ঢাকায় শব্দদূষণঃ কিছু কথা by ইমরান রহমান

স্বার্থের প্রয়োজনে মানুষ প্রতিনিয়তই পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছে নানাভাবে। এর মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। পৃথিবীর বড় বড় শহরের নাগরিক দুর্ভোগের একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত এই শব্দদূষণ, বিশেষ করে আমাদের ঢাকায় এই দুর্ভোগ উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানকার কোলাহলপূর্ণ জনজীবনে এটি এখন অতি সাধারণ ঘটনা।

এখানে চলাচলকারী বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনে ব্যবহৃত হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন। এছাড়াও মাইক্রোফোন, উচ্চগ্রামে বাজানো ক্যাসেট, মাইকের যথেচ্ছচার ব্যবহার, ইটভাঙার যন্ত্র, জেনারেটর প্রভৃতির কারণে রাজধানীতে শব্দদূষণের মাত্রা অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শব্দের প্রয়োজন আছে। কেননা এই শব্দ দিয়েই মানুষ তার আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কিন্তু এই শব্দই যখন সাধারণ শ্রবণ মাত্রা অতিক্রম করে কর্ণকুহরে বিঁধে তখনই সৃষ্টি হয় দূষণের। প্রতিটি মানুষের নির্দিষ্ট শব্দমান সহ্য করার স্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে। কান একদিকে মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়, অন্যদিকে মানুষের দেহের ভারসাম্য রক্ষাকারী অঙ্গও। কানের ৩টি অংশ। বাইরের কান, মধ্যবর্তী কান এবং অন্তর্নিহিত কান। শব্দতরঙ্গ বায়ুর সাহায্যে বাইরের কানের গহ্বরে প্রবেশ করে। কর্ণের পর্দায় কম্পন সৃষ্টি করে। মধ্যবর্তী কানে অবস্থিত ৩টি অস্থির স্পর্শে এই কম্পন আরও প্রবল হয় এবং কানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। শ্রবণ কোষ শব্দকে শ্রবণ স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণ কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। এ প্রক্রিয়ায় মানুষ শব্দ শুনতে পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্কার মতে, মানুষের শরীরে সহনীয় শব্দ মাত্রা ৪০-৪৫ ডেসিবল। চিকিত্সকদের মতে, ৬৩ ডেসিবল শব্দমাত্রা প্রাথমিকভাবে বধিরতা সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় যখন ঢাকায় ব্যস্ত সড়কের শব্দমাত্রা ৭০ থেকে ৯০ ডেসিবল, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কোন ঝুঁকির মধ্যে আমাদের বসবাস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই মাত্রা ১০৬ ডেসিবল পর্যন্ত। তারপরও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।
মোটরযান অধ্যাদেশের ১০৯ ধারায় বলা হয়েছে, অতিমাত্রায় হর্ন বাজানো নিষেধ। এ অপরাধে জরিমানা মাত্র ১০০ টাকা। জানা যায় উচ্চরক্তচাপ, স্নায়ুবিক বিভিন্ন রোগসহ ৩০টি রোগের অন্যতম কারণ শব্দদূষণ। এর ফলে মানুষের মেজাজ খিটখিটে ও অল্পতেই অস্থির হয়ে যায়। শব্দদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। অথচ তারা জাতির ভবিষ্যত্ কাণ্ডারী। শব্দদূষণজনিত যে মনোদৈহিক অপরিমেয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা, জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় তার ফয়সালা কি ওই ১০০ টাকায়ই যথেষ্ট?
রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন বাড়ছে জনসংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যান চলাচলও। বাড়ছে শিল্প-কারখানা। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাড়ি। ইট ভাঙার যন্ত্র, মাইকিং আর কোলাহলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাইড্রোলিক হর্ন। ঢাকা যে এরই মধ্যে একটি দূষণের নগরী হয়ে উঠেছে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। রাজধানীর ভেতরে ও বাইরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কারখানার কালো ধোঁয়ায় রাজধানীর পরিবেশ হয়ে উঠেছে বিষবাষ্প। বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। শুধু তাই নয়, নষ্ট হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে দূষিত করা হচ্ছে পরিবেশ। আর এর সঙ্গে হাইড্রোলিক ও শব্দদূষণের অন্যান্য উত্স মিলে পরিবেশ দূষণে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
কিন্তু এই দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আদৌ কি গৃহীত হয়েছে? পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে দেশব্যাপী সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করা গেলেও তা যেন টেবিল-চেয়ার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে এর কোনো ফল পাওয়া যায় না। বিভিন্ন দেশে দূষণ নিয়ন্ত্রণে যখন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তখন আমরা বাংলাদেশে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা না গেলে এই দূষণ রোধ করা যাবে না। ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও হাইড্রোলিক হর্ন কীভাবে আমদানি হয়, বিক্রি হয় ও ব্যবহৃত হয় সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ করতে আরও কড়া আইন করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.