নজরুল মূল্যায়ন :কয়েকটি প্রসঙ্গ by রফিকুল ইসলাম

বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত তথা সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মৌলিক সৃজনশীল প্রতিভা। বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজজীবনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সময়ের একজন কিংবদন্তি নায়ক।


তাঁর বাল্য ও সৈনিক জীবন শেষে বিশের দশকে অবিভক্ত বাংলার কলকাতাকেন্দ্রিক সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিজকে নিশ্চিতরূপে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছিলেন নিজের সৃজনশীল প্রতিভার জাদুকাঠির স্পর্শে। এমন এক প্রতিভার মূল্যায়ন সমকালীন সমাজে আবেগ, উচ্ছ্বাস এবং হিংসা-বিদ্বেষের কারণে অতি ভক্তি বা নিন্দায় রূপান্তরিত হতে পারে, সে কারণে সমকালীন প্রতিক্রিয়া বস্তুনিষ্ঠ নাও হতে পারে। তবে বিশ শতকের প্রথমার্ধে অবিভক্ত বাংলার এই বর্ণাঢ্য চরিত্রের মূল্যায়ন একুশ শতকে এসে তা বিবেচনা করা যেতে পারে। একজন কবি বা শিল্পীর মূল্যায়ন তিনভাবে হতে পারে, তিনি নিজেকে কীভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁকে তাঁর সতীর্থ সাহিত্য বা সমালোচকগণ কীভাবে পর্যালোচনা করেছেন, পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকগণ তাঁর সম্পর্কে কী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন? নজরুলের আত্মসমীক্ষার পরিচয় 'বিদ্রোহী' বা 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে' বা 'আমার কৈফিয়ৎ' প্রভৃতি কবিতায় উন্মোচনের পূর্বে করাচি সেনানিবাসে রচিত এবং কলকাতার 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল-মে থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সাত কিস্তিতে প্রকাশিত 'বাঁধনহারা' পত্র-উপন্যাসে পাওয়া যায়। 'বাঁধনহারা'র ছয় নম্বর পত্রে করাচি সেনানিবাস থেকে 'স্বেচ্ছাচারী নুরুল হুদা' লিখেছেন, 'আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনা_ এই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্ছে, যা হবে দুর্ভেদ্য, মৃত্যুঞ্জয়, অভিনাশী। আমার এই পথ শাশ্বত সত্যের পথ, বিশ্বমানবের জনম জনম ধরে চাওয়া, পথ আমি আমার আমিত্বকে এ পথ থেকে মুখ ফেরাতে দেব না।'
নজরুলের আমিত্ববোধের চরম অভিব্যক্তি 'বিদ্রোহী' কবিতা, যেখানে একশ' একচলি্লশ পঙ্ক্তির কবিতায় প্রায় সমসংখ্যকবার 'আমি' সর্বনামটি ব্যবহৃত এবং কবির ব্যক্তিসত্তা ও বক্তিস্বাতন্ত্র্যের আর প্রবল আত্মপ্রত্যয়ের কথা ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, নজরুলের বিদ্রোহের আভাস ছিল 'বাঁধনহারা'তেই। বাঁধনহারার আট নম্বর পত্রে যে 'বিদ্রোহী'র পরিচয় পাওয়া যায় তা নজরুলের বিদ্রোহী সত্তারই পরিচয়। 'তা ছাড়া বিদ্রোহী হওয়াও তো একটা মস্ত শক্তির কথা লক্ষ লক্ষ লোক যে জিনিসটাকে সত্য বলে ধরে রেখে দিয়েছে, চিরদিন তারা যে পথ ধরে চলেছে, তাকে মিথ্যা বলে ভুল বলে তাদের মুখের সামনে বুক ফুলিয়ে যে দাঁড়াতে পারে তার সত্য নিশ্চয়ই এই গতানুগতিক পথের পথিকদের চেয়ে বড়। এই বিদ্রোহীর মনে এমন কোনো শক্তি মাথা তুলে প্রদীপ্ত চাওয়া চাইছে, যার সংকেতে সে যুগ-যুগান্তরের সমাজ, ধর্ম, শৃঙ্খলা সব কিছুকে গা ধাক্কা দিয়ে নিজের জন্ম আলাদা পথ তৈরি করে নিচ্ছে। যে মরণকে, ধ্বংসকে পরোয়া না করে না চলার পথ দিয়ে চলে, কত বড় দুর্জয় সাহস তার? আর সত্যের শক্তি অন্তরে না থাকলে তো সাহস আসে না। ... তা ছাড়া প্রত্যেকের আত্মারও তো একটা স্বতন্ত্র গতি আছে। আর সকলের মতো একজন গড্ডলিকা প্রবাহে যদি না চলে তাহলে কি তার পথ ভুল? বিশেষ করে বিদ্রোহী হবার যেমন শক্তি থাকা চাই, তেমনি অধিকারও থাকা চাই। নজরুলের বিদ্রোহ এবং মত ও পথের এমন স্বচ্ছ প্রকাশ পরবর্তীকালে 'রাজবন্দীর জবানবন্দী'তে আর সুস্থ জীবনের শেষ পর্যায়ে 'যদি আর বাঁশী না বাজে' ভাষণে পাওয়া যায়।
নজরুল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূচনাপর্বে নিজের যে মূল্যায়ন করেছেন, সমকালীন সতীর্থদের মূল্যায়ন থেকে তার সমর্থন মেলে। নজরুলের 'বিদ্রোহী', 'কামাল পাশা', 'প্রলয়োল্লাস' প্রভৃতি কবিতা প্রকাশের পূর্বে কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত 'শাত-ইল-আরব', 'খেয়াপারের তরণী', 'মোহর্রম', 'আগমনী', 'বোধন' প্রভৃতি কবিতা বাংলার তদানীন্তন সাহিত্যজগতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মাসিক 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার সম্পাদককে একটি পত্রে 'খেয়াপারের তরণী' কবিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন, যা ঐ পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল এবং এটাই ছিল বাংলা সাহিত্যে নজরুলের কবিতার প্রথম মূল্যায়ন। '... কিন্তু যাহা আমাকে সর্বাপেক্ষা বিস্মিত ও আশান্বিত করিয়াছে, তাহা আপনার পত্রিকার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি-লেখক হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের কবিতা। বহুদিন কবিতা পড়িয়া এত আনন্দ পাই নাই, এমন প্রশংসার আবেগ অনুভব করি নাই। আমি এই অবসরে তাঁহাকে বাংলার সারস্বতমণ্ডপে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছি।' কাজী সাহেবের কবিতায় কি দেখিলাম বলিব? 'খেয়াপারের তরণী' শীর্ষক কবিতায় ছন্দ সর্বত্র মূলত এক হইলেও মাত্রাবিন্যাস ও যতির বৈচিত্র্যে প্রত্যেক শ্লোকে ভাবানুযায়ী সুর সৃষ্টি করিয়াছে। ছন্দকে রক্ষা করিয়া একটা অবলীলা, স্বাধীন স্ফূর্তি, অবাধ আবেগ, কবি কোথায়ও তাহাকে হারাইয়া বসেন নাই, ছন্দ যেন ভাবের দাসত্ব করিতেছে, কোনোখানে আপন অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে নাই, এই প্রকৃত কবিশক্তিই পাঠককে মুগ্ধ করে। ... বিস্ময়, ভয়, ভক্তি, সাহস, অটল বিশ্বাস এবং সর্বোপরি প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত একটা ভীষণ গম্ভীর অতি প্রাকৃত কল্পনার সুর, শব্দবিন্যাস ও ছন্দ ঝংকারমূর্তি ধরিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। কেবল একটি মাত্র শ্লোক উদৃব্দত করিব, 'আবুবকর উসমান উমর আলী হায়দর, দাঁড়ি যে এ তরণীই নাই ওরে নাই ডর, কাণ্ডারি এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা, দাড়ি মুখে সারি গান লা শরীক আল্লাহ্।' এই শ্লোক মিল, ভাবানুযায়ী শব্দবিন্যাস এবং গভীর গম্ভীর ধ্বনি, আকাশে ঘনায়মান মেঘপুঞ্জের প্রলয়-ডমরু ধ্বনিকে পরাভূত করিয়াছে। বিশেষ এই শেষ ছন্দের বাক্য 'লা শরীক আল্লাহ' যেমন মিল, তেমনি আশ্চর্য প্রয়োগ। ছন্দের অধীন হইয়া এবং চমৎকার মিলের সৃষ্টি করিয়া এই আরবী বাক্যযোজনা বাংলা কবিতায় কি অভিনব ধ্বনি গাম্ভীর্য লাভ করিয়াছে। এটাই ছিল নজরুলের কবিতার প্রথম মূল্যায়ন।
নজরুলের ইসলামী ঐতিহ্যের কবিতা 'খেয়াপারের তরণী' কবি সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভে সমর্থ হলেও, নজরুলের প্রধান কাব্য 'অগি্ন-বীণা' প্রকাশিত হলে সমকালীন গোঁড়া রক্ষণশীল মুসলিম পরিচালিত পত্রপত্রিকা যেমন 'ইসলাম দর্শন' পত্রিকায় মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদ 'লোকটা মুসলিম না শয়তান', 'মোসলেম দর্পণ' পত্রিকায় 'ইসলাম বৈরী মুসলমান কবি' এবং 'ইসলাম দর্শন' পত্রিকায় শেখ হাবিবুর রহমান 'কাজীর কেরদানী', 'মাসিক মোহাম্মদী' পত্রিকায় নাজির আহমদ চৌধুরী 'এছলাম ও নজরুল ইসলাম' প্রবন্ধে কবিকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা ও আক্রমণ করেন। তবে বাঙালি মুসলমান সমাজের তরুণ ও প্রগতিশীল অংশের প্রতিনিধি আবুল কালাম শামসুদ্দিন 'কাব্যসাহিত্যে বাঙালি মুসলমান' নামক প্রবন্ধে মাসিক সওগাত পত্রিকায় লেখেন, 'এই বাংলাদেশ ব্যতীত জগতের কোথাও বোধহয় কাব্যকে ধর্ম, সমাজ, সভ্যতা ইত্যাদির মাপকাঠিতে যাচাই করিবার উদ্ভট প্রয়াস হয় নাই।... কাজেই নজরুল ইসলামের কাব্য সৃষ্টি সম্বন্ধে যে অনৈসলামিকতার ধুয়া উঠিয়াছে, ইহাকে আমরা প্রবুদ্ধ কাব্য-উপভোগের ফল বলিয়া মনে করি না বরং কাব্য সম্বন্ধে উন্নত ধারণার অভাবের নিদর্শন বলিয়া ধরিয়া লইতে বাধ্য হই। নজরুল ইসলাম বাংলার জাতীয় কবি। জাতির বেদনার কথাই তাঁহার কাব্যের ভিতর দিয়া প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দু এবং মুসলমান লইয়া বাঙালি জাতি। সুতরাং এ জাতির বেদনার কথা প্রকাশ করিতে হইলে রচনায় ইসলামী এবং হিন্দুয়ানী উভয় জাতীয় প্রকাশ ভঙ্গির ছাপই দিতে হইবে, নতুবা রচনা সহজ ও সুন্দর হইবে না।' আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রমুখ তরুণ মুসলিম সাহিত্যিক 'সওগাত' পত্রিকার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান সমাজ থেকে নজরুলের যথার্থ মূল্যায়ন করলেও এই প্রথম রক্ষণশীল হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্ররা নজরুলের মূল্যায়নে আধুনিক সাহিত্যে রুচিবোধের প্রশ্ন তুলে নজরুলের অবমূল্যায়নের প্রয়াস পান। সাপ্তাহিক 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায় সজনীকান্ত দাসের নেতৃত্বে নজরুলের ওপর যে আক্রমণ শুরু হয় তা কেবল নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ও গানের 'প্যারডি' বা 'স্যাটায়ার' প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। 'প্রবাসী' ও 'শনিবারের গোষ্ঠী'র পক্ষ থেকে সজনীকান্ত দাস কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাদের দলে ভেড়াবার জন্য তাঁকে পত্র দেন, পত্রে তিনি লেখেন, "সম্প্রতি কিছুকাল যাবৎ বাংলাদেশে এক ধরনের লেখা চলছে আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন। প্রধানত 'কল্লোল' ও 'কালিকলম' নামক দুটি কাগজে এগুলি স্থান পায়।... যৌনতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব অথবা এ ধরনের কিছু নিয়ে এগুলি লিখিত হচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নরেশবাবুর কয়েকখানি বই, বুদ্ধদেব বসুর 'রজনী হল উতলা' নামক একটি গল্প,... নজরুল ইসলামের 'মাধবী প্রলাপ' ও 'অনামিকা' নামক দুটি কবিতা ও অন্যান্য কয়েকটি লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে।... আমরা কতকগুলি বিদ্রূপাত্মক কবিতা ও নাটকের সাহায্যে শনিবারের চিঠিতে... এর বিরুদ্ধে লিখেছিলাম।... কিন্তু এই প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ এত ক্ষীণ যে, কোনো প্রবল পক্ষের তরফ থেকে এর প্রতিবাদ বের হওয়ার একান্ত প্রয়োজন আছে। যিনি আজ পঞ্চাশ বছর বাংলা সাহিত্যকে রূপে রসে পুষ্ট করে আসছেন তাঁর কাছেই আবেদন করা ছাড়া আমি অন্য পথ না দেখে আপনাকে বিরক্ত করছি।" রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাসের ঐ পত্র পেয়ে বিরক্ত হয়েছিলেন কি-না তা জানা যায় না, তবে তিনি যে বিব্রত বোধ করেছিলেন তা অনুমান করা যায়। যে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে 'ধূমকেতু' পত্রিকা প্রকাশে 'আশীর্বাণী' পাঠিয়ে লিখেছেলেন, 'আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগি্নসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে, উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন; অলক্ষণের তিলকরেখা, রাতের ভালে হোক না লেখা, জাগিয়ে দেরে চমক মেরে, আছে যারা অর্ধচেতন।' রবীন্দ্রনাথের ঐ বাণী 'ধূমকেতু' পত্রিকায় নজরুল পালন করেছিলেন, 'আনন্দময়ীর আগমনে' নামক প্রতীকী রাজনৈতিক কবিতা রচনা ও প্রকাশ করে রাজবন্দি হয়ে, রবীন্দ্রনাথ জাতির জীবনে যে বসন্ত এনেছে সেই নজরুলকে গীতিনাট্য 'বসন্ত' উৎসর্গ করেছিলেন। নজরুল হুগলি কারাগারে আমরণ অনশন ধর্মঘট করলে শিলং থেকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন :
এরাব ঁঢ় যঁহমবৎ ংঃৎরশব, ড়ঁৎ ষরঃবৎধঃঁৎব পষধরসং ুড়ঁ.
সেই রবীন্দ্রনাথ নজরুল এবং অন্যান্য আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে প্রবাসী ও শনিবারের চিঠির পক্ষ থেকে সজনীকান্ত দাসের চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন, 'কঠিন আঘাতে একটা আঙুল সম্প্রতি পঙ্গু হওয়াতে লেখা সহজে সরচে না। ফলে বাকসংযম স্বতঃসিদ্ধ। এখন মনটা ক্লান্ত উদ্ভ্রান্ত, পাপ গ্রহের বক্র দৃষ্টির প্রভাব প্রবল_ তাই এখন বাগ্ব্যাত্যার দিগদিগন্তে ছড়াবার শখ একটুও নেই। সুসময় যদি আসে তখন আমার যা বলবার বলব।'
অবিভক্ত বাংলায় নজরুল প্রশংসা ও সমালোচনার দুটোরই আধিক্যে আপ্লুত ছিলেন, তবে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কলকাতা এলবার্ট হলে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর নজরুলকে যে জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল তা ঐ বয়সে অপর কোনো বাঙালি কবির ভাগ্যে জোটেনি। সে সভায় সভাপতির ভাষণে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, 'নজরুল কবি প্রতিভাবান মৌলিক কবি। রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই; তাই রবীন্দ্রনাথ তাহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। আজ আমি এই ভাবিয়া বিপুল আনন্দ অনুভব করিতেছি যে, নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন, তিনি বাঙলার কবি, বাঙালির কবি।... আজ নজরুল ইসলামকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছেন।' নজরুল সংবর্ধনা সভায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেন, 'নজরুল জীবনের নানা দিক থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন, কবি নজরুল যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখেছেন; কবি নিজে বন্দুক ঘাড়ে করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, কাজেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সেসব কথা লিখেছেন।... এতেই বোঝা যায় যে, নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ। কারাগারে আমরা অনেকে যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল-জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই। তার কারণ অনুভূতি কম। কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যে অনেক স্থানেই পাওয়া যায়। এতেও বলা যায়, তিনি একজন জ্যান্ত মানুষ।... নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়_ এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব_ তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখন তাঁর গান গাইব।... নজরুলের 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু'র মতো প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না। কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তার নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির।'
নজরুলের সাহিত্য ও সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর সমকালীন আধুনিক সমালোচকদের মতামত নজরুলের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক সমালোচকদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু প্রথম 'কবিতা' পত্রিকায় নজরুল সংখ্যা প্রকাশ এবং বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত নজরুলের অবদান মূল্যায়ন করেন।
কবি-সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়_ "কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উত্থান এমনই সর্বগ্রাসী হয়েছিল যে, তার বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে দু-তিন দশক কেটে গেল বাংলাদেশের। এই মাঝখানটার সময়টায় সত্যেন্দ্রগোষ্ঠীর সময় রবীন্দ্রনাথের প্রথম এবং প্রচণ্ড ধাক্কাটা তাঁরা সামলে নিলেন অর্থাৎ পরবর্তীদের সামলে নিতে সাহায্য করলেন... যতদিন না 'বিদ্রোহী' কবিতার নিশান উড়িয়ে হৈ হৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পেঁৗছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙল।... সব সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।"
বুদ্ধদেব বসু যাকে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক কবি বলেছেন এবং প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙার কৃতিত্ব দিয়েছেন সেই নজরুল সম্পর্কে সমকালীন অন্যান্য কবি ও সমালোচকের মূল্যায়ন কী? হুমায়ুন কবির লিখেছেন, 'নজরুল ইসলামের প্রতিশ্রুতির মূল সমাজ জীবনের এই ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত এবং সে জন্যই দেখি যে নিপীড়িত জনমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেবার সাধনা তাঁর রচনায় সবল কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল, ঐতিহ্যের লঙ্ঘন তিনি করেননি_ পুরাতন পুঁথি সাহিত্যের আবহাওয়ায় লালিত বলে বাংলার বিপুল মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর সহজ আত্মীয়তা!
ভাষা ও ভঙ্গিতে নজরুল ইসলামের কাব্যের যে বিপ্লবধর্ম, পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই তার পরিচয় মেলে।'
মোতাহার হোসেন চৌধুরী ঐ ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনকে বলেছেন, 'রেনেসাঁস' বা 'পুনর্জন্ম', 'পুরাতনে ফিরে যাওয়া বা পুরাতনকে ফিরে পাওয়া কিন্তু ভাবগত অর্থে নবজন্ম, মানে মানব মহিমা, তথা বুদ্ধি ও কল্পনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ... নজরুল ইসলাম রেনেসাঁসের প্রেরণা। বুদ্ধি ও হৃদয়ের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তিনি অনুভব করেছিলেন। তাঁর রচনার মারফতে তা আমাদের জীবনে সঞ্চারিত হয়েছে।'
প্রসঙ্গক্রমে আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ জীবনানন্দ দাশের মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ_ 'নজরুল ইসলামের আত্মপ্রত্যয় ছিল। সৎ প্রেরণাই মানুষেরও শেষ বিশ্লেষণে মানুষ সমাজের মর্মকথা এই ঘোষণায় তাঁর অপূর্ব বিশ্বাস ছিল। মনুষ্য-জীবনের পরিকীর্তিতে অমূল্য জিনিসগুলোর উত্তরোত্তর মূল্যনাশের ব্যথা তাঁকে সন্তপ্ত করেছিল। ... কিন্তু প্রবল প্রত্যয়ের ক্ষমতার কবিতা তিনি লিখেছিলেন সমাজ, কাল ও দেশ নিয়ে, প্রেম নিয়ে, আমরা সে প্রত্যয় থেকে ক্রমেই দূরত্বশীল অপর সব সত্যের দিকে চলে যেতে থাকলেও মনুষ্যত্বের অনুভবের কোনো এক স্পষ্ট উজ্জ্বলতার ভিতর নজরুলের কবিতার সঙ্গে আমাদের মিলন। ভাষা, ভাব ও বিশ্বাসের আশ্চর্য যৌবন রয়েছে এই কবিতাগুলির ভিতর। প্রেম-নারীপ্রেম, তার চেয়েও হয়তো বেশি করে দেশ ও নবীন সমাজ প্রেম বাংলা কাব্যে নজরুলের অভ্যুদয়ের মুহূর্তে যে মুক্তকণ্ঠ স্পষ্টতা চেয়েছিলেন তিনি তা যৌবনোচিত উৎসবে উৎসাহ দিতে পেরেছিলেন। অনেকখানি সমাজোৎসারিত উৎসাহ, উপাসনা ও দেশপ্রেমবহ্নি রয়ে গেছে এসব কবিতায়। বাংলার এ মাটি থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাস্তরকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয় কবি নজরুল ইসলাম।... জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল।'
কবি জীবনানন্দ দাশ নজরুলকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন তা একজন সৎ কবির সৎ উপলব্ধির প্রকাশ। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে নজরুলের স্থান নির্দেশ করতে গিয়ে প্রখ্যাত সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখেছিলেন :
ঝবাবহঃু ুবধৎং ধমড় ইবহমধষর ঢ়ড়বঃং বিৎব পড়সঢ়ষবঃবষু ফড়সরহধঃবফ নু জধনরহফৎধহধঃয ঞধমড়ৎব. ঞযবু বিৎব ঃযরহশরহম যরং ঃযড়ঁমযঃং, ৎিরঃরহম যরং ষধহমঁধমব, ঁংরহম যরং ৎযুঃযসং. অনড়ঁঃ ঃযরং ঃরসব পধসব ঘধুৎঁষ ওংষধস, ৎরংরহম যরং ঢ়ড়বিৎভঁষ রভ ৎধঃযবৎ ঢ়ৎরসরঃরাব াড়রপব রহ ঢ়ৎড়ঃবংঃ. ঐব ঃড়ড়শ বাবৎুড়হব নু ংঃড়ৎস রিঃয যরং ঢ়ড়বস. ঞযব জবনবষ, যিরপয ধিং ধ ংযড়ৎঃ ড়ভ ৎযধঢ়ংড়ফু ড়হ ঃযব হধংপবহঃ ংঢ়রৎরঃ ড়ভ ৎবাড়ষঁঃরড়হ.... ঐরং ংঁপপবংং ধিং রসসবফরধঃব ধহফ ঁহঢ়ধৎধষষবষবফ রহ ভধপঃ যব ধিং ঃযব ঢ়ড়বঃ ড়ভ হধঃরড়হধষরংঃ ৎবাড়ষঁঃরড়হ.... ঘধুৎঁষ ওংষধস, ঃযব সড়ংঃ রহংঃরহপঃরাব ড়ভ ঃযব ইবহমধষর ঢ়ড়বঃং, ংঃরৎৎবফ ঁঢ় ধ হব িধহফ ারৎরষব রহফরারফঁধষ.
বাংলা কবিতার মতো বাংলা গানের জগতেও নজরুলের স্থান বিশিষ্ট, নতুন ধারা সৃষ্টিতে পথিকৃতের। বুদ্ধদেব বসু বলেন_:
'নজরুলের গানই প্রথম সমগ্র বাঙালি সমাজকে সঙ্গীত রসে উদ্দীপিত করে তুলতে পেরেছিল এবং তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার মতো আধুনিক বাংলা গানেরও পালা বদলে পথিকৃতের কাজটি করেছিলেন।'
সঙ্গীতজ্ঞ রাজ্যেশ্বর মিত্র 'বাংলার সঙ্গীতে নজরুল ইসলাম' প্রবন্ধে লিখেছেন, 'বাংলার সাঙ্গীতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, যখনই বন্ধ্যাযুগ এসে গেছে বা সঙ্গীতে বিকৃতির আতিশয্য পরিলক্ষিত হয়েছে তখনই এক বা একাধিক প্রতিভাবান রচয়িতা এসে সেই যুগকে উদ্ধার করেছেন।... সময়টা যখন এ রকম তখন সহসা ঘটল নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি নজরুল সঙ্গীতজগতে কত অসামান্যভাবে আমাদের কত প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ শতাব্দীর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যা মেলেনি, তিনি ছিলেন তার পরিপূরক। ...তাঁর সবচেয়ে কৃতিত্ব এইখানে যে, তিনি সঙ্গীতে ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করেননি এবং নতুনকেও আহ্বান করেছেন_ কিন্তু ভারসাম্যকে এতটুকু বিচ্যুত হতে দেননি।'
রাজ্যেশ্বর মিত্র বিংশ শতাব্দীর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যে শূন্যতা বা একঘেয়ে যুগের কথা বলেছেন, সেই শূন্যতা পূরণে একঘেয়েমি দূর করার ক্ষেত্রে নজরুলের ভূমিকাকে অষ্টাদশ শতকের শেষ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিপূরক আখ্যা দিয়েছেন। বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুলের সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় নজরুলের অসুস্থতার পূর্বেই কয়েকটি বছর রাগসঙ্গীত নিয়ে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নতুন রাগ সৃষ্টির প্রয়াস। তখন তিনি সুরের রাজ্যে ডুবেছিলেন।
বিশ শতকে নজরুলের মূল্যায়ন হয়েছে অবিভক্ত বাংলা বা ভারতে। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান ও ভারতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিশেষভাবে বাংলাদেশে কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্বে উপমহাদেশের বাইরে নজরুলের কিছু অনুবাদ হলেও মূল্যায়ন হয়নি। একুশ শতকে এ অবস্থার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নজরুল ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রদত্ত জাতীয় সংবর্ধনার উত্তরে বলেছিলেন, 'বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এর অভিযান সেনা দলের তূর্যবাদকের একজন আমি। এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।' নজরুলের এই পরিচয়কেই তুলে ধরেছেন একুশ শতকের শান্তি ও মানবতাবাদী মার্কিন অধ্যাপক উইনস্টন ই ল্যাংলি। উইনস্টন ই ল্যাংলির নজরুল পর্যালোচনায়, ্তুঞযব সড়ংঃ ৎবসধৎশধনষব ঢ়ড়বঃ ধষষ ঃরসব... সড়ংঃ ঢ়ৎড়ষরভরপ পড়সঢ়ড়ংবৎ ঃযব ড়িৎষফ যধং পড়সব ঃড় শহড়্থি মধ্য দিয়ে একুশ শতকে নজরুল মূল্যায়নের যে ধারা সূচিত হলো তার মাধ্যমে বলা চলে নজরুলের যথার্থ মূল্যায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। হ
 

No comments

Powered by Blogger.