গত বছরের তুলনায় পণ্যমূল্য সব ক্ষেত্রেই কমেছে- সরবরাহ বেশি সবজির by রহিম শেখ

গত বছরের রমজানের শুরুতে পণ্যের বাজার ছিল চড়া। সেই চড়া মূল্য আরও চড়া হয়ে ওঠে রমজানের শেষের দিকে। কিন্তু এ বছর বাজারের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। রমজানের শুরুতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সবজির বাজারে দাম বাড়ার যে গতি ছিল তা শ্লথ হয়ে যায় রমজানের মাঝামাঝি সময়ে।


গত বছরের বাজার মূল্যের তুলনায় এবার পণ্যমূল্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই কমেছে। সবজির বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ বেশি হওয়ায় দাম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মনিটরিং টিম গঠনসহ বেশ কিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করায় বাজার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের রমজানের শুরুতে পণ্যের দামের সঙ্গে শেষ দিকের দামের পার্থক্য ছিল ৫০ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ রমজানের শুরুতে সবজির দাম ছিল চড়া। তখন প্রতিকেজি সবজি মিলত ৩৫-৪০ টাকার মধ্যে। রমজানের শেষের দিকে এসে সেই চড়া দাম আরও চড়া হয় যায়। ৩৫-৪০ টাকা দামের সবজি বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৫০-৭০ টাকা দরে। ওই সময় বিক্রেতারা বলেছেন, টানা বর্ষণে সবজির ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় রাজধানীর বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম ছিল। বিক্রেতারা জানান, আড়তে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেক পণ্যও আসছে না। ফড়িয়ারা গ্রামগঞ্জের হাটে সবজি পাচ্ছেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত পানির নিচে। এ কারণেই দাম বাড়ছে। তবে শুক্রবার কাওরান বাজারে এক বিক্রেতা জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ থাকার কারণে এবার সবজির দাম বাড়েনি। তাছাড়া বন্যায় সবজির তেমন ক্ষতি হয়নি বলে জানান ওই বিক্রেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার সরকার দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে পূর্ব থেকে সতর্ক ছিল। এ লক্ষ্যে মনিটরিং টিম গঠনসহ বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে রমজানকে ঘিরে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে ছিল সরকার। এছাড়া পণ্যের সরবরাহও ভাল ছিল। অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হওয়ার ঘটনাও এবার কম ঘটেছে। সব মিলিয়ে আগের বছরের এ সময় অপেক্ষা এবার নিত্যপণ্যের দাম অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, পণ্য সরবরাহ কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের দাম কমেছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের মনিটরিং পলিসিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। মূলত মনিটরিং সিস্টেমটা কড়াকড়ি করায় এর মধ্যে কোন সিন্ডিকেট সুযোগ করতে পারেনি। তিনি বলেন, রোজা শুরুর আগে নিত্যপণ্যের দাম চড়া হলে তখন পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি হয়। এরই প্রেক্ষিতে সরকার শক্ত অবস্থানে যায়। ফলে নিত্যপণ্যের দামে চলে আসে সহনশীলতা।
জানা গেছে, গত বছর নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ার খবর পাওয়া গেলেও পুরো রমজানেই দাম ছিল চড়া। কাওরান বাজারে বড় ইলিশ (৮০০-৯০০ গ্রাম) প্রতিটি ৪৫০-৫০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে এ বছর রমজানের শুরুতে ব্যবসায়ীরা ইলিশ রফতানি বন্ধ করার দাবি জানান। ব্যবসায়ীদের এ দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ইলিশ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে। ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ পাওয়ায় দামও কিছুটা কমে আসে। শুক্রবার কাওরান বাজারে আকার ভেদে ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২শ’ টাকা থেকে হাজার টাকা।
শুক্রবার কাওরান বাজার ঘুরে দেখা যায় পণ্যের বর্তমান মূল্যের সঙ্গে রমজানের শুরুতে যে মূল্য ছিল তার বেশ পার্থক্য রয়েছে। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লম্বা বেগুন প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, রোজার আগে দাম ছিল বাজারভেদে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। পটোল ৩০ টাকা কেজি, রোজার আগে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। কাঁচামরিচ ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা কেজি, আগে ছিল ৮০ টাকা কেজি। কচুমুখী ৩০ টাকা কেজি, আগে ছিল ৪০ টাকা কেজি। শসা ও বরবটি বিক্রি হচ্ছে ২৫ ও ৩০ টাকা কেজি, আগে ছিল ৩০ ও ৩৫ টাকা। ঢেঁড়স কেজি ১৫ টাকা, আগে ছিল ৩৫ টাকা। শুক্রবার সোয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে প্রতি লিটার ১৩৪ থেকে ১৩৫ টাকা, রোজার আগে ছিল ১৩৬ টাকা। ডিম বিক্রি হচ্ছে হালিপ্রতি ৩৩ টাকায় যা রোজার আগে ছিল ৪০ টাকা হালি। আলু বিক্রি হচ্ছে ২৪ থেকে ২৬ টাকা, রোজার আগে ছিল ২৮ টাকা কেজি। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৪০-১৫০ টাকা কেজি, রোজার আগে ছিল ১৭০ টাকা কেজি। তবে রোজার প্রথম সপ্তাহে মুরগির দাম কমে ১৪০ টাকা নেমেছিল। ফার্ম মালিকরা দাম বাড়ানোর জন্য সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দেশী মুরগি আকারভেদে ২শ’ হতে ৪শ’ টাকায়। চিনি বর্তমান মূল্য ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, রমজানের আগে ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। পেঁয়াজ বর্তমান মূল্য ২৫-৩০ টাকা, রোজার আগে ছিল ৩৪ টাকা। রসুন দেশী ৯০ টাকায় ভারতী ৫০ টাকায়, আলু ২৪ থেকে ২৬ টাকায়, মসুর ডাল ১১২ টাকায়, খেসারি ১০৫ টাকায়, প্যাকেটজাত লবণ কোম্পানি অনুসারে কেজিপ্রতি ২৫ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিপ্রতি ফার্মের মুরগি বাজার অনুসারে বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায় অপরদিকে পাকিস্তানী কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকায়, যা গত সপ্তাহের তুলনায় ১০ টাকা কম। ডিম বিক্রি হচ্ছে হালি প্রতি ৩৩ টাকায় যা গত সপ্তাহে ছিল ৩৪ টাকা। অপরদিকে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ২৮০, খাসি ৪৩০ টাকায়। দেশী মুরগি আকারবেধে ২শ’ হতে ৪শ’ টাকায়।
তবে গত বছর এই দিনে কাওরান বাজারে চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, ঢেঁড়স, পটোল, বেগুন, কাকরোল, করলা ইত্যাদি সবজি ৫০ থেকে ৭০ টাকা বিক্রি হয়েছে। আর কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে কেজি ১৫০ টাকা। হাতিরপুল বাজারে কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ১৬০ টাকা। গত বছর রোজার মাঝামাঝি সময়ে ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা, চিনি বিক্রি হয়েছিল ৭১ থেকে ৭২ টাকা কেজি, সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছিল ১২৫ টাকা, আলু ১৫ থেকে ১৬ টাকা, পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, ডিম বিক্রি হয়েছিল ২৪ থেকে ২৬ টাকা।
শুক্রবার রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, সরবরাহ বেশি থাকায় সবজির দাম ৩০ টাকার নিচে রয়েছে। ফুল কপি প্রতিটি ৪০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, াউ আকার ভেদে ২৫ থেকে ৪০টাকায়, চাল কুমড়া আকার ভেদে ১৫ থেকে ২৫ টাকায়, মূলা ২৫ থেকে ৩০ টাকায়, পটোল ২০ টাকায়, ঢেঁড়শ ২০ টাকায়, কাকরল ২০ টাকায়, করলা ২৫, কচুমুখী ২৪ টাকায়, পেঁপে ১৫ থেকে ২০ টাকায়, চিচিংগা ২০ থেকে ২৪ টাকায়, জিঙ্গা ২০ থেকে ২৫, কাঁচা কলার হালি ১৫ থেকে ২০ টাকায়, চালকুমড়া আকারভেদে ৩০ থেকে ৮০ টাকায়, সাজনা ৫০ টাকায় বিক্রি করছে খুচরা বিক্রেতারা। ধনে পাতা কেজিতে ১৫০ টাকা, বেবিকন প্রতি পিস ২০-৩০, পেপসিকন ২৫-৩০ টাকায়, বিলেতি ধনে পাতা ১ শ’ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের শাকের আঁটি ৫ থেকে ২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মসলা বাজার গত সপ্তাহের মতো স্থিতিশীল ছিল। বিভিন্ন কোম্পানির ৫ লিটার ভোজ্য তেলের দাম ৬৫৪ টাকা ও পাম তেলের লিটার ১১০ টাকা, শুকনো মরিচ ১০০ টাকা, জিরা ২০০ =টাকা, হলুদ ১২০ টাকা, চা পাতা ২২০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। অপরদিকে, খেসারি ১১০ টাকা, মুগ ডাল ১২০ মাসকলাই ১২০ টাকা, পোলাওয়ের চাল ৭৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা। প্যাকেট আটা ২ কেজি ৬৫ খোলা আটা ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। গোটা ধনে ৮০ টাকায়, গোটা হলুদ ১২০ টাকায় টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুক্রবার কাওরান বাজার ঘুরে দেখা যায়, টেংরা কেজিপ্রতি ৩০০ টাকায়, ইলিশ বিক্রি হচ্ছে আকারভেদে ২শ’ টাকা থেকে ১০০০ টাকায়, রুই কেজিপ্রতি ১৬০ টাকায়, গলদা চিংড়ি কেজিপ্রতি ৫শ’ টাকায়, ছোট চিংড়ি কেজিপ্রতি ২শ’ টাকায়, সিং কেজিপ্রতি ৫শ’, মাগুর কেজি প্রতি ৬০০ টাকায়, কাতল কেজিপ্রতি ৩০০ টাকায়, চাষ করা কই কুড়িতে ২শ’ টাকায়, কাচকি কেজিপ্রতি ২শ’ ৫০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
চাল আটাসহ বেশ কিছু পণ্যের তালিকা ডিসিসির মার্কেটে ঝুলিয়ে রাখলেও পে ণ্যর দামের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। তবে এসব পণ্যের মূল্য স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা গেছে। ইরি মোটা চালের দাম লেখা আছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকা, পাইজাম লেখা আছে ২৬ থেকে ২৮ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩২ টাকা পর্যন্ত, মিনিকেট লেখা আছে ৩২ থেকে ৩৭ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। তবে সার্বিকভাবে চালের বাজার স্থিতিশীল ছিল। এসব চাল রোজার আগেও উল্লিখিত দামেই রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে। শিশুখাদ্য বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। ঈদ সামনে রেখে মসলার চাহিদা বেড়েছে। জিরার কেজি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা, এলাচি ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত, গোলমরিচ ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা কেজি, দারুচিনির কেজি ২০০ টাকা, কিসমিস ৩৫০ টাকা কেজি এবং জায়ফল ১৩০০ টাকা কেজি।

No comments

Powered by Blogger.