বুঝেছিলাম কবিতা লেখাই আমার কাজ

আবুল হোসেন বললেনবাঙালি যে ক'জন তরুণ মুসলমান কবির আবির্ভা তে তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত। এরপর সময়ের ব্যবধানে তাঁর কবিতা এক জায়গায় থেমে থাকেনি, নিজেকে ক্রমাগত বদলে নেওয়ার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন নিরন্তর। ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। এ বছর তিনি নব্বইতে পা দিলেন।


তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্যামল চন্দ্র নাথ ষ প্রায় সত্তর বছর ধরে কবিতার সঙ্গে আপনার অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ। কবিতা লেখার শুরুর দিককার কিছু কথা বলুন।
ষষ আমার স্মৃতিকথায় এসব বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি। তবুও এই মুহূর্তে প্রথম জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা মনে পড়ছে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার সময় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় অনেকগুলো বই উপহার পেয়েছিলাম। একটা বাদে সব বই ছিল দেখতে চমৎকার, সুন্দর ঝকঝকে ছাপা। একটা বই শুধু চোখে ধরেনি। প্রথমেই রঙচঙা ছবিওয়ালা বইগুলো পড়ে ফেললাম। এরপর সেই সাদামাটা বইটা হাতে নিলাম। পাতলা হলদে মলাটের ওপরের দিকে বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা 'সোনার তরী'। নিচে লেখকের নাম শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেখি গল্প বা জীবজন্তুর কথা কিংবা অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী নয়, গদ্যও নয়, বইটা পদ্যের। পড়ে ফেললাম প্রথম কবিতার প্রথম লাইন_ 'গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা'। পড়তেই মনের মধ্যে আলোড়ন শুরু হলো, বুকের মধ্যে আবেগ এমন ঠেলে ঠেলে উঠছিল, আমি প্রায় এক নিঃশ্বাসে সব কবিতা পড়ে ফেললাম। সেই বয়সে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। ছবিটা দেখেছিলাম ঠিকই। মেঘ ডাকছে, বৃষ্টি পড়ছে, মাঝি নৌকা বাইছে। কিন্তু ছবিটির জন্য নয়। আমি ভেসে গিয়েছিলাম শব্দের ঝঙ্কারে। কবিতার শব্দগুলো আমাকে কোথায় যেন নিয়ে গেল। এরপর আমিও লিখতে লাগলাম। সেই থেকে খাতার পর খাতা হিজিবিজি লিখে ফেলি, যদি কোনো দিন আমারও হয়। কবিতা লেখার সেই শুরু।
ষ পরবর্তীকালে আপনার কবিতার নির্মাণ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাল। কবিতার নির্মাণ কীভাবে ঘটে আপনার হাতে?
ষষ একেবারে ছোটবেলায় শুধু প্রেরণার তাড়নায় কবিতা লিখতাম। পরে সময়ের পালাবদলের সঙ্গে অনেক কিছুই পাল্টাল আমার ভেতর। অনেক ভেবে, অনেক খেটে আমি লিখতে লাগলাম। আমি মূলত বাক্যকে ভেঙে কবিতায় রূপ দিতে ভালোবাসি।
ষ আর কবিতার পরিবর্তন বিষয়ে কী বলবেন?
ষষ ১৯৪০ পরবর্তী সময়ের পর আমি যে কবিতা আমি লিখেছি ও আমার সমসাময়িক কবিরা যে কবিতা লিখেছেন এরপর তেমন পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করিনি। শুধু গুণগত নয়, ভাষা বা আঙ্গিকের দিক থেকেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে যারা লিখছেন তারা এখন গদ্য কবিতা লিখছেন। তবে এটা মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথই প্রথম কবিতার ধারায় পরিবর্তন আনেন। রবীন্দ্রনাথ থেকেই প্রথম আধুনিক কবিতা অন্যপথে গেছে।
ষ কবিতায় আবেগ ও কল্পনা, এ দুটি বিষয় কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
ষষ আবেগ ও কল্পনা কবিতার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। আমার উদ্দিষ্ট অবশ্য অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, স্মৃতি। কল্পনার সঙ্গে আমি মননের মাখামাখি দেখতে চাই। যদিও আমি বর্তমান এবং বাস্তব নিয়েই নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসি। বিশেষ করে বাস্তবের সঙ্গে আদর্শের সংঘাত আমার বিবেককে অবিরাম উসকায়।
ষ যদি জানতে চাই আপনি কেন কবিতাকে লেখার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন, তখন কী বলবেন?
ষষ কবি হবো ভেবে তো আর কবিতা লিখতে যাইনি। ঘটনাক্রমে একদিন একটা কবিতা লিখে ফেলি, আগেই বলেছি। লিখতে খুব ভালো লাগল। সেই থেকেই আমি লিখতে শুরু করলাম। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেককে অনেক সময় নানা কাজ করতে হয়, সেটা হতে পারে জীবনধারণের জন্য বা কারও চাপে। কখনও সমাজের চাপে পড়ে করতে হয়। সে তখন আনন্দ পায় না। তার সেরা কাজটা সে করতে পারে না। আমি বুঝেছিলাম কবিতা লেখাই আমার কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে কবিতা লিখে পেট ভরলেও মন ভরে না। তাই আমি লিখেই খুশি। আমাকে কে কী বলল বা বলল না তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমাকে কেউ কবি বলে সম্বোধন করলে অথবা পরিচয় করিয়ে দিলে আমি উল্লসিত হই না, আপত্তিও করি না।
ষ আপনার লেখালেখির অনুপ্রেরণা কারা? কাদের লেখায় আপনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
ষষ আমি মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হই। তিনি আমার প্রিয় কবি। তা ছাড়া ইংরেজ কবি ডবি্লউ বি ইয়েটসের কথাও আমি বলব। আর আমাদের এখানে আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রভাব খুব বেশি আমার ওপর। তাঁর মেধা ও ব্যক্তিত্ব আমার খুব ভালো লাগত। এ ছাড়া সৈয়দ মুজতবা আলী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখের সানি্নধ্যও পেয়েছি।
ষ আপনার সমকালীন কবিদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
ষষ আমি, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব_ আমরা সবাই একসঙ্গে লিখতাম কলকাতায়। ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব আর আমাকে তখন ত্রয়ী বলা হতো কলকাতায়। এ ছাড়া আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে। তাঁর বাসায় অনেক আড্ডা দিয়েছি। সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে কথা হতো তাঁর সঙ্গে।
ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসুসহ বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি ও লেখকের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল। তাঁদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ বা ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে কিছু যদি বলতেন?
ষষ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় শান্তিনিকেতনে ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে। পরে কথা হয় ১৯৪০ সালে। আমি প্রেসিডেন্সি কলেজের রবীন্দ্র পরিষদেও সম্পাদক ছিলাম। তখন তিনি জীবিত ছিলেন। আর ১৯৩৯-৪০ সালে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা হয়। এ সময় প্রায় তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। তবে তাঁর বাড়িতে নয়; গ্রামোফোন কোম্পানির স্টুডিওতে, রিহার্সাল রুমে। নজরুলকে যেভাবে তাঁর কবিতায়, তাঁর সৃষ্টির মাঝে উজ্জ্বলভাবে পেয়েছি; ব্যক্তিগতভাবে আলাপের সময় তাঁর মধ্যে সেই দ্যুতি ছিল না। তাঁর স্ত্রী অসুস্থ, সংসারেও অভাব। কাজী নজরুল ইসলাম কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে অসাধারণ। কবির চেয়ে সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি অনেক বড় ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৬ সালে বরিশাল থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে এলেন, তখন আমি তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে গিয়েছি। তিনি খুব কম কথা বলতেন। শুনতেন বেশি। তেমন সামাজিক ছিলেন না এই মানুষটি। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক অসুখী ছিলেন বলেই আমার মনে হয়েছিল। এ ছাড়া বুদ্ধদেব বসুসহ অন্য কবিদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা ছিল।
ষ বাংলা সাহিত্যে কবিদের মধ্যে আপনি কাকে এগিয়ে রাখবেন?
ষষ রবীন্দ্রনাথ। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথই। ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও তাঁর কোনো তুলনা চলে না। আমি জীবনে যত মানুষ দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অসাধারণ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তাঁর চেয়ে বড় কাউকে দেখিনি, ভাবিওনি।
ষ আপনার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ থেকে যদি সেরা গ্রন্থটি বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে কোন কাব্যগ্রন্থটি বেছে নেবেন?
ষষ এটা বলা মুশকিল, প্রতিটি বই অন্য বইয়ের চেয়ে ভিন্ন। এই ভিন্নতা নানা কারণে হয়েছে। তবে আমি মনে করি না ভাষার দিক থেকে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে আমার কাব্যের। এই দিক থেকে আমি প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নববসন্ত'কেই বেছে নেব বা অন্য সব বই থেকে এগিয়ে রাখব।
ষ আপনার সমসাময়িকদের মধ্যে আপনি কাকে এগিয়ে রাখবেন কিংবা আপনার প্রিয় কবি কে?
ষষ ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীবরা তো আছেনই। এ ছাড়া চলি্লশের কবিদের মধ্য থেকে যাঁদের নাম বললাম একটু আগে তাঁরাও আমার প্রিয়। আমি সত্তর বছর ধরে কবিতা লিখছি। অনেকের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা আর যোগাযোগ হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এসে এর পরে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ_ এঁরাও লিখেছেন। তাঁদের লেখাও ভালো_ কিন্তু আমি কারও চেয়ে পিছিয়ে আছি বলে আমার কখনও মনে হয়নি। তিরিশ-পরবর্তী কবিদের মধ্যে নতুন কাউকে দেখিনি। চলি্লশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিতা মানের দিক দিয়ে তিরিশের কবিতার চেয়ে পিছিয়ে আছে বলে মনে করি।
ষ আপনার নিজের লেখা কোন কবিতা আপনার প্রিয়?
ষষ কোনো নির্দিষ্ট কবিতা নেই। তবে প্রিয় কবিতা অনেকগুলো। আমি তো কবিতা নিয়ে অবিরাম কাজ করেছি। আমার অনেক কবিতাই অনেকের কাছে প্রিয়। কিন্তু সেভাবে আমি কোনো একটা কবিতাকে সেরা বা প্রিয় বলতে পারব না।
ষ আর জীবনের সেরা মুহূর্ত?
ষষ জীবনের সেরা মুহূর্ত সম্পর্কে আমি সেভাবে ভাবিনি, বলতেও পারব না। তবে আমার মনে হয় যে, আমি যখন স্মৃতিকথা লিখছি, সেই দিনগুলো আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত। কারণ অনেক কিছু আবার মনে পড়ে গেছে।
ষ আপনার জীবনের কোনো অপূর্ণতার কথা যদি বলতেন।
ষষ আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই। আমার জীবন মোটামুটি খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটেছে। কোনো অভাব-অনটনে আমাকে পড়তে হয়নি। আমি যা পেয়েছি দেশের কাছ থেকে এবং সমসাময়িক লেখকদের কাছ থেকে, তাতে আমি সন্তুষ্ট। এটা মনে হতো যে, যা লিখছি এর চেয়ে ভালো লেখা যায় না! আমি সব সময়ই আরও ভালো লেখার চেষ্টা করেছি।
ষ আপনার জীবনের কোনো কষ্টের মুহূর্ত?
ষষ আগেই বলেছি, আমার জীবন খুব স্বাচ্ছন্দ্যে কেটেছে। তবে আমার মায়ের মৃত্যু, বাবার মৃত্যু, আমার স্ত্রীর মৃত্যুতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। তাদের মৃত্যুর শোকে আমি অনেকদিন ভুগেছি।
ষ মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ষষ মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে আমি বিশ্বাস করি। স্রষ্টাও আছেন। স্রষ্টা যদি না-ই থাকেন তবে এত কিছু চলছে কীভাবে? তবে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে আমার মনে হয়_ কীভাবে আমরা পুনরুত্থিত হবো, তা আমরা কেউই জানি না।
ষ মৃত্যুর পর আপনার এপিটাফে কী লেখা থাকলে আপনি খুশি হবেন?
ষষ মৃত্যুর পর কী হবে আমি এখন আর চিন্তা করি না। এপিটাফে কী লেখা থাকবে সেটা নিয়েও ভাবি না। পাঠকরা যদি আমার লেখা পড়ে তাহলে আমি খুশি হবো।
ষ এই সময়ে তরুণ যারা লিখছেন তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
ষষ আমি কাউকে কোনো উপদেশ দিতে চাই না। কিন্তু আমি খুশি হবো যদি তরুণ কবিরা আমরা যা লিখেছি তার থেকে ভিন্ন কিছু, নতুন কিছু লিখতে পারে তাহলে সাহিত্য উপকৃত হবে। হ

No comments

Powered by Blogger.