উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের মানববন্ধনঃ স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চাই

আওয়ামী মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে সুশাসন ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়ার কথা বলা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকারের অন্যতম স্তর উপজেলা পরিষদ এখনও অকার্যকর থেকে যাওয়া বিস্ময়কর বটে। উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ভাইস চেয়ারম্যানরা সংঘবদ্ধ হয়ে উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে দীর্ঘ এক বছর ধরে দেনদরবার করেও কূল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হয়েছেন।

পূর্বঘোষিত ১০ দফা আদায়ে দু’মাসব্যাপী কর্মসূচি অনুযায়ী ১ মার্চ তারা দেশজুড়ে মানববন্ধন করে দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়েছেন সরকারের প্রতি। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি দেশের ৪৮১টি উপজেলায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে শপথ নিলেও এক বছরের বেশি সময় ধরে তাদের দায়িত্ব ও বেতন-ভাতার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পূর্বতন উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান (দায়িত্ব, কর্তব্য ও আর্থিক সুবিধা) বিধিমালা ২০১০’ শিরোনামে নতুন বিধিমালা জারি করলেও সেটা গ্রহণযোগ্য হয়নি উপজেলা জনপ্রতিনিধিদের কাছে। তারা শুরু থেকেই উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে জাতীয় সংসদ সদস্যদের রাখার ঘোর বিরোধিতা করে আসছেন। এছাড়া নির্বাহী আদেশে উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণের বিধান বাতিল ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের এসিআর লেখার অধিকারও দাবি করেছেন। এসব ছাড়া স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর ও শক্তিশালী হবে না। সরকার ও মন্ত্রণালয়ের কলকাঠি অনুযায়ী তাদের নড়াচড়া করতে হবে, এমন আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন তারা। কিন্তু নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতামতের তোয়াক্কা না করে সরকার একতরফাভাবে উপজেলায় সংসদ সদস্যদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতেই তাদের হাতে থোক বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছে। প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে নিজ নিজ এলাকায় ব্যয় করার উদ্দেশ্যে ১৫ কোটি টাকা করে দেয়ার আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের কথা খুবই পরিষ্কার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা চাহিদা অনুযায়ী এলাকায় উন্নয়নে কাজ করতে না পারলে কখনও সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সংবিধানের স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত ধারাতেও তেমনটাই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব জাতীয় সংসদে আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতীয় বিষয়ে সুষ্ঠু নীতিমালা ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন, বাজেট পাস ও মন্ত্রণালয়গুলোর কাজে নজরদারিতে সচেষ্ট থাকা। বাস্তবে এর ধারেকাছে না গিয়ে তারা পরস্পরের চরিত্রহনন ও অর্থহীন বাদ-প্রতিবাদে সংসদকে উত্তপ্ত করে অকার্যকর রাখতেই অতিউত্সাহী দেখা যাচ্ছে। ফলে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে না সংসদ অধিবেশন। এর পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনের কোনো সুব্যবস্থা না নিয়ে সংসদ সদস্যদের অর্থ বরাদ্দ দেয়ার ফলে তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এক সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এটা গণতন্ত্রের বিদ্যমান দুর্বল ভিত্তিকে একেবারে তছনছ করে দেবে, এমন আলামত ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। এর ফলে জনগণের সামনে জনপ্রতিনিধিরা শুধু হেয়ই হবেন না, এভাবে জনপ্রত্যাশা পূরণের কথা বলা কানাকে হাইকোর্ট দেখানোর শামিল—এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব বুঝেই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে অবিলম্বে স্বশাসিত উপজেলা পরিষদের চেতনা পরিপন্থী সব সিদ্ধান্ত, পরিপত্র ও প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা।
নির্বাচিত সরকারের প্রথম বছরটা দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অকার্যকর অবস্থায় কেটেছে; পরবর্তী বছরগুলো কেমন যাবে, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। কথায় বলে, সকাল দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। মহাজোট সরকারের শুরুর বছরটা আর যাই হোক তৃণমূলের জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের জন্য ভালো ছিল না, সেটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার।

No comments

Powered by Blogger.