপ ইউনিয়নের গোপালপুর বাজারে। তাঁর বাবার নাম ছাবেদ আলী সরকার। মা জায়তুন নেছা। স্ত্রী জুবেদা খাতুন। তাঁদের তিন মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: মো. বিলাল উদ্দিনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জামালপুর প্রতিনিধি মোস্তফা মনজু এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.