বাংলাদেশের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ by ডা. সামন্ত লাল সেন

আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে ১৯৭১-৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ডা. আর জে গাস্ট বাংলাদেশে আসেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একজন অর্থোপেডিক সার্জন। পরে তিনি প্রয়োজনের তাগিদে ভারতের লুদিয়ানা থেকে ভারতীয় প্লাস্টিক সার্জন ডা. পারভেজ বেজলীলকে


সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ করার জন্য নিয়ে আসেন। এ থেকেই শুরু বাংলাদেশের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির ইতিহাস। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্লাস্টিক সার্জন প্রয়াত অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ আশির দশকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যোগদান করেন। তাঁরই একান্ত প্রচেষ্টায় একদল চিকিৎসক- যাঁদের মধ্যে ছিলাম আমি, ডা. সামসুদ্দিন, ডা. সালেক, ডা. শহীদুল বারী, ডা. আশরাফুজ্জামানসহ অন্যরা। এসব চিকিৎসকের একান্ত প্রচেষ্টায় শুরু হয় বাংলাদেশে আলাদাভাবে বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এখানে আরো একজন সহযোগিতা করেন, যিনি হলেন প্রয়াত অধ্যাপক কবির উদ্দিন আহমেদ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে সরকারের কাছে অধ্যাপক শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে আলাদা একটি বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট শুরুর আবেদন জানানো হয়। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম ও সবার একান্ত চেষ্টায় ২০০৩ সালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিট আলাদা জায়গায় নতুন ভবনে যাত্রা শুরু করে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর আনুমানিক ছয় লাখ মানুষ বিভিন্ন কারণে আগুনে পুড়ে যায় এবং তাদের বেশির ভাগেরই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। ফলে বর্তমানে এ হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী থাকে ২৫০ থেকে ৩০০ জন। কারণ দেশের মধ্যে এটিই একমাত্র সরকারি পর্যায়ে বার্ন হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত। অতএব দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে রোগীরা আসে এবং চিকিৎসা নেয়। এখানে এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ যোগ দিয়েছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোর্স এ ভবনে চালু হয়েছে। ফলে চিকিৎসার মান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক চার হাজার শিশু ঠোঁট ও তালু কাটা হিসেবে জন্ম নিচ্ছে। বাংলাদেশে এ জন্মগত ঠোঁট ও তালু কাটা একটি বড় সামাজিক সমস্যা। এদের চিকিৎসাও এ বিভাগের আওতায় পড়ে। এ বিভাগে ২০০০ সাল থেকে একটি প্রোগ্রামের আওতায় সারা দেশে জন্মগত ঠোঁট ও তালু কাটা রোগীদের বিভিন্ন মোবাইল ক্যাম্পের মাধ্যমে অপারেশন করা হয়। সম্প্রতি আমেরিকান দাতব্য সংস্থা স্মাইল ট্রেইনের সঙ্গে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তির আওতায় সারা দেশ থেকে এ ধরনের শিশুদের ঢাকায় এনে বিনা মূল্যে অপারেশন করা হবে। এতে চিকিৎসসেবার পাশাপাশি স্নাতকোত্তর ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হবে।
বর্তমানে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিট একটি প্রকল্পের আওতায় চলছে এবং এখানে কর্তব্যরত ২৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন। এ প্রকল্পটি অতি দ্রুত রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের প্রয়োজন। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিটকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করে দ্রুত জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে এখানকার জনবল সংকট অনেকাংশে দূর হবে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের ১৪টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মোট ৯৮টি বিভিন্ন স্তরের পদ সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বগুড়ায় বিশেষজ্ঞ সার্জন পাঠানো হয়েছে। তাঁদের নিজস্ব ইউনিট খোলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া ঢাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিগগিরই ২৫ থেকে ৩০ শয্যার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পদের বিপরীতে এবং এসব পদমর্যাদার যোগ্যতাসম্পন্ন প্রায় ১৭ জন আছেন, যাঁদের মধ্যে অধ্যাপক তিনজন, সহযোগী অধ্যাপক একজন ও সহকারী অধ্যাপক ১৩ জন। বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁদের প্রতিজনের একটি ইউনিট চালানোর ক্ষমতা আছে। তা ছাড়া ২৬+১৮ = ৪৪ জন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা বিভিন্ন মেয়াদে আগামী পাঁচ বছরে বিশেষজ্ঞ সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করতে পারবেন বলে আমি আশাবাদী। পরিশেষে আমরা মনে করি, আমাদের এ বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট একটি ছয় তলা ভবনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং এ ইউনিটে বর্তমানে দুজন অধ্যাপক, একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং দুজন সহকারী অধ্যাপক কর্মরত। এখানে বর্তমানে ৩৪ জন স্নাতকোত্তর ছাত্র আছেন, যাঁরা প্লাস্টিক সাজারি বিষয়ে ডিগ্রি অর্থাৎ এফসিপিএস ও এমএস ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত। এ ভবনটিতে একটি আধুনিক লাইব্রেরি আছে, যেখানে প্লাস্টিক সার্জারির বিভিন্ন বই ও জার্নাল আছে। একটি পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট হতে যা কিছু দরকার সবই আছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এঙ্মি ব্যাংকের সহায়তায় বার্ন ইউনিটে একটি অত্যাধুনিক ১০ বেডের আইসিইউ অতিসত্বর শুরু হচ্ছে। অতএব এ ইউনিটটিকে একটি বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হিসেবে রূপান্তর করা একান্ত দরকার। তাহলে এখানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বাড়বে এবং এতে আমরা মনে করি আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে পোড়া ও প্লাস্টিক সার্জারি রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়া সম্ভব হবে। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.