ঈদোত্তর ভাবনা by ড. হারুন রশীদ

ঈদে গ্রামে গিয়ে এবার একটা নতুন উপলব্ধি হলো। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ যুগে বিশ্বে যেমন সব কিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে তেমনি এই বদলের হাওয়া লেগেছে গ্রাম পর্যন্ত। গ্রাম আর সেই গ্রাম নেই। শিক্ষাদীক্ষা, মানুষের চিন্তাচেতনা, আচার-অনুষ্ঠান, রাজনীতি; সব কিছুতেই পরিবর্তনের একটা ঢেউ লেগেছে।


সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় হচ্ছে, গ্রামীণ জীবনযাত্রা একেবারেই দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নাগরিক মানুষ যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে গ্রামে বসেও এখন তার অনেকটাই পাওয়া যাচ্ছে অনায়াসে। বাড়ি বাড়ি বিদ্যুত, টেলিভিশন, তাতে ডিশ লাইন। ফ্রিজ আছে প্রায় সবার বাড়িতেই। রান্না হচ্ছে রাইস কুকারে বিদ্যুতের মাধ্যমে। টিউবওয়েলে মোটর লাগিয়ে ট্যাঙ্কিতে পানি ওঠানো হচ্ছে। সেখানেও বিদ্যুত। এখন টিপ দিলেই পানি পড়ে। কষ্ট করে টিউবওয়েল চাপতে হয় না। বলতে গেলে জীবনযাত্রা অনেকটাই সহজ হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বিদ্যুতের ব্যবহার। আগে শুধু বাতি জ্বালাতেই বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল। এখন বিদ্যুত নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ জন্য বর্তমান সরকারের আমলে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করেও কুলানো যাচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে মানুষের সব রকম চাহিদার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে।
মানুষ এখন অনেক বেশি রাজনীতিসচেতন। বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন তো আছেই; হাটে-বাজারে, দোকানে এমনকি চায়ের স্টলে ডিশের লাইনসহ টেলিভিশন। চা খাওয়ার পাশাপাশি টিভি দেখে সময় কাটায়। বেশিরভাগই সিনেমার দর্শক। তবে এর মধ্যে বিশাল একটি অংশ আবার টিভি টকশোর দারুণ ভক্ত। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কি সবই তাদের জানা চাই, বোঝা চাই। সর্বশেষ খবর জানার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত জেগে অনেকেই টিভি দেখেন। পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিবাদ মিটল কিনা, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে কি না, এরশাদ কি শেষ পর্যন্ত মহাজোটে থাকবে না-কি ৩শ’ আসনে প্রার্থী দেবে, আওয়ামী লীগ কি বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনে যাবে, না-কি একটা সমঝোতার দিকে এগুবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার করা কি সম্ভব হবে এই মেয়াদেÑএসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায় তারা।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ যত শেষের দিকে যাবে মানুষ আরও বেশি রাজনীতির বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠবে। এখনই তার আলামত দেখা গেল। এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা হিসেবকিতাব শুরু হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দলের নেতারা মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে থাকার জন্য কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন। বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠ দখলের চেষ্টা করছে। তাদের একটা বদ্ধমূল ধারণাÑ বাংলাদেশে এক সরকার দু’বার ক্ষমতায় আসে না। তাই তারা ধরেই নিয়েছে, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসছে। তাদের আচরণের মধ্যেও সেই মনোভাব লক্ষণীয়। অপরদিকে সরকারী দলের লোকজন অপেক্ষাকৃত নীরব। তারা যেন আগেভাগেই মাঠ ছেড়ে দিয়েছে। সরকারে থাকলে যে সমস্যাটা হয় সেই সমস্যা থেকে এ অঞ্চলও মুক্ত নয়। অর্থাৎ নানাভাগে বিভক্ত দল। একেক নেতার নামে একেক গ্রুপ। যাঁরা আগামীতে মনোনয়ন চাইবেন তাঁরাও নানাভাবে গ্রুপিং-লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন গ্রুপিংয়ের যাঁতাকলে পর্যুদস্ত। তাদের ম্রিয়মাণ থাকার পেছনে এটিই বড় কারণ। অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যেও গ্রুপিং রয়েছে। শুনলাম, উপজেলা সদরে বিএনপির না-কি দুই গ্রুপের দু’টি অফিস।
যাহোক এলাকার ছাত্রদের একটা বিরাট অংশ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এদের অনেকেই আবার কলেজের গ-িতেই এখনও পা রাখেনি। স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়েছে। দলে দলে মোটরসাইকেল নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ায়। চুলে বিশেষ ধরনের ছাট। পোশাকে একটা আল্ট্রা মডার্ন স্টাইল। নেতারা এদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। যতটা ‘রাজনীতি’র দিকে এদের আগ্রহ ঠিক ততটাই অনাগ্রহ পড়াশোনার দিকে। এলাকার সার্বিক পড়াশোনার মান ভাল নয়। বিশেষ করে স্কুলগামী ছাত্ররা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় পড়াশোনায় ভাটা পড়েছে। বর্তমান সরকার শিক্ষা খাতে নানাবিধ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু দূষিত রাজনীতির বিষবাষ্প অনেকটাই সেই সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। অন্যভাবে বলতে গেলে এই সাফল্য আরও বেশি হতে পারত যদি ছাত্ররা অধ্যয়নকেই তপস্যা হিসেবে নিত। কিন্তু নেতার নামে সেøাগান দিলে টুপাইস পাওয়া যায়। এলাকার টেন্ডার, চাঁদাবাজিতে ভাগ বসানো যায়। এসব কারণে এ ধরনের ছাত্ররা এখন লেখাপড়ার চেয়ে রাজনীতির দিকেই বেশি আগ্রহী। এরা কোন আদর্শ দ্বারা তাড়িত নয়। নগদ প্রাপ্তির আশায় এরা রাজনীতি করে। দলবাজি করে। তরুণ প্রজন্মের একটা বিশাল অংশকে এই সর্বনাশা প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত। এদের রুখতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যত আরও জটিল- কঠিন হয়ে উঠবে।
রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে মানুষের কল্যাণ চিন্তা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সব সময় সমাজের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর থাকে। কিন্তু এখনকার তরুণদের মধ্যে যারা রাজনীতি করে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে; তাদের অনেকের মধ্যেই এই প্রতিবাদী মানসিকতা নেই। তারা তাদের সহপাঠী নির্যাতনের শিকার হলে তার পাশে দাঁড়ায় না। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতকের ভূমিকা নেয়। এর কোন দলভেদ নেই। সকল দলেই এক অবস্থা। এক শ’ ছেলে মিলে এক নেতার পক্ষে সেøাগান দিতে লোকের অভাব হবে না। কিন্তু একটা ভাল কাজে একজনকেও খুঁজে পাওয়া ভার। এরা পড়াশোনার প্রতি দারুণভাবে উদাসীন। ক্লাব, সমিতি, সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠানাদিতেও এদের আগ্রহ কম। একটা লাইব্রেরী চালাতে গিয়ে দেখেছি হাতের কাছে বই পেয়েও খুব কম ছেলেমেয়েই তার সুযোগ নিচ্ছে। অথচ ছোটবেলায় একটা গল্প-উপন্যাসের বইয়ের জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম। আরেক যন্ত্রণা মোবাইল ফোন! তাতে ক্যামেরা থাকায় সেটি আরও বাড়তি বিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। তরুণদের জীবনের মূল্যবান সময়ের একটা বিশাল অংশ কেড়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। এর সঙ্গে পয়সাও যাচ্ছে। যে তরুণ এক পয়সাও রোজগার করতে পারে না সে মাসে শত শত টাকা ব্যয় করছে ফোনে, ইন্টারনেটে। আবার প্রত্যেকেই প্রায় মোটরসাইকেল চালায়। বাবা না হয় মোটরসাইকেলটা কিনে দিল। কিন্তু তেল কেনার জন্য আবার ওই দলে ভিড়তে হয়। যে দল যত বেশি তেল দেবে সেই দলেই সুড়সুড় করে ভিড়ে যাবে মেরুদ-হীন তারুণ্য।
এভাবে রাজনীতি ক্রমেই মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। অথচ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা দেখতে পাইÑছাত্রজীবন থেকেই কতটা সমাজসচেতন ছিলেন তিনি। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তিনি দ্বিধা করতেন না। কলেজে পড়ার সময় তিনি তাঁর নিজের রুমটি ছেড়ে দিয়েছিলেন অন্য ছাত্রদের থাকার জন্য। এই ত্যাগী মানসিকতার পরিচয় জীবনে তিনি বহুবার বহুভাবে দিয়েছেন। এভাবেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। বর্তমান প্রজন্ম ত্যাগ স্বীকার করতে ততটা প্রস্তুত নয়। আসলে সর্বত্র রাজনীতিকরণের নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে রাজনীতিই হয়ে উঠেছে সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। এ জন্য গ্রামের একজন স্কুলপড়ুয়া ছাত্রও রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর নেতারাও তাকে সানন্দে দলে ভিড়িয়ে নেয় দল ভারি করার জন্য।
আমাদের রাজনীতিই কি সঠিক পথে চলছে। ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ’-এর মতো রাজনীতিও কি তার পথ হারায়নি। নইলে এত রক্ত, এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত একটি দেশ কেন অযথাই রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানিতে লিপ্ত। কেন দেশের কল্যাণ চিন্তার চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে। রাজনীতিকে কেন ব্যবহার করা হয় ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে। বঙ্গবন্ধু তো রাজনীতির জন্য মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই চল্লিশ বছরে আর একটিও উদাহরণ কেন পাওয়া গেল না। কেন আজ অনেক রাজনীতিবিদের মধ্যেই ক্ষমতালিপ্সু মানসিকতা। রাজনীতি থেকে আদর্শবাদ প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। পরমতসহিষ্ণুতা, সমঝোতার রাজনীতি আজ নেই বললেই চলে। এখনও আমাদের রাজনীতি ঘুরপাক খায় কোন্ পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে এই কেন্দ্রেই। রাজনীতিবিদরা এতটাই অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার মধ্যে বাস করেন যে তাঁরা নিজেরাও নিজেদের বিশ্বাস করতে পারেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তো এই অবিশ্বাসেরই ফল। ক্ষমতায় যাওয়া হচ্ছে মানুষের সেবা করার সুযোগ পাওয়া। সেই সুযোগ পেতে এত জোর-জবরদস্তি কেন? মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির প্রচার নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। এক লোক কিছুতেই অহিংস নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করছিল না। তো একদল লোক তাকে নানাভাবে বোঝাল। কিন্তু লোকটি অনড়। শেষে একদল সশস্ত্র লোক তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলল‘বল্্ তুই অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করিস কি-না।’
এটি নিছকই একটি গল্প। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতির অবস্থা আজ এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির মূল লক্ষ্য যদি দেশসেবা হয়; তাহলে সেই সেবক হওয়ার জন্য তো এত কূট-কৌশলের প্রয়োজন পড়ে না। মানুষই তো তাদের সেবক নির্বাচন করবে। এই নিয়মতান্ত্রিকতার পথে চললে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। তাহলে ‘বল্্ আমাদের সেবক নির্বাচন করবি কি-না’Ñজনগণের ঘাড়ে ভোটের বন্দুক ঠেকিয়ে এ ধরনের জোর-জুলুমেরও দরকার হবে না। মানুষজনকেও রাজনীতির কূটকৌশলের যাঁতাকল থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব হবে। সকলের মধ্যে সেই শুভ বুদ্ধির উদয় হোকÑএটাই প্রত্যাশা।

harun_press@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.