সড়ক দুর্ঘটনা ॥ স্বপ্নের অপমৃত্যু

যে চোখের ভেতর ভালবাসার রঙিন পৃথিবী এসে নিঃসংকোচে আশ্রয় নিয়ে ছিল, যার সৌন্দর্যে ওলট-পালট হয়ে গিয়ে ছিল আমার সব কিছু। না, আমি কোন বনলতা সেন কিংবা রণজিতার কথা বলছি না । এ আমার অগোছালো দৃষ্টিতে চিরন্তন সৌন্দর্যের প্রতীক, আমার হৃদয় মন্দিরের দেবী নন্দিতার কথা বলছি। যার আরাধনা করেছি সকালÑসন্ধ্যার


প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ। যার সাথে আমার মনের সন্ধি হয়ে ছিল সেই দূরন্ত কৈশরে। যাকে ভাল বেসেছিলাম মনের অজান্তেই। পরবর্তীতে আমাদের ঘনিষ্ঠতা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে পারিবারিকভাবেই সিদ্ধান্ত হয় নন্দিতাই হবে আমার লাইফ পার্টনার। আমিও ওকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন সাজাতাম। ২০০৭ সাল। প্রতিবছরের মতো এ বছরও নন্দিতা ওর ছোট কাকার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেল। যাওয়ার আগে আমি ওকে বলেছিলাম, হয়ত দশÑপনেরো দিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। তোমাকে না দেখে কি আমি থাকতে পারব? নন্দিতা ওর চিরচেনা হাসি দিয়ে বলল, দেখা হবে না তাতে কি ফোনে তো কথা হবে! আর তোমার হৃদয়ের চোখ দিয়ে আমায় দেখার চেষ্টা কর দেখবে ঠিকই দেখতে পাবে। নন্দিতা চলে গেল। গ্রামে ওর সময় বেশ আনন্দেই কাটছিল কারণ, ও যখন যা করত তাৎক্ষণিক তা ফোনে শেয়ার করত। ৩-৪ দিন পর হঠাৎ ফোন করে নন্দিতা বলল, রাতুল, একটা গুড নিউজ আছে। আমি বললাম কি ব্যাপার তাড়াতাড়ি বল! ও বলল, রাতুল আজ রাতের গাড়িতে আমি বাসার (খুলনা) উদ্দেশে রওনা হচ্ছি। কথাটা শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ও আরও বলল, আর একটা কথা বলি সকালে হয়ত বের হতে পারব না তাই বিকেলেই দেখা করব। সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে যখন গাড়ি ছাড়ল তখনও অনেক কথা হলো নন্দিতার সঙ্গে। রাত পৌনে ২টা পর্যন্ত দু’জনের কেউই চোখের পাতা এক করলাম না। কল আর মিসডকলের মধ্য দিয়েই সময় কেটে গেল। অনেকক্ষণ হয়ে গেল ওর কোন সাড়া পাচ্ছি না। তাহলে কি ও ঘুমিয়ে গেছে? এই ভেবে আমি ওকে ফোন করি। কিন্তু ওর নাম্বারটা বন্ধ পাই। যত বার ডায়াল করি ততবার অপরপ্রান্ত থেকে বলে, দুঃখিত এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না...।’
আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল। রাত আনুমানিক ৩.১০ কি ৩.১৫ হবে। হঠাৎ আমাদের দরজায় কে যেন খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিল। অমি আমার রুমের লাইট অন করে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কে? দরজার ওপাশ থেকে শব্দ এলো আমি তোমার মতিন আঙ্কেল (নন্দিতার বাবা)। আমি দরজাটা খুললাম। আমাদের এতক্ষণের চেঁচামেচিতে বাবাও জেগে গেলেন। বাবা এসে বললেন, কি ব্যপার মতিন সাহেব, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আঙ্কেল অনেকটা বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, সন্ধ্যায় নন্দিতা আর ওর ছোট কাকা খুলনায় আসার জন্য রওনা দিয়েছে। রাতে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে কিন্তু হঠাৎ ঘণ্টাখানেক ধরে ওর নাম্বারটা বন্ধ পাচ্ছি। আর ওর কাকার নাম্বারে কল ঢুকছে কিন্তু রিসিভ করছে না। বাবা বললেন, হয়তবা ওর ফোনে চার্জ নেই। আতিক (নন্দিতার ছোট কাকা) হয়তবা ঘুমিয়ে গেছে। এমনি সময় আঙ্কেলের ফোন বেজে উঠল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে এত রাতে আবার কে ফোন করল বলে রিসিভি করলেন। ওপাশ থেকে একটা অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো বলে মনে হচ্ছে। আঙ্কেল বলল কে বলছেন? লোকটি বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনি কি নন্দিতার বাবা বলছেন? জি বলছি, বললেন আঙ্কেল। লোকটি বলল, আপনি যত দ্রুত পারেন যশোর সদর হাসপাতালে চলে আসেন। আমাদের বুঝে উঠতে আর বাকি রইল না হয়ত নন্দিতার কিছু একটা হয়েছে। সকাল হতেই আমরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। হাসপাতালের বারান্দায় ঢুকতেই দেখি আমার ভালবাসার মানুষটি শুয়ে আছে। নন্দিতার গায়ে থাকা ওর প্রিয় কালো রঙের ড্রেসটা রক্তে ভিজে আরও নিকষ কালো হয়ে গেলেও ওর নিষ্পাপ মুখে যেন তখনও ঝরছে অনিঃশেষ হাসির ঝর্ণাধারা।
ওর রক্তমাখা মুখটা দেখে আমি অবোধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভেতরটা কেঁদে উঠেছিল এই বলে, না, নন্দিতা তুমি এভাবে চলে যেতে পার না। তুমিই তো বলেছিলে বিকেলে দেখা করবে। তারপর দু’জনে ঘুরে বেড়াব শহরময়। একবার তাকিয়ে দেখ নন্দিতা, তোমার রাতুল কেমন প্রলাপ বকছে। প্রকৃতির টানে আজও বসন্ত ফিরে আসে। চারদিক হয়ে ওঠে বসন্তময়, বৃষ্টির পরশে জেগে ওঠে পত্র পল্লব। শুধু নন্দিতা ফিরে আসে না। অসহায় এই আমি নন্দিতার অপেক্ষায় থেকে থেকে ভুলে গেছি দিন-রাতের পার্থক্য। তবুও মন বার বার বলে ওঠে, নন্দিতা ফিরে এসো। আমার নন্দিতা যেখানে চলে গেছে সেখান থেকে কেউ হয়ত কোন দিন ফিরে আসে না। দেশের কোন না কোন স্থানে ঘটছে এমন অসংখ্য স্বপ্নের অপমৃত্যু। তাই ডি-প্রজন্মের সব বন্ধুদের কাছে অনুরোধ, আসুন আমরা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যে যার অবস্থান থেকে কাজ করি। বাড়াই জনসচেতনতা। যাতে এভাবে আর কাউকে অকালে
চলে যেতে না হয়।
টি. এম মোস্তাসিম

No comments

Powered by Blogger.