প্রশাসক নিয়োগ করে চুপ- জেলা পরিষদে নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেই by মোশতাক আহমেদ

আট মাস আগে প্রশাসক নিয়োগ করা হলেও জেলা পরিষদের কাজে গতি আসেনি। প্রশাসক নিয়োগের ছয় মাসের মধ্যে জেলা পরিষদে নির্বাচন দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
এখন জেলা পরিষদের ৬১ জন অনির্বাচিত প্রশাসকের পেছনে সরকারের মাসিক ব্যয় হচ্ছে ৩০ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা।


এ অর্থ দেওয়া হচ্ছে সম্মানী, আপ্যায়ন ভাতা ও গাড়ির জ্বালানি খরচ বাবদ। একজনের পেছনে মাসিক খরচ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা সম্মানী, আপ্যায়ন তিন হাজার ও জ্বালানি খরচ প্রায় ১৯ হাজার। মোট ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা। এই হিসাবে বছরে খরচ হবে তিন কোটি ৬২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।
যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত জেলা পরিষদ নির্বাচন না হওয়া এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগহীনতা খুবই দুঃখজনক। যেখানে জেলা পরিষদের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে, টাকা খরচ হচ্ছে, সেখানে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাখা ঠিক হচ্ছে না।
আইন অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের পাঁচজন নারী সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদ গঠন হওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট এলাকার সিটি করপোরেশন (থাকলে), উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের নির্বাচন করবেন। আইন অনুযায়ী, জেলা পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসকেরা পরিষদের কার্যাবলি সম্পাদন করবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বাদে ৬১টি জেলা পরিষদে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। আইন অনুযায়ী, জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার গ্রহণ করা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ পর্যালোচনা, জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা করাসহ ১২টি বাধ্যতামূলক কাজ করার কথা জেলা পরিষদের। এ ছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক কল্যাণসহ বেশ কিছু ঐচ্ছিক কাজও তাঁরা করতে পারেন। প্রশাসকেরা জেলা পরিষদ উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চুয়াডাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জ, নাটোর, মেহেরপুরসহ কয়েকটি জেলা পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসক নিয়োগের পরও উন্নয়নমূলক কাজ তেমন হয়নি।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সূত্রমতে, জেলার উন্নয়নমূলক কাজ পর্যালোচনা করে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রশাসক প্রতিবেদন পাঠাননি। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র অর্থবছর শেষ হয়েছে। আশা করছি, এখন প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদের প্রশাসকের বিরুদ্ধে জেলা পরিষদের টাকায় নিজের ও সাংসদের নামে গ্রামের বাড়ির প্রবেশপথে তোরণ নির্মাণের জন্য দরপত্র দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমএলএসএস নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ রকম অভিযোগ আরও বেশ কিছু প্রশাসকের বিরুদ্ধেও। কোনো কোনো জেলায় পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে প্রশাসকদের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।
প্রশাসকদের অনেকে বলছেন, তহবিলের অভাবে তাঁরা কাজ করতে পারছেন না। এ ছাড়া নানাভাবেই তাঁদের ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়েছে। মর্যাদা ও সম্মানী ভাতা নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনা বিভাগের একটি জেলা পরিষদের প্রশাসক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর অধীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বেতন তাঁর চেয়ে বেশি। এটা তাঁর জন্য অবমাননাকর। প্রসঙ্গত, প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে মেহেরপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক মিয়াজান আলী বলেন, ‘আমাদের যে সম্মানী ভাতা দেওয়া হচ্ছে, সেটা খুবই অপ্রতুল। তহবিলের অভাবে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী কাজও করতে পারছি না।’ মর্যাদা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচিত না হওয়ায় প্রশাসকদের কোনো মর্যাদা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি।
প্রশাসক নিয়োগের সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যেই জেলা পরিষদের নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার জাবেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, জেলা পরিষদের নির্বাচনের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু আলম মো. শহিদ খানও বলেন, ‘এ মুহূর্তে জেলা পরিষদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেই।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকার এখন এই নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে চাইছে না। নির্বাচনের ফল নিয়ে চিন্তা তো আছেই, তার ওপর স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় কোন্দল রয়েছে। এ জন্য নির্বাচন নিয়ে সরকারের মধ্যে আগ্রহ কম।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘প্রশাসক নিয়োগের সময় আমরা ভেবেছিলাম নির্বাচন দিয়ে ধীরে ধীরে জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করবে সরকার। এ জন্য তখন আমরা সমর্থনও দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচন না হওয়া বা উদ্যোগ না নেওয়া খুবই দুঃখজনক।’

No comments

Powered by Blogger.