অপশাসন- এমডি চাই, এমডি by শাহ্দীন মালিক

প্রথম আলোর ওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রই নিমেষে বুঝে ফেলবেন শিরোনামের এমডি কোন এমডি। তাই লেখাটির শিরোনাম প্রথমে ঠিক করেছিলাম ‘ছাগল’। একটু চিন্তা করে বুঝতে পারলাম, ‘ছাগল’ শিরোনামটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। বলছি।


লেখার শিরোনাম ‘ছাগল’ হলে অসংবেদনশীল কিছু পাঠক অবিবেচনাপ্রসূতভাবে হঠাৎ মনে হয়তো করতে পারতেন যে লেখাটা দেশীয় রাজনীতিবিদদের নিয়ে। শিরোনাম দেখে চটজলদি অধমের কেচ্ছা-বক্তব্যের ব্যাপারে আগেভাগেই যাতে একটা ভ্রান্ত ধারণা না জন্মায়, সে জন্যই ‘ছাগল’ শিরোনামটা বাদ দিলাম।
প্রথম আলোর সুহূদ পাঠককুল অত্যন্ত ধীরস্থির, সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল। সেই ভরসায় অধমের ব্যক্তিগত ছাগল প্রসঙ্গের অবতারণা করার ক্ষোভ সংবরণ দুষ্কর হয়ে পড়ছে। প্রসঙ্গ ব্যক্তিগত হলেও পাঠকেরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, সে ভরসা আছে।
বছর পাঁচ-ছয় আগে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা শুনে এতই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম যে মহা চিন্তাভাবনা, প্ল্যান-প্রোগ্রাম, ক্যালকুলেটর দিয়ে বিস্তর হিসাব-নিকাশ—সবকিছু করে আস্ত এক জোড়া ছাগল কিনেছিলাম। সাভার এলাকায় এক নিকটাত্মীয়ের অব্যবহূত ছোট্ট একটা প্লট ছিল। তাকে রাজি করিয়ে নিজেই সাভার এলাকার গরু-ছাগলের সাপ্তাহিক হাটে গিয়ে জোড়া ছাগল কিনি।
পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে, আমাদের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে ছাগল পুষলে পরিবারের পাশাপাশি দেশ-জাতির অপার উন্নতি ও অগ্রগতি হবে এবং সে সঙ্গে নিজেরও উন্নতি হবে বলে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কেচ্ছা সংক্ষেপ করি। দুই-তিন বছর ধরে প্রচুর চেষ্টাচরিত করার পর বোঝা গেল ছাগলেরা না শোনে প্রধানমন্ত্রীর, না শোনে অধমের কথা। দেশ-জাতি বা অধম কারও কোনো উন্নতির জন্য ছাগলকুল অবদান রাখতে ভীষণভাবে গররাজি। হয় গায়ে-গতরে মাংস লাগে না, না-হয় অসুখ-বিসুখে আকসার আক্রান্ত অথবা কথা নেই বার্তা নেই কথা একজোট হয়ে একসঙ্গে তিন-চারটা ছাগল মারা যায়।
ছাগল দ্বারা দেশোদ্ধারের চেষ্টা, বলা বাহুল্য, ভেস্তে গেছে। হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর উদাত্ত আহ্বানটা যাঁরা আইন পেশায় নিয়োজিত, তাঁদের ব্যাপারে প্রযোজ্য ছিল না। কিন্তু তিনি তো সেটা বলেননি, আর ছাগলই বা বুঝল কীভাবে যে আমি আইনজীবী!

২.
তবে আসলেই রাজনীতিবিদদের ছাগল আখ্যায়িত করা যায়। আমি সুদূর বিদেশি রাজনীতিবিদদের কথা বলছি। অধমের ঘাড়ে নিশ্চয় একাধিক মস্তক নেই যে কোনো রাজনীতিবিদকে ছাগল ডেকে স্ব-মস্তিষ্কের সমূহ বিপদ ডেকে আনব।
আর যে বিদেশি রাজনীতিবিদের কথা বলছি, তিনি যদি সুদূর আফ্রিকার ছোটখাটো কোনো দেশের হন, তা হলে মানহানির মামলাসহ কোনো ধরনের বিপদের আশঙ্কা নিশ্চয় অমূলক।
‘ছাগল’টা করেছে কী শোনেন—সম্পত্তির হিসাব না দেওয়ার জন্য স্বীয় সন্তানকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটি হলেন লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি মিসেস অ্যালেন জনসন সিরলাদ। ঈদের ছুটিতে রেডিওতে বিবিসির খবরে শুনলাম, ভদ্রমহিলা তাঁর দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের (আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক) ডেপুটি গভর্নরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন। কারণ, তিনিও দেশের দুদকের কাছে তাঁর সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেননি। ছেলের নাম চার্লস সিরলাদ। অবশ্য শুধু স্বীয় ছেলে নয়, একই আদেশে সে দেশের আরও ৪৫ জন হোমড়াচোমড়াকেও বরখাস্ত করা হয়েছে একই দোষে।
তাজ্জব কি বাত!
মা হয়ে নিজের ছেলের গাড়ি-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তির হিসাব রাখবেন না তো রাখবে কে। সরকারের দায়িত্বে থাকবেন আর নিজের ছেলের হাতে শত শত লোক যদি টু-পাইস গুঁজে দেয়, তাতে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়?
মা হয়ে ছেলেকে বলবেন দুদকে সম্পত্তির হিসাব দিতে। আর না দেওয়ার জন্য এত বড় পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত?
ওদের দুর্ভাগ্য যে দেশটা বাংলাদেশ থেকে কত দূরে। আমাদের হাওয়া তাদের গায়ে লাগেনি। তাই তো ছাগলের মতো আচরণ।
এ ধরনের মা, মা-জাতের কলঙ্ক। অবশ্য এর পেছনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট একটা বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে। মিসেস সিরলাদ গত বছর রাষ্ট্রপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ঠিক আগে তাঁকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়।
স্পষ্টতই মহিলা অপকর্মে পটু। নিশ্চয় বিদেশিদের সঙ্গে বসে প্রচুর স্যান্ডউইচ খেয়েছেন এবং মদ্যপান করেছেন। না হলে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পেলেন কীভাবে? ছেলে যে টু-পাইস বানিয়েছেন, এমন অভিযোগ সে দেশের দুদক করেনি। সব সরকারপ্রধানই দুর্নীতি দূর করার কথা বলেন। তাই বলে নিজের ছেলের সঙ্গে এহেন আচরণ।
সৎমা কি না, বুঝতে পারছি না। তবে এ গোছের রাজনীতিবিদ রাজনীতি-সম্প্রদায়ের কলঙ্ক। ছাগল।
ভাগ্যিস, আমাদের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদেরা লাইবেরিয়ার উদাহরণ অনুকরণ করেন না। নোবেল প্রাইজও রাজনীতিবিদদের দরকার নেই। ওগুলো গরিবের রক্তচোষারাই পাক!

৩.
‘...রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে...’ তিনি অধ্যাদেশ জারি করবেন।
ওপরের শর্তগুলো সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের। সংসদ অধিবেশন না থাকা অবস্থায় ওপরে বর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারবেন। অধ্যাদেশ হলো আইন, তবে এই আইন বিশেষ পরিস্থিতিতে সংসদ অধিবেশন না থাকার কারণে রাষ্ট্রপতি জারি করেন। অধ্যাদেশ জারির পর সংসদ বসলে সংসদ বসা বা সংসদের অধিবেশন ৩০ দিন অতিক্রান্ত হলে অধ্যাদেশটি আপনাআপনি বাতিল হয়ে যায়। ওই অধ্যাদেশ বা আইনটি বলবৎ রাখতে হলে সংসদকে সেটা নতুন আইন হিসেবে পাস করতে হবে।
এখন প্রসঙ্গ, ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি ৪ সেপ্টেম্বর সংসদের অধিবেশন ডেকেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিয়োগসংক্রান্ত আইনটি পরিবর্তনের কী এমন আশু প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রপতির কাছে ‘সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান’ হলো যে, সংসদ বসার যে দিন দশেক বাকি, সেই ১০ দিন অপেক্ষা করা গেল না। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি কি ৪ সেপ্টেম্বর সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে সরাসরি হবেন।
স্পষ্টত এত তাড়াহুড়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ৪ সেপ্টেম্বর সংসদ অধিবেশন বসলে তখন তা আইন হিসেবে পাস করলে সপ্তাহ দুয়েক বিলম্বের কারণে দেশ-জাতির নিশ্চয় মহা বিপর্যয় ঘটত বলে কোনো ভীষণভাবে মারদাঙ্গা সরকারপন্থী লোকও বোধ হয় দাবি করতেন না। অর্থাৎ এই সমালোচনা নিশ্চয় করা যায়, রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির যে ব্যতিক্রমধর্মী বিশেষ ক্ষমতা সেটার অপব্যবহার করা হয়েছে। সংসদকে ছোট করা হয়েছে।
বিরোধী দল ইতিমধ্যে বলেছে, তারা অধ্যাদেশটি বাতিল করবে। এই অধ্যাদেশের অধীনে নিয়োজিত এমডি সাহেবের কী হবে, সেটা এখনো বলা হয়নি। তবে কী হতে পারে, তা আঁচ করতে বিরাট কেউকেটা নিশ্চয় হতে হবে না। অবশ্য যে ব্যক্তি এখন নতুন সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তিনি নিশ্চয় আশা করবেন যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি যেন ক্ষমতায় না আসে। অর্থাৎ তাঁর এমডি পদ আর আমাদের আগামী নির্বাচনের ফলাফল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার আশঙ্কা বা সম্ভাবনা, যে যেভাবে নিক, তৈরি হয়েছে।
ইদানীং নতুন যে ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের কীর্তিমান কিছু সাংসদের জড়িত থাকার খবর থেকে এই উপসংহারে আসা যাক যে বর্তমান সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কিছু কিছু সাংসদের প্রচণ্ড ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা আছে। তাঁদের একজনকেই গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন এমডি নিয়োগ করাই সবচেয়ে বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে। অন্তত ইদানীংকালে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে বিবেচনাবোধের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে এ ধরনের এমডি নিয়োগ সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ হবে।
শেষ পর্যন্ত কেউ নিশ্চয় গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিযুক্ত হবেন। অধমের আগ্রহ অত্যন্ত সীমিত, আবেদন করবেন কে? পরিচিতদের মধ্যে প্রাইভেট ব্যাংকের দু-একজন এমডি আছেন। লিখতে লিখতে ভাবছিলাম তাঁদের ফোনে জিজ্ঞাসা করি, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি হওয়ার জন্য দরখাস্ত রেডি করছেন নাকি? এই প্রশ্ন করলে তাঁরা যে অধমকে পুনরায় সম্পূর্ণ গবেট ভাববেন, সে আশঙ্কা থেকে তাঁদের আর জিজ্ঞাসা করলাম না। তা সত্ত্বেও আশা করব, সিলেকশন কমিটি দরখাস্ত/ আবেদনকারীদের নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করবে। সাংবিধানিক পদ না হয়েও বিশ্বজুড়ে গ্রামীণ ব্যাংকের যে এমডি পদ নিয়ে এত আলাপ-আলোচনা, সে পদপ্রার্থীর নাম জানার অধিকার আমরা দাবি করছি। দেখতে চাই, জানতে চাই কারা আবেদন করছেন।

৪.
বেশ কয়েকবার ভেবেছি, ঠাট্টা-বিদ্রূপ বাদ দিয়ে সিরিয়াস লেখা লিখব। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত তো সিরিয়াস, অর্থাৎ যৌক্তিক ও বিবেচনাপ্রসূত হতে হবে। এক মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী কতবার বললেন যে দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে। এখন একদম চুপ। প্রধানমন্ত্রী এবং এক অর্থনীতিবিদের কথায়, অনেকটা ছাগল পালন করে দেশ-জাতির সমৃদ্ধি আনার মতো, চার-চারটা পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। সে স্বপ্ন প্রথম আলোতে জাহিরও করেছিলাম। এখন নাকি সরকার আবার বিশ্বব্যাংকের কাছে ধরনা দিচ্ছে।
অর্থাৎ ক্রমাগত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ঠেলায় আমরা দিশেহারা। আর সরকারি সব লোক স্বপ্নে বিভোর।
শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.