হাতিরঝিল প্রকল্পের ৯০ ভাগ কাজ শেষ, ডিসেম্বরে খুলে দেয়া হবে- ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ৪৩টি মামলা এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় by ফিরোজ মান্না

হাতিরঝিল প্রকল্পের এখন চলছে শেষ পর্বের কাজ। এ মাস পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় নির্মিত চারটি ব্রিজ, চারটি ওভারব্রিজের এ্যাপ্রোচ রোডসহ সার্ভিস রোড এবং এক্সপ্রেস রোডের বিটুমিন কার্পেটিং করার কাজ শুরু করা হবে।


এই কাজ শেষ করার পর বাকি থাকবে মুক্তমঞ্চ, লেক ঘাট, বাগান এবং অবকাশ কেন্দ্র উন্নয়নের কাজ। এরপর ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। উন্মুক্ত করে দেয়ার পরেও কিছু কাজ বাকি থাকবে। এসব কাজ চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলবে। প্রকল্পটি শেষ হলে বিনোদনের জন্য ১৮টি ক্যাটাগরির উন্নয়ন হবে। তবে সব কিছুর ওপরে এ প্রকল্পের এখনও গলার কাঁটা হয়ে আছে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ৪৩টি মামলা। ৭৬টি মামলার মধ্যে ৩৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। মামলাগুলো প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ গুলো নিষ্পত্তি না হলে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন নাও হতে পারে।
প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রায়হান আল ফেরদৌস সাংবাদিকদের জানান, বর্তমানে হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। তবে প্রকল্প এলাকায় ছোটখাটো জটিলতা রয়েছে। কিছু মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। আশা করা যাচ্ছে অল্প দিনের মধ্যে মামলাগুলো শেষ হবে। আগামী ডিসেম্ব^রের মধ্যেই কাজ শেষ হবে এবং জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্প এলাকায় চরটি ব্রিজ এবং চারটি ওভারপাস নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন চলছে ফিনিশিং টাচ ও এ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের কাজ। এসব ওভারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে দিব্যি সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। অনেকে কৌতূহল নিয়ে দেখতে আসছেন। প্রকল্পের কয়েকটি সড়ক দিয়ে প্রাইভেটকার ও সিএনজি চলাচলও করছে। প্রকল্প এলাকায় চারটি ব্রিজ, চরটি ওভারপাস, ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার সার্ভিস রোড, ৮ কিলোমিটার এক্সপ্রেস রোড, ২৬০ মিটার ভায়োড্যাক্ট, প্রায় ১২ কিলোমিটার ওয়াকওয়েসহ ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে ডাইভারশন স্যুয়ারেজ এবং স্পেশাল ডাইভারশন স্ট্রাকচার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। প্রকল্পের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে গুলশান সংযোগকারী একটি ব্রিজ এবং রামপুরা ব্রিজের দু’পাশে দু’টি ইউলুপ নির্মাণ। এ দু’টি ইউলুপ নির্মাণের কারণে হাতিরঝিল থেকে আসা সড়কটি রামপুরা প্রগতি সরণিতে এসে মিলে যাবে। এ জন্য কোন ইন্টারসেকশনের প্রয়োজন হবে না। ফলে বাড়তি যানজটের সৃষ্টি থেকে মুক্ত থাকবে। রামপুরা ব্রিজ এলাকায় বিদ্যমান যানজট কমে যাবে। টঙ্গী ডাইভারশন রোড অংশে ইউলুপ নির্মাণ করা হচ্ছে না। সাতরাস্তা থেকে মৌচাক পর্যন্ত প্রস্তাবিত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। এখানে ইউলুপ নির্মাণ করা হলে এই ফ্লাইওভারে গতিপথ বাধাগ্রস্ত হবে। তবে ফ্লাইওভারের একটি র‌্যাম হাতিরঝিলের একটি সড়কের সঙ্গে মিশে যাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, বড় কাজের মধ্যে এখন সার্ভিস রোড, এ্যাপ্রোচ রোড এবং এক্সপ্রেস রোডের বিটুমিন কার্পেটিং বাকি রয়েছে। বিনোদন ক্যাটাগরিতে ১৮টি উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে বাগান নির্মাণ, পাম গাছ লাগানো, মুক্তমঞ্চ নির্মাণ, ব্রিজ ও ওভারপাসে লাইটিং, বিভিন্ন স্ট্যান্ডে যাত্রী শেড নির্মাণ, ট্যাক্সিপার্কিং নির্মাণ। বিনোদন প্রকল্পের জন্য এখনও পুরোপুরি অর্থ ছাড় হয়নি। অর্থ ছাড়ের ওপর এ গুলোর বাস্তবায়নের গতি অনেকটাই নির্ভর করবে। লেকগুলোর খনন কাজ চলছে। এখন বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজ চলার কারণে লেকের জলে ময়লা-আবর্জনা দেখা গেলেও প্রকল্প শেষ হলে এর ধারা হবে স্বচ্ছ। চারপাশে থাকবে ওয়াক ওয়ে, বোট ঘাট এবং বসার জায়গা। বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করছে রাজউক। আর যৌথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ান, ঢাকা ওয়াসা এবং এলজিইডি। প্রকল্পের পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়।
বর্তমানে প্রকল্পের গলার কাঁটা হচ্ছে ৪৩ মামলা। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা না থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণ মামলা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী অনেক কর্মকর্তা চিন্তিত। প্রকল্পের শুরুতে ৭৬টি ভূমি অধিগ্রহণ মামলা ছিল। এগুলো নিষ্পত্তির কারণে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ মাঝপথে বার বার বাধাগ্রস্ত হয়। যে কারণে ২০১০ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। ৪৩টি মামলা চলমান রয়েছে। এই ৪৩টি মামলার মধ্যে বহুল আলোচিত বিজিএমইএ ভবন অপসারণের মামলাও আছে। মামলার কারণে প্রকল্পের মূল দু’টি সড়কের সঙ্গে বিভিন্ন পাড়া বা এলাকার এলাকাভিত্তিক সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। যেখানে সংযোগ দেয়া হবে সেখানে অবৈধ ঘর কিংবা অন্যান্য ছোটখাটো স্থাপনা রাখা হয়েছে। ডিসেম্বরে মূল প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরও এসব মামলার অনেকই চলমান থাকতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রথম পর্যায়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৪৭৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কিন্তু সময় বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তা আরও প্রায় পাঁচ শ’ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা করা হয়েছে। গুলশান সংযোগ করে একটি ব্রিজ, রামপুরা এলাকায় দুটি ইউলুপ এবং সড়কের দৈর্ঘ্য কিছুটা বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। ২০০৩-০৪ সালে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। সে সময় জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার(জাইকা) আর্থিক সহায়তায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। কিন্তু ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তিন দফায় প্রকল্প পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হলে জাইকা সহায়তা প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দেয়। পরে ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রকল্পটি ডিসিসি’র পরিবর্তে রাজউকের অধীনে নিয়ে আসা হয়। এরপর এর দ্রুত বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়।
এদিকে, বহুল আলোচিত হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করার সঙ্গে এর আশপাশের এলাকার জমির দাম একলাফে আট-দশ গুণ বেড়ে গেছে। সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভূমি দস্যুরাও। এমনকি প্রকল্পের সঙ্গে আশপাশের এলাকার সংযোগ সড়ক তৈরির জন্য সংরক্ষিত জমিতে ব্যক্তিমালিকানার সাইনবোর্ড দিয়ে তা বিক্রি করার চেষ্টাও করছে কিছু সংখ্যক ভূমিদস্যু। হঠাৎ করে সেখানে নতুন নতুন মালিক গজিয়ে উঠেছে। যাদের হাতে কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। প্রথম দিকে এসব ভূমিদস্যু, টাউটদের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি। তিনি তখন বলেছিলেন, এ এলাকার জমির দাম এক লাফে এক লাখ থেকে এক কোটি হওয়ার কারণে টাউট-বাটপাররাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধেই এসব টাউট চক্রকে মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সংযোগ সড়ক নির্মাণে তাঁর লোকেরাই বাধার সৃষ্টি করছে। প্রকল্প সংলগ্ন এলাকায় খাস জমি তাঁর লোকেরাই দখলে নিচ্ছে। পাগলা মাঝার এলাকায় ১০ কাঠা জমি দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। যেখান দিয়ে সংযোগ সড়ক হওয়ার কথা ছিল। তবে প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেছেন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতেই হবে। সংযোগ সড়ক না থাকলে এলাকাবাসীর কোন লাভ হবে না।
মগবাজার এলাকার পাগলা মাজার সংলগ্ন অংশে প্রকল্পের ভেতর দিয়ে নির্মাণাধীন রাস্তার ফুটপাথ ধরে কিছুদূর এগোলেই চোখে পড়বে একটি সাইনবোর্ড। এতে লেখা আছে, ‘এই জমির মালিক মেজর মোঃ সেরাফ উদ্দিন খান। পিতা-হাজী মোঃ সালাহউদ্দিন খান, ৫৪৭ নয়াটোলা, মগবাজার, চেয়ারম্যান গলি, ঢাকা-১২১৭।‘ এলাকাবাসী জানান, এই সাইনবোর্ডটি সম্প্রতি লাগানো হয়েছে। এখানে আগে কোন সাইনবোর্ড ছিল না। ২০০৯ সালে হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ শুরু হলে এই জমি মগবাজার পাগলা মাজারের সঙ্গে সংযোগ সড়কের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য আশ পাশের বাড়িওয়ালারা বাড়ির দেয়াল ভেঙ্গে জায়গা দেন। পরে স্থানীয় এমপি আসাদুজ্জামান খান কামাল এলাকাবাসীর অনুরোধে এ অংশ দিয়ে ওয়সার স্যুয়ারেজ ও পানির লাইনও বসিয়ে দেন। ফলে এলাকায় দীর্ঘদিনের পানি সঙ্কটের অবসান ঘটে। অস্থায়ী একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণও হয়। যখন সংযোগ সড়কটি স্থায়ীভাবে নির্মাণের প্রস্তুতি চলছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে এই সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়। সংযোগ সড়কের মুখে নির্মাণ করা হয় টিনশেড ঘর। এখানে পাহারা বসানো হয়েছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। অভিযোগপত্রে লেখা হয়, গাগলা মাজার থেকে সরাসরি রাস্তাটি হাতিরঝিলে মিশেছে। রাস্তাটি সরকারী খাস জমির ওপর দিয়ে গেছে। এর আগে এখানে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী খাস জমি দখল করে বিএনপি একজন প্রভাবশালী সাবেক এমপির কাছে বিক্রি করে দেয়। পরে এই জমি কেনাবেচার কথা কাউকে না জানানোর জন্য ওই বিএনপি নেতার বাহিনী সবাইকে হুমকি দেয়। বর্তমান সরকারের আমলে হাতিরঝিল প্রকল্প শুরু হলে এলাকাবাসী রাস্তার শুরুতে নিচু অংশ ভরাট করে প্রাথমিকভাবে রাস্তা বের করে। পরে এ অংশ দিয়েই ওয়াসার পানির পাইপ লাইন নেয়া হয়েছে। এতে দীর্ঘদিনের পানি সঙ্কট থেকে রক্ষা পান এলাকাবাসী। কিন্তু এখন আবার নতুন সাইনবোর্ড দিয়ে জায়গা দখল করার কারণে আবারও নতুন করে সঙ্কটে পড়েছে এলাকাবাসী। পাহারাদাররা বলেন, এ জমির মালিক মেজর সাহেব।
এলাকাবাসী পাগলা মাজারকে বাঁচিয়ে রেখে এখানে একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন করেছেন। মগবাজার (পাগলা মাজার) এলাকাবাসী ওই আবেদনের অনুলিপি ভূমিমন্ত্রী, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, ঢাকা উত্তরের মেয়র, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, মহা পুলিশ পরিদর্শক এবং র‌্যাব-৩ বরাবর দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.