পাণ্ডিত্যের তেজস্ক্রিয়তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া by সুভাষ সিংহ রায়

সক্রেটিসের এক প্রিয় শিষ্য ক্রিটো কারাধ্যক্ষের সামনে একথলি স্বর্ণমুদ্রা ঘুষ দিয়ে বলেছিল, তার গুরুকে যেন কারাগারের পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দেয়া হয়। কারাধ্যক্ষ রাজি হয়েছিল। পরে সক্রেটিস এ কথা জানতে পেরে বলেছিলেন, ‘কি বললে ক্রিটো?
সক্রেটিস পালাবে! বিচারককে, আইনকে অমান্য করবে? এই শিক্ষাই আমি তোমাদের দিয়েছি? আজকের বাংলাদেশে যাঁরা সুকুমারবৃত্তির নেশায় আপ্লুত তাঁরা প্রায় সবাই সক্রেটিসের জীবনদর্শনের কথা বলে থাকেন। কিন্তু বিচারককে, আইনকে প্রায়ই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেন। অথচ মুক্তবুদ্ধির এই মানুষগুলোর অনেকেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। দীর্ঘ ২১ বছরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের মধ্যে খ্যাতিমানদের অনেকেই বাকশালের সমালোচনায় সময় পার করেছেন। অনেক জ্ঞানীগুণী জিয়াউর রহমানের খালকাটার ওপর বড় বড় প্রবন্ধ লিখেছেন। এখন এই প-িতজনের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচক। সক্রেটিস, প্লেটোর এই গুণমুগ্ধরা এখন আইন, বিচারক, বিচারালয়ের ওপর তীক্ষè নজরদারি করে থাকেন। তাঁদের অনেকের কথা শুনে মনে হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারই এদেশের উৎকৃষ্টতম সরকার। যে কোনভাবেই হোক অনির্বাচিত সরকার তাঁরা চান। এক্ষেত্রে আইন, সংবিধান, আদালতের রায় কোন কিছুতেই তাঁদের বিবেচনায় নেই। জিয়াউর রহমানের ‘হ্যাঁ,’ ‘না’ ভোট, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন বলে কোন বস্তু কি এদেশে ছিল? সেসব নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আধাঘণ্টার মধ্যে রাঙ্গামাটির ফলাফল চলে আসত, ভোলার মনপুরার ফলাফলও এক ঘণ্টার মধ্যে ঘোষণা করা হতো। তখন এদেশে অনেকেই এসব অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করেছে। অনেকেই সামরিক শাসকদের পরামর্শকও ছিলেন। অনেকেই আক্ষেপ করে বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু বিনা দোষে মারা গেছেন। এক্ষেত্রে সক্রেটিসের একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। সক্রেটিস হেমলক পান করার সময় তাঁর আরেক প্রিয় শিষ্য ফিডো কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলÑ‘হে আমাদের গুরু, বিনা দোষে তোমাকে মরতে হলো! কি বললে ফিডো! ‘দোষ করে, অপরাধ করে মরবে সক্রেটিস! সত্যিই তো, আমাদের জাতির পিতা কোন দোষ করে, অপরাধ করে মারা যাননি। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি এদেশের মানুষকে বেশি রকমের ভালবাসতেন। তিনি নিজেই বলতেন এ রকম করেই। আমরা অনেকেই ফরাসী দার্শনিক আঁদ্রে মালরোর কথা জানি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সরাসরি সম্মুখসমরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বয়সের কারণে তা পারেননি। কেননা, তখন তাঁর বয়স ছিল ৭০ বছর । ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। সেই সফরের কোন এক সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, শেখ মুজিব কি পারবেন দেশটাকে দাঁড় করাতে? সঙ্গে সঙ্গে আঁদ্রে মালরোর সুতীক্ষè জবাব, আপনারা শিক্ষিতরা যদি শেখ সাহেবকে মেরে না ফেলেন তাহলে নিশ্চয় পারবেন। খুবই আশ্চর্য এক ব্যাপার হচ্ছে, বাঙালী উচ্চ শিক্ষিত সমাজ সম্বন্ধে এ রকম একটি যথার্থ মন্তব্য কিভাবে করলেন। পাঠকের মনে থাকার কথাÑআগেরবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওসমানি উদ্যানে গাছকাটা নিয়ে কি হৈচৈই না হয়েছিল। এর পরের বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে রাজধানীসহ সারা দেশে গাছকাটার কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। চলতি মাসের ২৩ আগস্ট বাংলাদেশী-আমেরিকান ফার্মাসিস্টস্ এ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) একটি বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকায় এসেছি। আটালিংক সিটি সমুদ্র তীরের তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলুেন যোগ দিতে নিউইয়র্ক থেকে ২০০ কিলোমিটার রাস্তার এই যাত্রায় আমাদের লেগেছিল ৫ ঘণ্টার কাছাকাছি। যে পরিমাণ যানজট তা আমাদের বাংলাদেশের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কারণ শনিবারে আমেরিকানরা নাকি আটালিংক সিটির দিকে যাত্রা করে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে। যখন এই লেখা লিখছি তখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দিকে নিশ্চয় বিশাল যানজট। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। কিন্তু প্রতিবছর দু’বারের জন্য বাড়ি যাওয়া ও ঢাকায় ফিরে আসার এই কষ্ট কি একদিনেই সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ বাড়ছে হু হু করে, সঙ্গে গাড়ি বাড়ছে পাল্লা দিয়ে, রাস্তা কি বেড়েছে? বছরের শুধু এই দুই সময়ের জন্য অতিরিক্ত পরিবহনের ব্যবস্থা করা যাবে না। কেননা, সারা বছর গাড়িগুলো যাত্রী পাবে না। এদেশের সরকারগুলো গণপরিবহনের দিকে কখনই নজর দেয়নি। বিশেষ করে রেল পরিবহন সব সময়ই অবহেলার শিকার ছিল । অথচ এবারের ঈদে বাড়ি ফেরার সময় মানুষ যেভাবে রেলের দিকে ঝুঁকেছে আগে কখনই তো তা দেখা যায়নি। সরকার ইচ্ছা করলেই কি ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস্তা চার লেনের করতে পারবে। রাস্তার দু’পাশে কি এতটুকু জায়গা রেখেছি? জমি অধিগ্রহণ করা এত সহজ কাজ। মামলামোকদ্দমা পেরিয়ে কোন কাজ করা খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু আমরা খুব সহজে অনেক কিছু বলে ফেলি। সব ধরনের গণতান্ত্রিক সরকারই সমস্ত অব্যবস্থা তৈরি করবে আর আওয়ামী লীগকেই তার দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। অন্য সরকারগুলো মানুষকে লোভী বানাবে, ভোগদখলকারীর সুবিধা দিয়ে যাবে আর আওয়ামী লীগ সরকারকে তার প্রতিকারের দায়িত্ব নিতে হবে। এই অসুবিধাগুলোর কারণে উচ্চমধ্যবিত্তশ্রেণীর এক বড় অংশ আওয়ামী লীগবিরোধী। উচ্চমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের অনেক চাহিদা আওয়ামী লীগ পূরণ করতে পারে না। মুখে নৈতিকতার কথা বলতে হবে আর অনৈতিক সুবিধার অপেক্ষায় থাকতে হবে; এটাই হচ্ছে উচ্চমধ্যবিত্তের সংস্কৃতি। সবচেয়ে বড় মজার ব্যাপারÑযারা কখনই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি তারাও আওয়ামী লীগের কাছে সব কিছু ভাল আশা করে থাকে। বাংলাদেশে ভোগবাদ আর ভাববাদের সঙ্গে নৈরাশ্য একটি জায়গা করে নিয়েছে সমাজের অবক্ষয়ে। এটি শুধু সামাজিক ব্যাধি নয়। একটা সমাজবিরোধী চিন্তা। অতএব, যারা আমাদের হতাশায় ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করবে তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। নেতিবাচক চিন্তা কোনদিনই কোন কাজ সফল করেনি। পৃথিবীতে যত বড় বড় লড়াই জিতেছে সবই ইতিবাচক চিন্তার ফসল। আমাদের জ্ঞানবান মানুষদের অনেকেই প্রথাগত শিক্ষায় সুশিক্ষিত কিন্তু কুসংস্কারে বিশ্বাসী। কুসংস্কার এই অর্থে কাজ করব না; কিন্তু পরামর্শ দেব। এগুব না ; কিন্তু অনুসরণ করব। ঈদের আগে ৭০ থেকে ৮০ লাখ লোক একই সময় ঢাকার বাইরে যায়। আমাদের সেই ক্ষমতা আছে কিনা? বছরে দু’বার এত মানুষের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা করা বেশ কঠিন। কেননা, আমাদের সেই অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর সময় অল্প সময়ে যেভাবে রাস্তাঘাট গড়ে তোলা হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি। যাঁরা বিগত দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন তাঁদের অনেকে রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে ছিলেন, তাঁরা নিজেরাও ভাল করে জানেন কোন্ ক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছিলেন। সামরিক সরকারের অধীনে মুখে বুজে সময় অতিবাহিত করেছেন। দেশের অবকাঠামোর কোন পরিবর্তন দীর্ঘ পঁচিশ-ত্রিশ বছরে হয়নি। অথচ এখনকার কোন ইতিবাচক পরিবর্তন তাঁরা চোখে দেখেন না। আমাদের অনেকেই খবর রাখেন না, আর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে রেলপথে দ্রুতগতির চায়না ট্রেন যুক্ত হচ্ছে। এ কাজটি নীরবে-নিভৃতে হয়ে যাচ্ছে। নিউইয়র্ক থেকে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যেতে আমার পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে। অথচ লাগার কথা ৩ ঘণ্টা। এই হাইওয়েগুলো কোনটা ৪ লেনে যাওয়া ও ৪ লেনের আসার। তারপরও এ রকম যানজট। আর আমাদের দেশের যানজট জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে ; মানুষের কর্মঘণ্টা একেবারে শুষে নেয় এই যানজট। কিন্তু এ নিয়ে আগের সরকারগুলো ভাবেনি কেন। হঠাৎ করেই ঈদ উপলক্ষে নতুন টেন নামানো যায় না। কেননা, রেললাইন না থাকলে রেলগাড়ি চলবে কিসের ওপর। রেলের লাইনই তো নেই; আর রেলের জায়গা দখল হতে হতে এখন দখলের জন্য অবশিষ্টাংশ এতটুকুও নেই। যারা দখলদার সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে তারা সামঞ্জস্য রেখে চলে। তাছাড়া ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে রেললাইন যাওয়াতে শহরের যানজটে মাত্রা যোগ করে। এই রেললাইন কমলাপুর থেকে ঢাকার বাইরের অংশ দিয়ে অর্থাৎ রামপুরার পেছনদিক দিয়ে টঙ্গীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা যায়। এই প্রথম শেখ হাসিনার সরকার রেল নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত আসতে দেড় ঘণ্টা পার হলে আটটার ট্রেন আটটায় ছাড়বে কি করে ? ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হিসেবে দিনরাত ছোটাছুটি করছেন, রেলের কর্মকর্তাদের দায়িত্বপালনের জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। মানুষের কষ্টের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন; এটাও প-িতদের পচ্ছন্দ হচ্ছে না। যাঁরা কখনও পাশের বাসার প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলেন না তাঁরাও মন্ত্রীর কর্মকা-ের সমালোচনা করেন। নেতৃত্ব তাঁরা কোনদিনই দেননি; অবসরপ্রাপ্তরা চাকরি জীবনে নিজের অফিসের তোয়ালেওয়ালা চেয়ারে বসে দশটা-পাঁচটা সময় পার করেছেন। সরকারী গাড়ি ছেলেমেয়েদের স্কুলের সামনে সারাদিন বসিয়ে রাখতেন, তাঁদের অনেকেই এখন অবসরজীবনে সমাজসেবক তকমা লাগাতে চান। আদর্র্শহীন আচার-আচরণকেও কুসংস্কার বলা যেতে পারে। তাদের জানা নেই নেতৃত্ব কাকে বলে? ঔড়যহ ঈ গধীবিষষ তাঁর বহু পঠিত গ্রন্থ য়ঁধষরঃরবং ড়ভ ষবধফবৎ লিখেছেন ষবধফবৎংযরঢ় ফবাবষড়ঢ়ং ফধরষু ‘হড়ঃ রহ ধ ফধু’ । এই বই মাত্র দুই মাসে ৫ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। নেতৃত্বের সমালোচনা করা সহজ, পরামর্শ দেয়াও সহজ। যাঁরা বাংলাদেশে নিজেদের ছোটখাটো সক্রেটিস ভাবেন তাঁরা কোনদিন দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হননি। যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী বিশ্বজিৎ সাহার প্রশ্ন ছিল, ‘শেখ হাসিনা কি পারবে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করতে?’ ফরাসী দার্শনিক আঁদ্রে মালরোর মতো করে বলেছিলাম, ‘অবশ্যই পারবেন; যদি শিক্ষিত মানুষরা তাঁকে হত্যা করতে না পারে। কেননা, ভয় হয়, প-িতদের তেজস্ক্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।’

তারিখ ২৫ আগস্ট, ২০১২, আর্লান্টিক সিটি , যুক্তরাষ্ট্র
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
suvassingho@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.