শিক্ষা- বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা by তুহিন ওয়াদুদ

একজন সিনিয়র শিক্ষককে বলতে শুনেছি, ‘বেসরকারি একজন শিক্ষককে বাড়িভাড়া দেওয়া হয় মাত্র ১০০ টাকা, যা দিয়ে স্টেশনের একটি পাটি এক মাস ভাড়া পাওয়া যাবে না। একটি মুরগির খোঁয়াড় ভাড়া নিতে হলেও ১০০ টাকায় অসম্ভব। চিকিৎসা-ভাতা মাত্র ১৫০ টাকাকে তিনি বলেন হাস্যকর।


উৎসব-ভাতা মূল বেতনের চার ভাগের এক ভাগ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষকদের উৎসব কি চার ভাগের এক ভাগ?’
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে বেসরকারি স্কুল-কলেজে। এসব স্কুল-কলেজে যাঁরা লেখাপড়া করান, তাঁদের শ্রমের প্রতি সরকারের মূল্যায়ন সম্মানজনক নয়। পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলে শিক্ষকও তাঁর শ্রমে আলো ফলতে দেখে গর্বিত হন। সরকার ভালো ফলাফলকে নিজেদের কৃতিত্বের অংশ মনে করে। অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের আনন্দটুকু তাঁদের জীবনের উজ্জ্বল অংশ হয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষকের এই আনন্দ দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। কারণ, কর্মসংশ্লিষ্ট নানা পারিপার্শ্বিকতা তাঁদের ক্রমাগত হতাশায় আচ্ছন্ন করতে থাকে। শিক্ষকতা বিষয়টি স্বতঃস্ফূর্ত করতে না পারলে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা আনন্দময় করে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েক ধরনের শিক্ষক থাকেন। এক ধরনের শিক্ষক আছেন, যাঁরা বেতন পান এবং জীবনে একটি পদোন্নতি পেয়েছেন; এক ধরনের শিক্ষক আছেন, যাঁরা কোনো দিন পদোন্নতি পাবেন না; আর এক ধরনের শিক্ষক আছেন, যাঁদের আর্থিক সুবিধা দেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে; আর এক ধরনের শিক্ষক আছেন, যাঁরা জানেন না তাঁদের কোনো দিন বেতন আদৌ হবে কি না। যাঁরা বেতন পান এবং জীবনে একটি পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁরা হচ্ছেন বেসরকারি কলেজের সৌভাগ্যবান শিক্ষক, সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন। আর যাঁরা কোনো দিন পদোন্নতি পাবেন না, তাঁরা হলেন স্কুলের শিক্ষক এবং কলেজের অনেকেই। স্কুলশিক্ষকদের পদোন্নতি নেই এবং কলেজের পদোন্নতি খুবই অযৌক্তিক পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজে মোট শিক্ষকের মধ্যে প্রতি সাতজনে দুজন হবেন সহকারী অধ্যাপক। আর যত দিন সেই সহকারী অধ্যাপক অবসরে যাবেন না কিংবা চাকরি থেকে অব্যাহতি নেবেন না, তত দিন ওই কলেজে আর অন্য কেউ পদোন্নতি পাবেন না। এই পদ্ধতিতে যদি কেউ নতুন কলেজে চাকরিতে যোগদান করেন, তাহলে তিনি হয়তো কম বয়সেই সহকারী অধ্যাপক হবেন। পুরোনো কলেজে হয়তো ২৫ বছর ধরে কেউ প্রভাষক আছেন, কিন্তু তাঁর ছাত্র নতুন কলেজে যোগদান করার কারণে সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন। বেসরকারি কলেজে এই অনুপাতের বাইরে থাকা শিক্ষকেরা কোনো দিনই পদোন্নতি পাবেন না। অন্যদিকে স্কুলশিক্ষকেরা সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করে সারা জীবন শুধু সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি করে অবসরে যান। একইভাবে বেসরকারি কলেজের গ্রন্থাগারিক এবং প্রদর্শকেরাও কোনো পদোন্নতি পান না।
ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজগুলোতে তৃতীয় পদে (থার্ড পোস্ট) আরেক ধরনের শিক্ষক আছেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে কোনো কোনো বিভাগে দুজনের অধিক আরও একজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিধান ছিল। পরবর্তী সময়ে শর্ত ছিল, এসব পদের বেতন বহন করবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কয়েক বছর আগেও এই পদগুলোর অনেকটিই সরকার এমপিওভুক্ত করেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিয়োগ পাওয়া এবং পূর্ববর্তী এমপিও না হওয়া তৃতীয় পদে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের আর সরকার এমপিওভুক্ত করেনি। বেসরকারি পর্যায়ের কলেজগুলোর আয়ের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৃতীয় পদে থাকা শিক্ষকদের বেতন-ভাতা তারা বহন করতে পারে না। ফলে বছরের পর বছর বিনা বেতনে তাঁরা শ্রম বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন; যদি কোনো দিন সরকারের অনুগ্রহে অনুদান পান, এই ভরসায়।
বর্তমানে সরকার চেষ্টা করছে দেশের সব নাগরিককে সম্মান শ্রেণীতে পাঠদান করাবে এবং যতখানি সম্ভব বিনা অর্থব্যয়ে! এতে শিক্ষার আলোয় সম্মানিত না হলেও তাঁরা যেন সনদধারী সম্মানযোগ্য হন, সেই তৎপরতা চলছে। এরই অংশ হিসেবে ইউনিয়ন-উপজেলা পর্যায়ের বেসরকারি কলেজগুলোতে পর্যন্ত সম্মান কোর্স চালু করা হচ্ছে। কিন্তু এই কোর্স পড়ানোর জন্য সরকার শিক্ষকদের কোনো বেতন-ভাতা দেবে না। বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে একটি অদ্ভুত পদ্ধতি চালু হয়েছে। সেটি হচ্ছে, চাকরিতে শূন্যপদে যেদিনই যোগদান করুক না কেন, বেতন-ভাতা পাবেন যেদিন তাঁর চাকরি এমপিও হবে, সেদিন থেকে। এটা কিন্তু হওয়ার কথা নয়। এক বছর আগে যদি কেউ চাকরিতে যোগদান করেন এবং তাঁর শ্রম যদি সরকার নিয়ে থাকে, তাহলে কোন নীতিতে তাঁর পারিশ্রমিক দেওয়া হবে না, এটার কোনো উত্তর মেলে না।
বেসরকারি শিক্ষকদের যাঁরা বেতন পান না, তাঁরা তাঁদের বঞ্চিত হওয়ার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে আন্দোলন করছেন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউই বেতন-ভাতা কোনো কিছুই পান না, এ রকম অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেই প্রতিষ্ঠান কোনো অবৈধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। সেগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা রীতিমতো লেখাপড়া করে উচ্চতর শিক্ষাও গ্রহণ করছে। সরকার সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদন দিয়েছে, অথচ বেতন দেয়নি। অনুমোদন দিয়েছে প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকারীদের প্রতি অনুকম্পা দেখিয়ে নয়, দেশের নাগরিককে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেই মর্মে। যদি প্রতিষ্ঠানগুলো জনস্বার্থে হয়ে থাকে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বছরের পর বছর না দেওয়া অমানবিক। তাহলে রাষ্ট্র কি অনুমোদন আছেঅথচ অনুদান নেই এমন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি, এমপিও না হওয়া তৃতীয় পদধারীদের প্রতি, এমপিও না হওয়া পর্যন্ত শ্রমের মূল্য না পাওয়া শিক্ষকদের প্রতি অমানবিক আচরণ করছে? তাহলে অনুমোদন আছে, অনুদান নেই এমন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন রাষ্ট্রের অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে? এই যদি সত্য হয়, তবে রাষ্ট্র যত তাড়াতাড়ি শিক্ষক-কর্মচারীদের শ্রমের মূল্যায়ন করবে, তত তাড়াতাড়ি একটি অমানবিক আচরণ থেকে অব্যাহতি পাবে।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.