মনের কোণে হীরে-মুক্তো-নতুন বাস্তবতায় কতিপয় মাছের বাড়তি মর্যাদা লাভ by ড. সা'দত হুসাইন

আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি, মাছ আমাদের অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। ভাতের সঙ্গে মাছের তরকারি, এই আমাদের প্রধান খাদ্য। মুরগি, খাসি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য গরুর মাংস খাদ্যতালিকায় থাকলেও সাধারণ নাগরিকরা মূলত মাছ-ভাতেই জীবন অতিবাহিত করেন। কালেভদ্রে মাংস রান্না হয়।


ঝোল তরকারি ছাড়াও মাছের তৈরি অন্যান্য খাবার, যেমন মাছ ভাজা, মাছের ভর্তা, কোপ্তা মাঝেমধ্যে মধ্যবিত্ত বাঙালি গ্রহণ করে থাকে। শুকানো মাছ বা শুঁটকির তরকারি কোনো কোনো অঞ্চলে উপাদেয় খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে টুকরা টুকরা করে মাছ কেটে হলুদ-মরিচ, তেল-মসলা পানি সহযোগে রান্না করা হয়। দুই পিঠের নিচে ছুরি চালিয়ে চেপ্টা টুকরা বা 'ফিলে' করে মাছ কাটার পদ্ধতি এ অঞ্চলে নেই। শুধু বড় হোটেলে বা উচ্চবিত্তের বাড়িতে ফিলে করে মাছ ভাজা হয় অথবা ওভেনে পোড়ানো হয়, যাকে বেক করা বলে। কখনো ভাঁপে বা স্টিমেও এ রান্না সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।
স্বাদ এবং সৌন্দর্যের বিবেচনায় মাছের শ্রেণী বা স্তরভেদ রয়েছে। বাংলাদেশে সব মাছের শীর্ষে রয়েছে ইলিশ, রুই ও বড় চিংড়ি। এরপরের স্তরে রয়েছে কৈ, মৃগেল, চিতল, ভেটকি, পাবদা, শিং, মাগুর, আইড় ও চান্দা মাছ। মহাশোল, পারসে, খসরুল, পিয়ালি স্থানীয় পর্যায়ে সমাদৃত মাছ হলেও দেশের সব অঞ্চলে এসব মাছ পাওয়া যায় না। বাজারে সরপুঁটি, বড় ট্যাংরা, গুলশা, বোয়াল, পোয়া, বেলে মাছের চাহিদা রয়েছে। জিয়ল মাছ হিসেবে শিং-মাগুরের একটা বিশেষ সমাদর রয়েছে। এদের স্বাস্থ্যকর মাছ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং রোগীর স্বাস্থ্য উদ্বূারের জন্য শিং-মাগুরের ঝোল খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। বাজারে পুকুরের পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়ার সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও এদের সমাদর তেমন নেই। বস্তুত মেহমান থাকলে খাবারের মেন্যুতে এ মাছগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
স্বাধীনতার পর একদিকে যেমন বাংলাদেশের সরকারি মহলে মেহমানদারির সংস্কৃতি পাল্টেছে তেমনি অন্যদিকে বাজারে ভিন্ন রুচির গ্রাহক তথা বিদেশি গ্রাহকের সমাগম ঘটেছে। দুই দশক ধরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় দেশি মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে। বিদেশিরা আসার ফলে ও বিদেশে মাছ রপ্তানি করার কারণে কয়েক জাতীয় মাছের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি তাদের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বেশ কয়েকটি মাছের দাম সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এদের মধ্যে চিংড়ি, রূপচান্দা, ভেটকি ও শোল মাছের নাম উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে মাঝারি আকারের চিংড়ি মাছও সাধারণ ক্রেতা বা নিম্ন-মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। চিংড়ি তখন সীমিত মর্যাদার মাছ ছিল। ধর্মীয় অজুহাত তুলে চিংড়ি না খাওয়ার পক্ষে কেউ কেউ নানা যুক্তি উপস্থাপন করত। এ কথা সত্য, যে যুক্তিতে কাঁকড়া খেতে বারণ করা হয়, একই যুক্তিতে চিংড়ি খাওয়াও বারিত হতে পারে। শুধু ধর্মীয় আচারে লোকজ সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে এই দুই জলজ প্রাণীর মধ্যে এত বড় পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। সুস্বাদু কাঁটাহীন চিংড়ি মাছ বিদেশি গ্রাহকের খুব প্রিয়, এ মাছই বিদেশে প্রথম থেকে রপ্তানি হতে শুরু করে। ফলে এর দাম এত বেড়ে যায় যে দেশের বাজারে খুব সামান্য পরিমাণ চিংড়ি বিক্রির জন্য আনা হয়। দেশের বাজারে বিদেশি ক্রেতা ও অভিজাত হোটেলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্বাধীনতার পর ভেটকি, শোল, চান্দা মাছের দাম স্বল্পসময়ের মধ্যে কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
এসব মাছের চাহিদা বাড়ার কারণ হচ্ছে এগুলোতে ছোট ছোট কাঁটা নেই। ফলে এ মাছ থেকে ভালো মানের 'ফিলে' করা যায়, যা বেশি কাঁটাওয়ালা মাছে সম্ভব নয়। শোল মাছ স্বাধীনতার আগে উৎকৃষ্টমানের মাছ হিসেবে বিবেচিত হতো না। কারণ শোল-গজার মাছ রুঠো মাছ হিসেবে বিবেচিত। শোল-গজারের দামও বেশি ছিল না। কিন্তু কাঁটা না থাকার কারণে 'ফিলে' করার জন্য যেমন একে ব্যবহার করা যেতে পারে, তেমনি চায়নিজ বা একই ধরনের রান্নার জন্যও এ মাছ বিশেষ উপযোগী। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোল-গজারের দামও অনেক বেড়ে গেছে। ভেটকি, চান্দা, সামুদ্রিক কোরাল ও বড় পোয়া মাছের চাহিদা ও দাম একই কারণে অনেক বেশি। বাইন মাছের কদর আগে কম ছিল, সাপের সঙ্গে চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে বিধায় অনেকেই এ মাছ খায় না, কিন্তু এর মাংসে কাঁটা নেই বলে বিদেশি ও অভিজাত হোটেলের ক্রেতাদের কাছে এর বেশ চাহিদা রয়েছে। এককথায় স্বাধীনতা-উত্তরকালে এর মর্যাদা বেড়েছে। বিদেশিদের কাছে প্রিয় খাদ্য হলেও বাংলাদেশে এখনো 'সি উইড'-এর বেচাকেনার প্রচলন হয়নি। এদিক থেকে বাংলাদেশ অস্বাভাবিকভাবে পিছিয়ে আছে।
সরকারি মহলে মেহমানদারি সংস্কৃতির পরিবর্তনের কারণে ছোট মাছের মর্যাদাও বেশ কিছুটা বেড়েছে। স্বাধীনতার আগে দেখেছি বিভিন্ন সার্কিট হাউস ও সরকারি মেহমানখানায় সাধারণত মোগলাই ও কন্টিনেন্টাল মেন্যুর সংযোগে রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হতো। স্বাধীনতার পর মাছ-ভাতের মেন্যু প্রচলিত হয়। মুরগি, গরু বা খাসির মাংস অবশ্য থাকে। কিন্তু খাওয়া শুরু হয় টাকি কিংবা চিংড়ি মাছের ভর্তা, কাঁচকি, মলা বা বাতাসি মাছ এবং সবজি ভাজি দিয়ে। তারপর রুই বা কোরাল, চান্দা মাছ ও সবার শেষে মুরগি বা খাসি বা গরুর মাংস। ছোট মাছ পরিবেশনকে স্বাগতিক কর্মকর্তা তাঁর একটা বাহাদুরি মনে করেন। এক সার্কিট হাউসে উচ্চপর্যায়ের স্বাগতিক কর্মকর্তা বললেন, 'তাঁরা খবর নিয়ে জেনেছেন আমি ছোট মাছ খুব পছন্দ করি, তাই তাঁরা বিশেষ যত্ন নিয়ে ছোট মাছ রান্না করেছেন। আমি মনে মনে হাসলাম, কারণ ছোট মাছ আমার তেমন পছন্দের কোনো মাছ নয়। দ্বিতীয়ত, আমি এ ধরনের পছন্দের কথা কোনো দিন কাউকে বলিনি। কাঁচকি, মলা, বাতাসির দাম বাড়ার আরো একটা কারণ হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে এ মাছগুলো এখন বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। ফলে যে কাঁচকি মাছ কয়েক মাস আগেও কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে কিনেছি, সে মাছের কেজি এখন ৪০০ টাকা হাঁকা হচ্ছে।'
বেশি দামের ভালোমানের মাছগুলো চলে যাচ্ছে বিদেশে। যেমন- দেশের বাজারে খুব বড় ইলিশ পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও অনেক দাম, এত টাকা দিয়ে কিনতে মন চায় না। দেশি বড় কৈ-এর বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। বিদেশে যখন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়ি বেড়াতে গেছি তখন তারা বিরাট বড় ইলিশ মাছ ও দেশি কৈ খেতে দিয়েছে। এর জন্য বিদেশি মুদ্রায় যে তাদের অনেক অর্থ খরচ করতে হয়েছে, তা নয়। তারা যে আয় করে তা দিয়ে অতি স্বাচ্ছন্দ্যে এই বড় মাছ কিনতে পেরেছে। কৌতুক করে তাই বলেছি, ভালোমানের দেশি মাছ খেতে হলে এখন বিদেশে যেতে হবে।
এ কথা ঠিক যে দেশি বাজারেও কিছু নতুন জাতের মাছ এবং পুরনো জাতের কিছু মাছের উন্নত প্রজন্ম দেখা যাচ্ছে। এখন অনেক বড় আকারের গুলশা, পাবদা, সরপুঁটি, তেলাপিয়া, বেলে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া চাষের কৈ, চাষের শিং-মাগুরও পাওয়া যাচ্ছে। চাষের কৈ অত সুস্বাদু না হলেও দেশি কৈং-এর তুলনায় দাম কম, আফ্রিকান মাগুরের মতো এর তেমন কোনো বদনাম নেই। অন্যান্য মাছের সরবরাহ সন্তোষজনক। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এসব মাছই বাজার টিকিয়ে রাখে, অন্যথায় এ সময় মাছের দারুণ আকাল দেখা দিত। এ ক্ষেত্রে ময়মনসিংহের ফিসারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা এফআরআইর অবদান অনস্বীকার্য। নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে তারা বহু উন্নত প্রজন্মের মাছ বাজারে আনতে সক্ষম হয়েছে।
আসলে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে অবহেলিত কিছু মাছের স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাড়তি মর্যাদা লাভ আমরা প্রথম দৃষ্টিতে সহজভাবে নিতে পারি না। এটি আমাদের বাজার ও রন্ধন সংস্কৃতির জড়তার ফল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আমাদের মানসিক সীমাবদ্বূতা। বাজারে কিছুটা সামন্তবাদী ধারায় মাছের চাহিদা ও দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। বড় রুই, কাতল, ইলিশ, চিতল, বোয়াল ও জিয়ল মাছের প্রতি আমাদের আকর্ষণ ছিল বেশি। খাদ্যগুণ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও কাঁচকি, মলা, বাতাসি, ট্যাংরা, চিরিং, চেঁওয়া, তাপসে, মেনি, ছোট বেলে, চেপলি, চাপিলা, পিয়ালি, পারসে, ভাগনা, ঠেলা কিংবা কাকিলা, খলসে, বেতরঙ্গী, তুলাদাণ্ডি, লইট্যা মাছকে আমরা অবজ্ঞা করেছি, যদিও খাদ্যগুণের দিক থেকে এ মাছগুলো সব সময় সমাদৃত হওয়ার যোগ্য ছিল। এগুলোর মধ্যে কিছু মাছ অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখার যোগ্য ছিল, কিন্তু আমরা সে জায়গা বিদেশি বাহারি মাছের জন্য সংরক্ষিত রেখেছি। অবশ্য সব ছোট মাছই যে নির্দোষ ও সুস্বাদু, তা নয়। এর মধ্যে কিছু বিষধর মাছও রয়েছে, যেমন পটকা মাছ। পটকা মাছে টেট্রোডো টক্সিন (টিটিএক্স) রয়েছে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী বিষ। আমাদের দেশে অনেক লোক বাছ-বিচার না করে এ মাছ খেয়ে মারা গেছে।
ছোট মাছ রপ্তানি ও দেশি বাজারে এর দাম বাড়ার বিষয়টি আমাদের রপ্তানিকারক ও দেশি ভোক্তাদের স্বার্থের বৈপরীত্য সম্পর্কে আমাদের সজাগ করে দেয়। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে রপ্তানির বিপক্ষে কোনো কথা বলা আমার পক্ষে শোভা পায় না। তবুও রপ্তানির কারণে যদি দেশি ভোক্তাদের পক্ষে কোনো খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তবে সে রপ্তানি অন্ততপক্ষে সীমিত করা সমীচীন হবে। চিংড়ি ছাড়া অন্যান্য মাছের রপ্তানি রমজান মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রমজানের পরও কোন মাছ কী পরিমাণ রপ্তানি করা যাবে, তা বিশদ পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

No comments

Powered by Blogger.