আবারও ভারতীয় অনুপ্রবেশ ও বিএসএফের গুলিবর্ষণঃ সরকারকে কঠোর হতে হবে

দু’পক্ষের মধ্যে আর কখনও গুলিবর্ষণ হবে না—এমন যৌথ ঘোষণার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিএসএফ আবারও গুলি চালিয়েছে সিলেট সীমান্তে। গত ১১ মার্চ দিল্লিতে বিডিআর-বিএসএফ শীর্ষ সম্মেলন শেষে প্রদত্ত যৌথ ঘোষণায় সীমান্তবাসীর মনে যে স্বস্তি ফিরে এসেছিল তা ভেঙে গেল ১৪ মার্চ। সেদিন সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর বিএসএফের গুলিবর্ষণে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে।

এর আগে ১৩ মার্চ পাদুয়া সীমান্তে অনুষ্ঠিত দু’পক্ষের পতাকা বৈঠকেও সীমান্তে অনুপ্রবেশ না ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেয় বিএসএফ। কিন্তু একদিন পর তারা শুধু অনুপ্রবেশই ঘটায়নি নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে নিরীহ বাংলাদেশীদের ওপর। গতকালের আমার দেশসহ বিভিন্ন পত্রিকা গুরুত্ব সহকারে ঘটনাটির সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রায় দেড় মাস ধরে সিলেট সীমান্তের এই এলাকায় দফায় দফায় বিএসএফের উস্কানিমূলক অপতত্পরতা চললেও তার সমাধান হচ্ছে না। বিডিআরের প্রতিবাদ ও দু’পক্ষের পতাকা বৈঠকের পরও বিএসএফের গুলিবর্ষণ ও তাদের সমর্থনে ভারতীয় খাসিয়াদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। ২৮ ফেব্রুয়ারি তারা ডিবির বিল ও কেন্দ্রী বিলের প্রায় দেড় কোটি টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যায়। এটা ঠেকাতে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে স্থানীয় অধিবাসীরা। এ এলাকার খাস খতিয়ানভুক্ত ৩০০ একরেরও বেশি জমি-জলাশয় ভারতীয়রা দখল করতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। –লে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশীদের সঙ্গে ভারতীয়দের বিরোধ এখন চরম আকার ধারণ করেছে। ১৪ মার্চ বিএসএফ ও অনুপ্রবেশকারী ভারতীয়দের গুলিতে আহত ২০ জনকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং গুরুতর আহত ২ জনকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে ৭০ বছর বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান এখন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শয্যাশায়ী।
একাত্তরের মিত্রপক্ষের হাতে ৩৮ বছর পর এভাবে গুলিবিদ্ধ হতে হবে সেটা নিশ্চয়ই কখনও ভাবেননি বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান। সেখানকার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর অধিবাসীদের মনেও এমন প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। মার্চে যখন দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে ব্যস্ত তখন এমন ঘটনা ভারতীয়দের সেদিনের ভূমিকা ও পরবর্তী সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ না করে পারে না। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিচ্ছিন্ন ঘটনা মন্তব্যের পরও ঘটনাটি হাল্কা করে দেখার সুযোগ নেই। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের একটি এলাকাতে ভারতীয়দের একই ধরনের অনুপ্রবেশ ও অনুপ্রবেশকারীদের দুর্বৃত্তপনায় বিএসএফের সমর্থনের যে বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাকে পরিকল্পিত না বলে পারা যায় না। জলাশয়সহ খাস খতিয়ানভুক্ত বিশাল এলাকাকে বিরোধপূর্ণ করে তোলার পেছনে এর মালিকানা দাবি করার দুরভিসন্ধি এখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আলোচনার টেবিলে দাবিটিকে প্রতিষ্ঠিত করতেই একের পর এক সংঘাত উস্কে দেয়া হচ্ছে বলে স্থানীয়দের মনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটা অনেকের জানা নেই যে, ১৯৭৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত বিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে উল্লেখিত অপদখলীয় ভূমির ভারতীয় তালিকাতেও সিলেটের কেন্দ্রী বিল বা ডিবির বিলের নাম ছিল না। গত ২ মার্চ বিডিআর মহাপরিচালকের এই এলাকা পরিদর্শন এবং পরবর্তী কালে বিডিআর-বিএসএফ শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণার পরপরই ভারতীয়দের এমন প্রতিক্রিয়া থেকে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ জাগা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
ঘটনা নিয়ে সরকারের ভূমিকাও প্রশ্ন সৃষ্টিকারী। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সরকারি প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। সরকারের দুর্বল ও ভারতমুখী পররাষ্ট্র নীতিকেই সীমান্তে বাংলাদেশবিরোধী সশস্ত্র অপতত্পরতার জন্য দায়ী মনে করা মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের প্রাক্কালে এমন ঘটনা তার প্রতি ভারতীয়দের গুরুত্ববাহী বার্তাও বটে। এসব কিছুর পরও সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পালনে সরকার প্রশংসা করার মত কিছু করেছে বলা যাবে না। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর ভূমিকা স্বাভাবিক এবং জনগণ সেটাই আশা করে। অন্যথায় সিলেট সীমান্তের ঘটনা মহাজোট সরকারের ব্যর্থতার তালিকায় আরেকটি উদাহরণ হিসেবেই বিবেচিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.