হাইকোর্টের রায় ॥ স্পীকারের রুলিং অকার্যকর আইনগত ভিত্তিহীন by বিকাশ দত্ত

সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন ও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বানের ১৮ জুন দেয়া স্পীকারের রুলিংকে অকার্যকর ও আইনইগত ভিত্তিহীন বলে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।


বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ ২৪ জুলাই স্পীকারের রুলিংয়ের বৈধতা নিয়ে দায়ের করা রিট আবেদন কিছু অভিমতসহ নিষ্পত্তি করে রায় দেয়। সোমবার হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ অভিমত ও নির্দেশনাসহ ওই রায় প্রকাশ করে। ৩৮ পৃষ্ঠার এই রাযে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।
সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাবৃন্দ বলেছেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ এই রায় ঘোষণার ফলে সকল বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অর্গান নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ যার যার ক্ষেত্র আলাদা। এর মধ্যে নির্বাহী বিভাগ যদি কিছু অমান্য করে আইনের পরিপন্থী কিছু করে তা হলে একমাত্র হস্তক্ষেপ করার অধিকার রয়েছে বিচার বিভাগের। জাতীয় সংসদ সার্বভৗম। কিন্তু আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সাংবিধানিক বিধিবিধান পরীক্ষা করার এখতিয়ার কেবল মাত্র সুপ্রীমকোর্টের। কোন আইন সংবিধানের মূল বিষয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। এটাই সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের বিধান।
এর আগে ১৮ জুলাই হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী একেএম সফিউদ্দিন বাদী হয়ে স্পীকারের রুলিংয়ের বিরুদ্ধে আবেদন দায়ের করেন। উল্লেখ্য, ১৮ জুলাই বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ রিটের ওপর শুনানিতে বিব্রতবোধ করে। পরে আবার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের বেঞ্চে আবেদন করা হয়। প্রতিবেদনে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মন্তব্যের বিরুদ্ধে স্পীকারের রুলিং কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারির এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের রুলিং বা আদেশ জারি করা না হয় সে নির্দেশনা চাওয়া হয়। পরে ২৪ জুলাই শুনানি শেষে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের যুগ্ম বেঞ্চ আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেন। আদালত বলে, আবেদন নিষ্পত্তি করলেও কোন রুল দেয় হবে না, পর্যবেক্ষণ দেয়া হবে। সোমবার সেই পর্যবেক্ষণ দিল আদালত। সোমবার ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায় পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত বিষয় তুলে ধরে এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের ব্রিফিং প্রদান করেন।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেনের যুগ্ম বেঞ্চ আবেদনটি নিষ্পত্তি করার ৩৫ দিনের মাথায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করেন। হাইকোর্ট বিভাগ তার পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণে বলেছেন, বিচারাধীন মামলায় বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মন্তব্যের বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পীকারের রুলিং আইনত অবৈধ, কাজেই অকার্যকর। বিভাগে আগে নিষ্পত্তিকৃত আবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রুলটি অবৈধ হবার ফলে সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংসদের রুলিংয়ের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিকে স্পীকারের ‘অনুরোধ’-এরও কোন কার্যকারিতা নেই। সংবিধানের বিধান, সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি, বিরোধীয় ঘটনা, স্পীকারের রুলিং ও উচ্চ আদালতের আইনের ব্যাখ্যার আলোকে আদালত রায়ের অভিমতে বলেছে, স্পীকারের তর্কিত অভিমত যে, একজন বিচারক সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন এবং এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে প্রধান বিচারপতি ভেবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এর কোন আইনগত কোন ভিত্তি নেই এবং আইনের দৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন। স্পীকারের ওই অভিমতের কোন আইনগত কার্যকারিতা নেই।
আদালত বলেছে, স্পীকারের অভিমত, ‘একই সঙ্গে বলব আদালতের এ ধরনের আচরণের কি করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন—-।’ এটি সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। স্পীকারের রুলিং সংবিধান ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। হাইকোর্ট তার রায়ে আরও বলেছে, রাষ্ট্রের কোন অঙ্গ যাতে সংবিধানে দেয়া তার ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন না করে তা দেখার দায়িত্ব সুপ্রীমকোর্টের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। বিশেষ অধিকারের সীমা সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। এই ব্যাখ্যার ক্ষমতা একমাত্র সুপ্রীমকোর্টের এখতিয়ারাধীন। সংসদ তার এই বিশেষ অধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে না।
আদালত বলেছে, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়েছে। জনগণ সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সংবিধানের সীমার মধ্যে থেকে সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে আদালত অভিমতে বলেছে, বিচারপতি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ৭৮ (১) অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করেছেন এটি বলা যায় কি? সংবিধানের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোন মামলা দায়ের করা হলে সে ক্ষেত্রে সেই মামলাটি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদে বাধা।
আদালত বলেছে, মাননীয় স্পীকারের রুলিংয়ে এমন কিছু দেখা যায় না যে, মাননীয় বিচারক সংসদের কোন কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে তার আদালতে বা কোন আদালতে কোন প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করে কোন মামলা দায়ের বা বিচারাধীন থাকার বিষয়টি স্পীকার তার রুলিংয়ে বলেননি। সুতরাং সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের কোন লঙ্ঘন হয়নি। আদালত রায়ে আরও বলে, সড়ক ভবনের মামলায় সংসদের কার্যধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
আদালত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে অভিমতে আরও বলেছে, সংবিধানের ৯৬ (৫) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বা অন্য কোন সূত্র থেকে এই তথ্য পেয়ে যে একজন বিচারক শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে এবং এর তদন্ত ফল জানানোর জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। কাউন্সিল যদি তদন্তে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে ওই বিচারক দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়েছেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন তাহলে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে তার পদ থেকে অপসারণ করবেন।
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি পর্যালোচনা করে আদালত রায়ের অভিমতে বলেন, সুপ্রীমকোর্টের ও অন্যান্য বিচারকগণ সংসদের সমালোচনা থেকে মুক্ত। বিচারকদের বিষয়ে সংসদের অপ্রত্যাশিত বিষয়ে আলোচনা করা যাবে না। বিচারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে একজন বিচারকের আচরণ সংসদের বিবেচনাধীন বিষয় হতে পারে না। সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধির বিধান অবজ্ঞা করে এ ধরণের আলোচনা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষণœœ করতে পারে।
আদালত তার পর্যবেক্ষনে আরও বলেছে, আমাদের আইন প্রণেতাদের নিঃসন্দেহে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এই ক্ষমতা সংবিধানে দেয়া এখতিয়ারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ দ্বারা সুরক্ষিত। ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ বিষয়ে ব্যাখ্যাকারীও বিচার বিভাগ। আদালত বলেছে, বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে আইন প্রণেতাদের স্বাধীনতা। সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকরতার জন্য এই স্বাধীনতা প্রয়োজন। বিচারকদ্বয় তাদের রায়ে আরও বলেন, রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ তাদের কর্তৃত্ব, এখতিয়ার ও ক্ষমতা সংবিধান থেকে প্রাপ্ত। সাংবিধানিক বিষয়ে রাষ্ট্রের বিচার অঙ্গ চূড়ান্ত বিচারক এবং এ বিষয়ে এর কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার সংবিধানের মূল স্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধান পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু অমান্য করা যায় না।
সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ ভাগের উল্লেখ করে আদালত বলেছে, আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দুটি অঙ্গ সংবিধানের সৃষ্টি। আদালত রায়ে বলেছে, আইনসভা ও বিচার বিভাগ এই দু’টি অঙ্গসহ নির্বাহী বিভাগ বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করা উচিত। এতে করে দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উন্নয়ন, বিকাশ ও স্থিতিশীল হবে। আদালত রায়ে বলেন, আমরা ক্ষমতা স্বাতন্ত্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেছি। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের, নির্বাহী ক্ষমতা প্রধাণমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার এবং বিচারিক ক্ষমতা আদালতের। তিনটি অঙ্গের প্রতিটি অন্য অঙ্গের বিষয়ে বিধান লক্ষ্য রেখে প্রত্যেকের স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে হবে। স্বাভাবিক কার্যপরিচালনার স্বার্থে একটি অঙ্গকে অপর অঙ্গ থেকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে না। সংবিধান হচ্ছে এই তিনটি অঙ্গের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রতিটি অঙ্গ তার কাজের ক্ষেত্রে নিজস্ব জায়গায় স্বাধীন। যদি কোন অঙ্গ তার ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে তাহলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার বিচারিক বিবেচনার ক্ষমতা আদালতের ওপর ন্যস্ত করেছে। আইন প্রণেতাদের বিচারিক ক্ষমতা গ্রহণ অসাংবিধানিক।
সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে আদালত বলে, সংবিধানের বিধানের আলোকে প্রধান ও বিচারকগণ বিচারিক ক্ষেত্রে স্বাধীন। সংসদের ক্ষমতা, এখতিয়ার ও বিশেষ অধিকার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা সুপ্রীমকোর্টের রয়েছে কিনা এ বিষয়ে ভারতের উচ্চ আদালতের রাজা রামপাল বনাম অনারাবল স্পীকার, লোকসভা মামলার রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে হাইকোর্ট তার অভিমতে বলেছে, যে কার্যধারা চরম বেআইনী ও অসাংবিধানিক তা বিচারিক নিরীক্ষার বাইরে নয়। সিদ্ধান্ত, আদেশ, অভিমত, উপসংহার সীমিত ক্ষেত্রে বিচারিক বিবেচনার আওতাধীন। সুপ্রীমকোর্ট তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক কার্য বাতিল করতে দ্বিধাবোধ করবে না।
ওই মামলায় রায়ের বরাত দিয়ে আদালত আরও বলেন, রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গের মতো সংসদও সংবিধানের বিধানের অধীন এবং এর বিধানের আলোকে দায়িত্ব পালন করবে। সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার বিপরীত কোন কাজ বা কার্যক্রম বাতিল হবে। কিন্তু সংসদের কার্যপ্রণালী বিষয়ে বিচারিক বিবেচনা সীমিত। আদালত লর্ড ডেনিংয়ের হোয়াট নেস্ট ইন দি ল গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ের অভিমতে বলেছে, ক্ষমতা, অধিকার ও দায়মুক্তির ক্ষেত্রে সংসদ যা করেছে এবং করতে পারে তার প্রতি আমাদের সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু আমাদের আইনের কাঠামোতে বেঁধে দিতে হবে যে, এই ক্ষমতা যেন অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ না হয়।
সংসদের রেওয়াজ ও পদ্ধতি বিষয়ে পুরোধা কাউলের প্রাকটিস এ্যাপন্ড প্রসিডিউর অব পার্লামেন্ট গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে হাইকোর্ট অভিমতে বলেছে, দেশ ও এর জনগণের শাসনের ক্ষেত্রে সকল বিষয়ে আলোচনা ও বক্তব্য রাখার চূড়ান্ত অধিকার আইন প্রণেতা ও সংদস্যদের রয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদে বাক স্বাধীনতা সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য বিষয়। আদালত বলেছে, কিন্তু এই স্বাধীনতার ওপর স্বআরোপিত কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, সংসদের ফ্লোরে বিচারাধীন কোন বিষয়ে আলোচনা পরিহার করা উচিত যাতে করে বিচারের বাইরের কোন বিষয়ে আদালতের কার্যধারা প্রভাবিত না হয়। এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি যে, বিচারাধীন বিষয় সবসময় আলোচনার বাইরে।
ভারতের উচ্চ আদালতের বচ্চন সিং বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় বিচারপতি ভগবতীর রায়ের বরাত দিয়ে আদালত বলেছে, একটি গণতান্ত্রিক সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে, কিন্তু এর ক্ষমতা সীমাহীন হবে না। নির্বাহী ও আইনসভার সীমাহীন ক্ষমতা থেকে জনগণকে রক্ষা করতে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকা উচিত। আইনজ্ঞ আলেকজান্ডার হেমিলটনের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত রায়ে বলেছে, বিচার করার ক্ষমতা যদি আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা না হয় তাহলে কোন স্বাধীনতা থাকবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ে হযরত ওমরের (রা) কার্যকলাপের উদাহরণ টেনে হাইকোর্ট বলে, হযরত ওমর কার্যত প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করেছিলেন। তিনি আবু দারদাকে (রা) মদিনা, আবু মুসা আল আশারী (রা) কুফা এবং সুরাইয়াকে (রা) বসরার বিচারক নিয়োগ করে পবিত্র কোরান ও সুন্নাহর আলোকে সকলকে আইনের চোখে সমান বিবেচনা করে স্বাধীনভাবে বিচার করার জন্য ফরমান জারি করেছিলেন।
আদালত রায়ে বলে, রিট আবেদনটি দায়ের করার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা। হাইকোর্ট পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ফারুক আহমেদ লেঘারী বনাম ফেডারেশন অব পাকিস্তান মামলার বরাত দিয়ে বলেন, সংবিধান একটি জীবিত বৃক্ষের মতো, দেশ ও জনগণের উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়ের বিবর্তনে এটি বেড়ে উঠে ও ফুলে ভরে উঠে। আইনবিদ টমাসের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত অভিমতে বলেন, আইন আদালতের দায়িত্ব হলো কি সঠিক তা খুঁজে বের করে নির্দ্বিধায় তা বলা। চার্লস ডিকেন্সেরে উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত বলেন, আদালত দায়িত্ব হলো আইন কি তা বলা, কি হওয়া উচিত তা নয়। কোকের অভিমত হচ্ছে, ন্যায়বিচারের মাতা -হচ্ছে সত্য এবং যুক্তি হচ্চে আইনের জীবন। মাযদার হোসেন মামলায় সুপ্রীমকোর্টের রায়ের বরাত দিয়ে আদালত বলে, সংবিধানের ৯৪ (৪) ও ১১৬ক অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে মূল স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং একে ধ্বংস করা যায় না।-
আদালত বলে, সংবিধানের ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদ এবং কার্যপ্রণালী বিধি সংসদ সদস্যদের বাক স্বাধীনতার ওপর সীমা আরোপ করেছে। আমাদের দেশে আইন প্রণেতারা সংবিধান ও সাংবাধানিক আদালতের দ্বারা বাধ্য এবং সাংবিধানিক আদালত সংসদের প্রণীত আইনকে অসাংবিধানিক হলে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। গত ১৪ মে সড়ক ভবন আদালত অবমাননা মামলায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ৫ জুনের মধ্যে ব্লক সি-এর বাকি অংশ ও ব্লক এর দু’টি কক্ষ সুপ্রীমকোর্টকে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেয়।
এরপর গত ২৯ মে সংসদে এই বিচারাধীন বিষয়ে সদস্যরা আলোচনা করেন। স্পীকারও এই আলোচনায় কিছু মন্তব্য করেন। এই নিয়ে গত ৫ জুন হাইকোর্টের ওই দ্বৈত বেঞ্চ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে সংসদ সদস্যরা যাতে বিচারাধীন বিষয়ে বক্তব্য না রাখেন সে বিষয়ে স্পীকারের প্রতি আশা প্রকাশ করে এক আদেশ দেয়। এরপর ১৮ জুন স্পীকার তাঁর রুলিং দেন। রুলিংয়ের শেষ অংশে তিনি বলেন, ২৯ মে ২০১২ তারিখে সংসদে আমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ৫ জুন ২০১২ তারিখে হাইকোর্টের একজন মামনীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন তা কোন বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। তিনি রুলিংয়ে আরও বলেন, একই সঙ্গে বলব আদালতের এ ধরনের আচরণে কি করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন. তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। রুলিংয়ের এই দ’ুটি অংশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সাবেক বিচারপতি একেএম শফিউদ্দিন হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন।
আবেদনকারী পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আখতার ইমাম, সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির সিনিযর ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী কেএম সাইফুদ্দিন আহম্মেদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়।

No comments

Powered by Blogger.