প্রতিবেশী- ইন্ডিয়া, নাকি হিন্দুস্থান, নাকি ভারত? by শান্তনু মজুমদার

বাংলাদেশের বিপুল-প্রতিবেশী দেশটির জন্মদিন এই ১৫ তারিখ। দেশটির সরকারি নাম দুটো—রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া ও ভারত গণরাজ্য। সরকারি ওয়েবসাইটে ঠিক এভাবেই অর্থাৎ ইংরেজি নামটি প্রথমে, তারপরে দেশি ভাষার নামটি দেওয়া আছে। কেন ভিনদেশি নাম আগে, দেশি নাম পরে? লাগসই একটি ব্যাখ্যা হয়তো দেশটির কর্তারা দিতে


পারবেন। নিজ দেশের সরকারি নাম সম্ভবত কোনো দেশের লোকই নিত্যপ্রয়োজনে ব্যবহার করে না। যেমন—আমরা আমাদের দেশের নাম হামেশা উচ্চারণের সময় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ বলি না। আমরা বলি ‘বাংলাদেশ’। সাধারণ ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ বলে না; বলে ‘স্টেটস’। এটাই প্রচলিত। এটা ঠিক আছে। লক্ষণীয়, আমাদের প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রে প্রচলিত নাম কিন্তু একটি নয়, গোটা তিনেক—ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান, ভারত। প্রতিবেশীদের কথা বাদ দিলে, এই দেশ এখন সারা দুনিয়ার কাছে দস্তুরমতো ‘ডার্লিং’। বিদেশিদের কাছে এই দেশ হচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’। কলোনিয়াল প্রভুদের দেওয়া নামে বিদেশিদের কাছে পরিচিত হওয়ার প্রসঙ্গটি এক পাশে থাকুক। বলার কথা হচ্ছে, দেশটিকে কিছুটা বুঝতে চাইলে দেশটির প্রচলিত তিনটি নামের কোনটি দেশটির কোন স্তরের বা কোন লাইনের নাগরিকেরা কোন অর্থে ব্যবহার করে, সেদিকে নজর ফেলা যেতে পারে।
‘শাইনিং ইন্ডিয়া’, ‘টিম ইন্ডিয়া’, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’, ‘মি. ইন্ডিয়া’। ‘ইন্ডিয়া’ নামেরই জয়জয়কার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। দশক দেড়-দুই আগে মুক্তবাজারি লাইন ধরার পর থেকে ‘ভারত’ নামটিকে স্পষ্টতই ‘ইন্ডিয়া’র কাছে জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তথাকথিত বিশ্বায়নের যুগে মগজ ধোলাইয়ে নিযুক্ত পশ্চিমা মিডিয়ার প্রভাব শুধু নয়, ‘ভারত’-এর জায়গায় ‘ইন্ডিয়া’র তেড়েফুঁড়ে ওঠার পেছনে ক্রমপ্রসারমাণ উচ্চমধ্যবিত্তের বড় ভূমিকা আছে। বহু আগে মাদার ইন্ডিয়া নামে ছবি হয়েছিল বটে; কিন্তু আজকের দিনে ‘ইন্ডিয়া’ নামটির ব্র্যান্ডকরণের সঙ্গে সে নামের তফাত দুস্তর। আর এই ব্র্যান্ডকরণে, মোট কথা ‘ভারত’কে ‘ইন্ডিয়া’ নামের ব্র্যান্ড হিসেবে গড়েপিটে নেওয়াতে দেশের ভেতর বিশেষ ভূমিকা পালন করছে মুক্তবাজারি জমানার উচ্চমধ্যবিত্ত। এরা প্রথাগত মধ্যবিত্তের চেয়ে আলাদা জীবন যাপন করে। বিকাশমান এই উচ্চমধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আজকাল অনেক লেখালেখি হয়। জয়নাথ তাদিনাদা বলে প্রায় অখ্যাত এক লিখিয়েকে পাওয়া গেল। তাদিনাদা বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিক থেকে তাঁর দেশে সংখ্যায় বাড়তে থাকা এই উচ্চমধ্যবিত্তের অনেক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন খানিকটা অ-সিরিয়াস ভঙ্গিতে; কিন্তু এগুলো কাজের। কয়েকটি এ রকম—এরা প্রতিবেশীর সঙ্গে পরিপূর্ণ সম্পর্কহীনতায় স্বচ্ছন্দ। সব সময় ব্র্যান্ডের ঘড়ি-জামা-জুতা ইত্যাদি সজ্জিত থাকে। ধনীদের মতো ‘২৬ লাখ রুপির খাঁটি জার্মান শেপার্ড’ না হলেও প্রেস্টিজ টিকিয়ে রাখতে ল্যাব্রাডর বা ডালমাতিয়ান কুত্তা পালে; ধনীদের মতো বাড়িতে জিম বানাতে পারে না, কিন্তু দামি হোটেলের জিমের মেম্বারশিপ নেয় বহু খরচায়। ধারে হলেও গাড়ি কেনে। হোটেল গেটে নেমে নিজের ব্যাগ পোর্টার এসে টেনে নেওয়ার অপেক্ষায় থাকে। নাপিতের কাছে নয়, ইউনিসেক্স সেলুনে যায়। এরা বিনা ভাবনায় দেড় শ রুপি খরচা করে ৩০০ গ্রাম ওজনের সাবওয়ে স্যান্ডউইচ কেনে; এই এরাই আবার এক কিলোগ্রাম টমেটোতে চার রুপি বাঁচাতে সবজিওয়ালার সঙ্গে এক ঘণ্টা চাপান-উতোরে যায়।
তাদিনাদারা বাইরে বলা যায় যে এই উচ্চমধ্যবিত্ত ইংরেজিতে বলে-লেখে-পড়ে-ভাবে এবং ইংরেজি (তথা পাশ্চাত্য) কায়দায় জীবনযাপনে অভ্যস্ত। আবার এই এদের অনেকের মধ্যেই সামন্ত-মানসিকতার উপস্থিতি ভয়াবহ। পশ্চিমের শহরগুলোতে আইটি দক্ষতা থেকে টাকা কামানো তরুণ ইন্ডিয়ানদের দেশের জমিতে বিনিয়োগে দারুণ উৎসাহের সঙ্গে এই কলামটির লেখকের একাধিকবার পরিচয় হয়েছে। দিল্লির উপকণ্ঠে মূলত উচ্চমধ্যবিত্তের জন্য মাত্র দশক খানেকের মধ্যে গজিয়ে ওঠা গুরগাঁও স্যাটেলাইট সিটির কোনো এক এলাকায় নাকি রাস্তার এপার-ওপারের আবাসিক এলাকার যাতায়াত শুধু নিজেদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে বড় রাস্তার নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে নেওয়া হয়েছে, যাতে করে আম পাবলিকের সংস্পর্শে আসতে না হয়—এ খবর বছর দেড়-দুই আগে খুব সম্ভব নিউইয়র্ক টাইমস-এ পড়া। মহারাষ্ট্রে পুনের মতো শহরে উচ্চমধ্যবিত্তরা নিজেদের জন্য একান্ত এলাকা বানিয়ে নিচ্ছে। ইন্ডিয়ান এই আপার মিডল ক্লাস শুরুতে ছিল রাজনীতিবিমুখ। এখন এরা রাজনীতিসচেতন। তবে এ সচেতনতার ধরন ভিন্ন। গণতন্ত্র, জনপ্রতিনিধিত্ব এসব মৌলিক বিষয় নয়, এরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে শুধুই সেবা পেতে চায়। এই উচ্চমধ্যবিত্ত, যাদের অনেকে করপোরেট মিডল ক্লাস নামেও ডাকে, ‘ডিগনিটি’ বা ‘আইডেনটি’র রাজনীতি, যা কিনা দীর্ঘদিন ধরে দেশটির রাজনীতির ভিত্তিভূমি, তা নিয়ে মাথায় ঘামায় না। তার কথা হচ্ছে, আমি ট্যাক্স মারফত ‘কড়ি’ ফেলছি, তাই রাষ্ট্র আমাকে ‘তেল মাখাতে’ হবে। আরেকটা ব্যাপার হলো, রাজনীতিক আর আমলাদের যে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, সে ব্যাপারে এই উচ্চমধ্যবিত্ত সজাগ হয়ে উঠছে। আদর্শের ব্যাপার নয়, নিজেদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলেই উচ্চমধ্যবিত্ত এটা মেনে নিতে চাইছে না। এখন পর্যন্ত আন্না হাজারে ও বাবা রামদেব টাইপের রাজনৈতিক প্রজ্ঞারহিত লোকজনকে সোচ্চার সমর্থন দেওয়ার মধ্যে মোটামুটি সীমাবদ্ধ থাকলেও, অদূর ভবিষ্যতে দেশটির রাজনীতিতে উচ্চমধ্যবিত্তরা দলে দলে ঢুকতে শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিশ্ব পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমাগত দৃঢ়তর করার জন্যও এটা মনে হয় জরুরি।
ইন্ডিয়াওয়ালাদের পর আসবে হিন্দুস্থানওয়ালাদের কথা। এরা হচ্ছে স্বাধীনতার সময় ‘হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থান, মোল্লা ভাগো পাকিস্তান’ লাইনের লোকজন। ইসলাম অনুসারীদের অভিযানের সময় থেকেই আলোচ্য ভূগোলে যত দুর্গতি; পাকে-প্রকারে এ অনৈতিহাসিক বক্তব্য সম্বল করেই এদের রাজনীতি এবং সমাজদেহের ক্ষতিসাধনের বিরামহীন অপচেষ্টা। অহিন্দুদের, বিশেষত মুসলিমদের জন্য এদের বুক-ভর্তি ঘৃণা। সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদ শক্তি আক্ষরিক অর্থেই তাদের দেশকে ‘হিন্দুস্থান’ বানাতে ইচ্ছুক। হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই রাষ্ট্র পরিচালিত হবে হিন্দুদের ভাবনাতে; এটাই কখনো প্রত্যক্ষে কখনো পরোক্ষে জানান দেয় এরা। সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী ব্যক্তি ও দলের কারও কারও মধ্যে আলগা স্মার্টনেস থাকে। ‘হিন্দুস্থান’ লাইনের প্রধান দলের মধ্যে এই আলগা স্মার্টনেস প্রকট। হিন্দুস্থানপন্থীদের প্রধান দলের দাবি হচ্ছে, তারা যে হিন্দুত্ববাদের কথা বলছে, সেটা ধর্মীয় নয় বা ধর্মরাষ্ট্রমুখী নয়, এটা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ধারণা। আচ্ছা! হিন্দুধর্মীয় উন্মাদনা সম্বল করে রাজনীতি করা হচ্ছে, মসজিদ ভাঙা হচ্ছে, চার্চ পোড়ানো হচ্ছে, অন্য ধর্মের মানুষ মারা হচ্ছে। গুজরাটে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর পরও তাদের নেতা বারবার তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং প্রত্যেকবারই হিন্দুর শ্রেষ্ঠত্বভিত্তিক হিন্দুত্ববাদকেই নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ির কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে জাতি চিহ্নিত হওয়ার প্রতিক্রিয়াশীলতা মান্য করলে এগুলো জাতীয়তাবাদী প্র্যাকটিসের মধ্যে পড়ে বটে। তবে উল্লেখ করে দিতে হবে যে এটা ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা-সম্বল জাতীয়তাবাদ; পাকিস্তান তৈরির ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের’ ন্যক্কারজনক হিন্দু সংস্করণ।
এখন সবার পেছনে ‘ভারত’। ইংরেজিয়ানায় মগ্ন ‘ইন্ডিয়া’ যাকে অগ্রাহ্য করে, পৌরাণিকের ‘মহাভারত’ লিপ্সু ‘হিন্দুস্থান’ যার গলা চেপে ধরে। এই ভারত হচ্ছে যারা দীন-দরিদ্র, যারা ‘দীনের চেয়ে দীন’, তাদের আবাস। ‘ভারতমাতা’—পৃথিবীর মোট গরিবের তিন ভাগের এক ভাগ বক্ষে থাকে যার—‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ অবশ্য এই লজ্জা চেপে রাখে। গরিবি এখানে এমনই যে প্রতি মাসে কমপক্ষে ছয় লাখ কন্যাভ্রূণের গর্ভপাত করানো হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভারতে দুই লাখ ১৬ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, হিসাব ভারত সরকারের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা বেশি হতে বাধ্য। এই হচ্ছে ফাউন্ডিং ফাদারদের সাধের ভারতের সামান্য চিত্র।
জওহরলাল নেহরুদের ‘ড্রয়িংরুম সোশ্যালিজম’ অভুক্ত ভারতকে জীবন-বাঁচানিয়া তেমন কোনো বরাভয় দেয়নি কোনো দিন, বরং তাঁদের অভিজাতসুলভ ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম’-এর মধ্যেই সুপ্ত ছিল আপার ক্লাসের ‘ইন্ডিয়া’র প্রকাণ্ড হয়ে ওঠার বীজ। আজকের ভারতীয় উচ্চমধ্যবিত্ত ভারতকে ‘ইন্ডিয়া’ বানানোর পুরোনো কাজটিতেই নয়া-বেগের সঞ্চার করেছে মাত্র। অন্যদিকে, সদর্থক অর্থে বলা হয়েছে বলে গান্ধীবাদীরা যত দাবি করুন না কেন, এটা তো সত্য যে ভারতের রাজনীতিতে ধর্মের আনুষ্ঠানিক ব্যবহার কিন্তু মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর হাত ধরে। আজকের হিন্দুত্ববাদীদের পূর্ব-প্রজন্মের বিকাশ, মনে রাখা দরকার গান্ধীর ‘রামরাজ্য’ ধারণার পরবর্তী ঘটনা। ‘রামরাজ্য বলতে আমি হিন্দু-রাজ বুঝাই না। রামরাজ্য বলতে আমি ঈশ্বরের রাজ বুঝাই, ঈশ্বরের রাজ্য। আমার কাছে রাম ও রহিম একই জন এবং একই পরমেশ্বর।’ বক্তব্য অতি সুমহান, তবে আমরা দেখতে পাই যে গান্ধী শেষ পর্যন্ত রামের দিকে। উদাহরণস্বরূপ, মৃত্যুর সামান্য কিছুদিন আগে ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে তিনি বলেন, ‘রামচন্দ্র আমাকে যেভাবে নির্দেশিত করবেন, শেষ পর্যন্ত তা-ই হবে। এভাবেই তাঁর বাঁধা সুতোর টানে আমি নেচে যাই। আমি তাঁর সদাহস্তগত আর এ কারণেই আমি এক অনির্বচনীয় শান্তিসুধার পরশ পাচ্ছি।’ রহিম কোথায় এখানে? রহিম নেই। এভাবে হয় না; এসব কারণেই রাষ্ট্রকর্মে ধর্মকে যুক্ত করার কথা বলতে হয় না । যতই ‘রামরাজ্য’তে রাম ও রহিমকে একই বলা হোক, শেষ পর্যন্ত ‘রামরাজ্য’ রামেরই রাজ্য হয়। গান্ধীদের এই ঐতিহাসিক ভুলের পুরো ফায়দা তুলেছে হিন্দুত্ববাদীরা। খেসারত-পর্ব আরও কিছুদিন চলবে; হিন্দুত্ববাদীরা ‘হিন্দুস্থান’ নিয়ে আরও কিছুদিন গুরুত্বপূর্ণ লম্ফঝম্ফ করবে। কিন্তু বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে, বিশ্বপুঁজির সঙ্গে দহরম-মহরম চলতে থাকলেই শেষাবধি ভারত ‘হিন্দুস্থান’ নয়, ‘ইন্ডিয়া’ হবে।
 শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.